চব্বিশের মানবতাবিরোধী অপরাধে হাসিনার বিচার শেষ পর্যায়ে


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 01-10-2025

চব্বিশের মানবতাবিরোধী অপরাধে হাসিনার বিচার শেষ পর্যায়ে

সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটিসহ (ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার দায়) জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার বিচার একেবারেই শেষ পর্যায়ে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ চলমান এ মামলায় এরই মধ্যে ৫৩ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা শেষ হয়েছে। শুরু হচ্ছে মামলার সর্বশেষ সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ। এরপর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে। 

শেখ হাসিনার সঙ্গে এ মামলায় তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার সময়ের সর্বশেষ পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনও আসামি। তবে সাবেক আইজিপি চৌধুরী মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন। প্রসিকিউশনের সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। বিচারের শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল। তাদের পক্ষে মামলা লড়তে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে মো. আমির হোসেনকে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। 

এখন পর্যন্ত সাক্ষীদের দেওয়া জবানবন্দি ও জেরার মাধ্যমে এ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি প্রসিকিউশন পক্ষের। অন্যদিকে এসব সাক্ষীর জবানবন্দিতে আসামিদের সাজা দেওয়ার মতো কোনো অভিযোগ প্রমাণ হয়নি বলে দাবি আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীম বলেন, ‘শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আমরা এখন পর্যন্ত ৫৩ জন সাক্ষী উপস্থাপন করতে পেরেছি। এসব সাক্ষীর জবানবন্দিতে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে আমরা মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘এখন তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেবেন। এ সাক্ষ্য শেষ হলেই যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুতি হবে মামলাটি। যুক্তিতর্ক শেষ হলেই এ মামলা রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে। আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।’ জানতে চাইলে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রসিকিউশন পক্ষ যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেছে, তাতে আমার আসামিদের সাজা দেওয়ার মতো কোনো অভিযোগ প্রমাণ হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হচ্ছে। এ সাক্ষ্য শেষ হলে আরো বিস্তারিত বলা যাবে।’

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। পরে শেখ হাসিনার সঙ্গে এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকেও যুক্ত করে প্রসিকিউশন। তাদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটিসহ সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন গত ১ জুন প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে দাখিল করে। ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ আসে ট্রাইব্যুনাল থেকে। ৩ আগস্ট বিচার শুরু হয় এ মামলার। 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা এ মামলায় জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও সাক্ষ্য দিয়েছেন। জুলাই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, নিহতদের পরিবার, চিকিৎসক, ফরেনসিক এক্সপার্ট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সাক্ষীদের জবানবন্দিতে গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর ভয়াবহতা উঠে এসেছে। আর এসবের জন্য দায়ী করে শেখ হাসিনা, কামালসহ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন সাক্ষীরা। 

হাসিনার মুছে ফেলা কয়েক হাজার কল রেকর্ড ও ভিডিও ফুটেজ উদ্ধারের চেষ্টা 

জুলাই বিপ্লবের শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনা পলায়নের পর তার কয়েক হাজার কল রেকর্ড ও বিভিন্ন ধরনের ফুটেজ মুছে ফেলে জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। শেখ হাসিনার চারটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে এসব কলের রেকর্ড নেওয়া হয়। পরে এনটিএমসির মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের নির্দেশে হাসিনার এসব কল রেকর্ড মুছে ফেলা হয়। এমনকি সে ফোনগুলোর মালিকানার তথ্যও মুছে ফেলেন শেখ হাসিনার অনুগতরা। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা জানান, জিয়াউল আহসানের নির্দেশের ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় এনটিএমসি সদস্যরা নিজেদের জিম্মায় নিয়ে রেকর্ডগুলো মুছে ফেলে। তবে আইটি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এগুলো উদ্ধার করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। 

তানভীর হাসান জোহা জানান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ (ডিএমপি) স্পর্শকাতর তার বার্তাগুলো এনটিএমসি সদস্যরা নিয়ে যান। এসব কল রেকর্ড মুছে ফেলার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু ঊর্ধ্বতন সদস্য জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে। এসব আলামত উদ্ধার করা গেলে শেখ হাসিনার সঙ্গে অনেকের যোগসূত্র বের হয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

এদিকে তদন্তকারী কর্মকর্তা আলমগীর গত ২৯ সেপ্টেম্বর সোমবার ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে জানান, জুলাই গণআন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার নির্দেশে ৩ লাখ রাউন্ডের বেশি গুলি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই পুলিশ ব্যবহার করে প্রায় এক লাখ রাউন্ড গুলি। তিনি বলেন, তদন্তকালে বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে পাওয়া এক চিঠির মাধ্যমে জুলাই আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতার ওপর ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলিসংক্রান্ত ২২৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পাই। যাতে দেখা যায় এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলবার, পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করে শুধু ঢাকা শহরে ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড এবং সারা দেশে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ব্যবহার করা হয় । 

রোববার শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতারিরোধী অপরাধের মামলায় ৫৪তম এবং শেষ সাক্ষী হিসেবে এ জবানবন্দি দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর। জবানবন্দির শুরুতে গত সোমবার জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি ভিডিও আইসিটিতে প্রদর্শন করা হয়। 

এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১-এ জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনার নানা ধরনের কটূক্তি সংবলিত পেপার কাটিং জব্দ তালিকা হিসেবে প্রদর্শন করা হয়। এর মধ্যে গত বছরের ১৪ জুলাই আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি আখ্যায়িত করা শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের নিউজ অন্যতম। এছাড়া দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সময়ের ৫৪টি প্রতিবেদন মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে উপস্থাপন করে তদন্তকারী কর্মকর্তা। 

ট্রাইব্যুনালে সোমবার প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, ফারুক আহাম্মদ, তানভীর হাসান জোহাসহ অন্যরা। 

এর আগে বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৬৯টি অডিও ক্লিপ ও তিনটি মোবাইল ফোন নম্বরের সিডিআর বা কল ডিটেইল রেকর্ড জব্দ করার কথা জানান। 


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)