মুখে আশার বাণী ভেতরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা


সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ , আপডেট করা হয়েছে : 01-10-2025

মুখে আশার বাণী ভেতরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা

আবারও নানান সন্দেহের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একদিকে খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হবেই। হতেই হবে..। আবার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হচ্ছে ‘নির্বাচন না হলে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে রকম পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা একধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে।’

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উঁচু মহলের আশাবাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারিও যে আছে আগামী জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্থের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে এবং পৃথিবীর কোনো শক্তি এ নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। আবার এমন দৃঢ় অবস্থান যখন সরকারের উঁচু মহলের তখনই তো বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাল্টা হুঙ্কার দিচ্ছে। বলা হচ্ছে জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকার গঠিত হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। পিআর ছাড়া কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।এর পাশাপাশি তারাই আবারও মাঠে নামছে। জানা গেছে জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন এবং ভোটে পিআর পদ্ধতি চালুসহ পাঁচ দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি নিয়ে ফের মাঠে নামছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা সাত দল। এর আগে অভিন্ন দাবিতে ১৮ই সেপ্টেম্বর ঢাকায়, ১৯শে সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর সারা দেশে জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করেছে এসব দল।

তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? যখন দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক শক্তি হঙ্কার দিচ্ছে পিআর ছাড়া কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না তখন এর বিপরীতে কি বক্তব্য সরকারের উঁচু মহলের। এধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশ ও ফ্যাসিস্টের সহযোগীরা গুজব সৃষ্টির চেষ্টা করবে বলে অভিযোগ এনেই বা কি লাভ? দেশের ভেতরেই তো স্পষ্ট হয়ে উঠছে নির্বাচন হবে না হতে দেওয়া হবে কি-না?

এদিকে বেশ দেখা যাচ্ছে বা বলা চলে তোড়জোর আছে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে। চলছে নানান ধরনের পদক্ষেপ। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রাক-নির্বাচনী পরিবেশ ও প্রস্তুতি জানতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী তথ্য অনুসন্ধানী দল। বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে মিশন পাঠানোর বিষয়েও আলোচনা করেছে প্রতিনিধি দলটি। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরাপদ করতে এই কর্মসূচির আওতায় দেড় লাখের বেশি পুলিশ সদস্যকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

তারেক রহমান শঙ্কিত? 

নির্বাচন যদি হবেই বলে কনফার্ম তাহলে এতোসব আয়োজনের মধ্যে কেনোই বা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই কথা বলে বসলেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হই, আমরা গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ না হই, তাহলে আগামী দিনে গুপ্ত স্বৈরাচারের আবির্ভাব হতে পারে। জনগণ যেভাবে চায়, আমাদের সেভাবে চলতে হবে।’ যদিও তিনি এই গুপ্ত স্বৈরাচারের ব্যাপারে তেমনভাবে মুখ খুলেননি। তবে গুপ্ত শব্দটি ইদানিং একটি রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

মাহফুজ কার পালে হাওয়া দিলেন?

৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি ও জামায়াত ভাগ-ভাটোয়ারা করে প্রশাসন দখল করেছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। পাশাপাশি, গণমাধ্যম এখনো ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে বলেও মনে করেন তিনি। ‘গণমাধ্যমের স্বনিয়ন্ত্রণ ও অভিযোগ ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে গোলটেবিলে বৈঠকে এসব কথা বলেছেন উপদেষ্টা। তিনি আরও বলেছেন, এ সময় সিভিল মিলিটারি আমলাতন্ত্রকে ফ্যাসিস্ট মুক্ত না করে মিডিয়াকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে তিনি আরও বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি যে আমি কখন নেমে যাই। মানে আমি কখন নামব আমি জানি না।’ এই বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাহফুজ আলম একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। তা হলো ‘অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা সরকারকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিল। প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই দলের লোকজন ভাগ করে নিল। নাম নেওয়া উচিত নয় তাও বলি, বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা তালিকা দিয়ে তাদের লোক নিয়োগ দিল। ভিসি নিয়োগ হলো ১০ জন বিএনপির, তিনজন জামায়াতের। ভিসি না পেলে প্রোভিসি দিতে হবে। এসব নিয়ে কাড়াকাড়ি। এগুলো চোখের সামনেই হয়েছে। প্রথমে রাজনৈতিক দল বলল, দুই বছর তিন বছর যা সময় লাগে সংস্কার ও বিচার করেন। চার মাসের মধ্যে তাদের সব লোক সেট করা হয়ে গেল-ডিসেম্বর থেকে শুরুহইল অসহযোগ।’

এখন এই প্রশাসন তাহলে কার?

এই সময়ে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্য অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তার ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি ও জামায়াত দ্বারা প্রশাসনে এমন ভাগ-ভাটোয়ারা হয়ে থাকলে তা-হলে আসলে কি দাঁড়ায়? বর্তমান প্রশাসন কি বিএনপি-জামায়াতের দখলে? তাহলে কি দেশে আগামীতে যে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হচ্ছে তা-র নিরপেক্ষতা নিয়ে কি প্রশ্ন উঠবে না? তাহলে সে-ই নির্বাচন নিয়ে কি আরও মারাত্মক প্রশ্নের উদ্ভব হবে না? এমনিতেইতো আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কি আদৌও অংশগ্রহণমূলক হতে যাচ্ছে? তা না হলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবলে বিজয়ী প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সে-ই আশা বা আশ্বাসের কি হবে? কেননা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-ই? যে-ই প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা তা-তো বলা হলো ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়া হয়ে গেছে। তাহলে এই প্রশাসনের অধীনেই প্রকৃত বিজয়ী কারা হতে পারে বা হবে তা-তো প্রশ্নসাপেক্ষ। তা না হলে সম্প্রতি সদ্য অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নানান ধরণের প্রম্ন উঠেছে কেনো? 

ড. ইউনুসের কণ্ঠেও আশঙ্কা? 

বাংলাদেশের প্রশাসন বিএনপি-জামায়াত ভাগ করে নিয়েছে বলে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বক্তব্য পর আরও আলোচিত হচ্ছে ড. ইউনুসের কন্ঠে আশঙ্কার কথাগুলো..। তিনি বলেছেন. কিছু আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘সামনে কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু শক্তি রয়েছে যারা চায় না নির্বাচন হোক। আমরা জানি না, তারা কার হয়ে কাজ করছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালা হচ্ছে, যার সুবিধাভোগী রয়েছে দেশের ভেতরে ও বাইরে। তারা সুসংগঠিত– এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়।’ ২৯ সেপ্টেম্বর সোমবার নিউইয়র্কের একটি হোটেলে রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটসের সভাপতি কেরি কেনেডির নেতৃত্বে শীর্ষ মানবাধিকার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি কিছু সর্তকবাণী দেন। বলেছেন, কিছু আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এতোদিন বলা হতো বা বাতাসে চাওর ছিল একটি প্রতিবেশী দেশ নানান ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। আর এখন বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে? সেই আর্ন্তজাতিক মহলটি কে বা কারা? তারাও কি শক্তিশালি প্লাটফরম। এদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যখন এমন কথা বল্লেন তখন আবার তারই ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত বাংলাদেশের বিনিয়োগ নিয়ে কিছু স্পর্শকাতর মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৫ সালের বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবেশ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিযোগ এখনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব বাধার মধ্যে রয়েছে- অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সীমিত অর্থায়ন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিদেশি সংস্থাগুলোর জন্য অন্যায্য করের বোঝা ও দুর্নীতি। এনিয়ে কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠবেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এখনও কেনো অর্থ্যাৎ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আমলে কেনো এমন রিপোর্ট প্রকাশ পেলো?

এদিকে চলমান নানান শঙ্কার মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে খাগড়াছড়ি জেলার পরিস্থিতি। পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার জের ধরে গত ২৮ সেপ্টেম্বর রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল রামেসু এলাকা। গত সোমবারও বাজার ও আশপাশের পরিস্থিতি ছিল থমথমে। এনিয়েও উদ্বেগ সব মহলে। 

দুই অ্যাপ বন্ধের প্রস্তাব কেনো?

এদিকে সর্বশেষ আরেকটি খবর সবাইকে চমকে দিয়েছে। বলা হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত রোববার অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে দুটি অ্যাপ বন্ধের বিষয়ে আলোচনা হয়। অ্যাপ দুটি হলো টেলিগ্রাম ও বোটিম। কেননা এই দুই অ্যাপ ব্যবহার করে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করে আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীরা। আর বাংলাদেশে অ্যাপ বন্ধ করা নিয়ে এখন জল্পনা কল্পনার শেষ নে-ই। কারো কারো মতে, একটি দুর্বল আতঙ্কিত অপারগ মহলই অ্যাপ বন্ধের এমন কথা চিন্তা করতে পারে। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় সরকার কোনো কারণে বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন? এটা হলে কি থাকছে সামনের দিনগুলিতে? কোনো হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি?


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)