যুক্তরাষ্ট্রে অবসরকালীন আর্থিক নিরাপত্তার প্রধান ভরসা হলো সোশ্যাল সিকিউরিটি। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ এ সুবিধা গ্রহণ করেন। তবে অবসর ভাতা দাবি করার সঠিক বয়স ও তার শর্তাবলি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ আমেরিকানই জানেন না কোন বয়সে তারা ১০০ শতাংশ অবসর সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হবেন। এ বিভ্রান্তি দূর করার লক্ষ্যেই কংগ্রেসে নতুন একটি দ্বিদলীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে অবসরের বয়স-সংক্রান্ত পরিভাষাগুলো সহজ ও বোধগম্য করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে অবসর ভাতা গ্রহণের বয়স ও সুবিধা নিয়ে প্রবীণদের বিভ্রান্তি দূর করতে ‘ক্লেইমিং এজ ক্ল্যারিটি অ্যাক্ট, নামে নতুন একটি দ্বিদলীয় বিল ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে কংগ্রেসে উত্থাপন করেছেন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান লয়েড স্মাকার (পেনসিলভানিয়া-১১) এবং ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান ডন বেয়ার (ভার্জিনিয়া-০৮)। হাউস ওয়েজ অ্যান্ড মিনস কমিটির এ দুই সদস্যের মতে, বিদ্যমান পরিভাষা সাধারণ মানুষের জন্য অস্পষ্ট ও জটিল, যার ফলে প্রবীণ আমেরিকানরা প্রায়ই ভুল সময়ে সোশ্যাল সিকিউরিটি দাবি করে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
প্রতিনিধি স্মাকার বলেন, অবসর বয়সে পৌঁছানো আমেরিকানদের উচিত হবে যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে সোশ্যাল সিকিউরিটি দাবি করা। কিন্তু বর্তমানের জটিল প্রশাসনিক ভাষা অনেককে বিভ্রান্ত করছে। আমাদের এই আইন সরল ও স্পষ্ট পরিভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। কংগ্রেসম্যান বেয়ার যোগ করেন, আমাদের বিল প্রবীণ আমেরিকানদের আরো পরিষ্কার ধারণা দেবে এবং তারা নিজেদের আর্থিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কখন ভাতা দাবি করবেন তা নির্ধারণ করতে পারবেন। যেহেতু আমেরিকানরা দীর্ঘায়ু লাভ করছেন, তাই তাদের আর্থিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় স্পষ্ট দিকনির্দেশনা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন আইনে সোশ্যাল সিকিউরিটি প্রশাসনের ব্যবহৃত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বয়স-সম্পর্কিত পরিভাষা বদলানো হবে। ৬২ বছর বয়সকে বর্তমানে ‘আর্লি এলিজিবিলিটি এজ’ নামে পরিচিত; নতুন আইনে এর নাম হবে ‘মিনিমাম বেনিফিট এজ’। কারণ এ বয়সে সুবিধা নিলে স্থায়ীভাবে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কম ভাতা পাওয়া যায়। ৬৬ থেকে ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত প্রচলিত ‘ফুল রিটায়ারমেন্ট এজ’ হবে ‘স্ট্যান্ডার্ড বেনিফিট এজ’, যা পূর্ণ সুবিধা দেয়। ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করলে, যেটি বর্তমানে ‘ডিলেইড রিটায়ারমেন্ট এজ’ নামে পরিচিত, নতুন পরিভাষা হবে ‘ম্যাক্সিমাম বেনিফিট এজ’, যেখানে বার্ষিক ৮ শতাংশ হারে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়, সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত।
বিলটি ইতোমধ্যেই সমর্থন পেয়েছে বিপার্টিসান পলিসি সেন্টার অ্যাকশন, এএআরপি এবং এএমএসি অ্যাকশন থেকে। BPC অ্যাকশনের প্রেসিডেন্ট মিশেল স্টকওয়েল বলেন, অবসর পরিকল্পনায় স্পষ্ট ও সহজ তথ্য পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ বিল প্রবীণদের আরো বাস্তবসম্মত আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। এএআরপি, যেটি ৫০ ঊর্ধ্ব ১০ কোটিরও বেশি আমেরিকানের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে, জানায় যে তারা এ বিল সমর্থন করছে। সংস্থাটি উল্লেখ করে, এ দ্বিদলীয় প্রস্তাব কর্মজীবী আমেরিকানদের অবসর বয়স-সংক্রান্ত তথ্য আরো সহজবোধ্য করবে। এতে তারা বুঝতে পারবেন কখন ভাতা দাবি করলে তাদের সুবিধার ওপর কী প্রভাব পড়বে। একইভাবে এএমএসি অ্যাকশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডি ম্যানজিও বলেন, বছরের পর বছর সোশ্যাল সিকিউরিটির জটিল পরিভাষা প্রবীণ আমেরিকানদের বিভ্রান্ত করেছে। এর ফলে অনেকেই ভুল সময়ে ভাতা দাবি করেছেন। এ সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রবীণদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে সোশ্যাল সিকিউরিটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। প্রায় ৭ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে এর সুবিধা নিচ্ছেন। তবে অধিকাংশ মানুষই সঠিকভাবে জানেন না কোন বয়সে কত ভাতা পাওয়া যায়। ন্যাশনওয়াইড রিটায়ারমেন্ট ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১ হাজার ৮০০ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে মাত্র ২১ শতাংশ সঠিকভাবে বলতে পেরেছেন কোন বয়সে তারা পুরো সুবিধা পাবেন। সোশ্যাল সিকিউরিটির অর্থনৈতিক টেকসইতা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ভবিষ্যতে তহবিল ঘাটতি দেখা দিলে অবসরের বয়স বাড়ানো হতে পারে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন। তবে এই বিল সরাসরি বয়স বাড়ানোর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; বরং বয়স-সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দূর করে প্রবীণদের আরো স্বচ্ছ ধারণা দেওয়াই মূললক্ষ্য।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ক্লেইমিং এজ ক্ল্যারিটি অ্যাক্ট কংগ্রেসে পাস হলে এটি সোশ্যাল সিকিউরিটি ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগত সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হবে। নতুন এ পরিভাষা ব্যবহার করলে প্রবীণ আমেরিকানরা আর্থিকভাবে আরো নিরাপদ ও সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবসরকালীন ভাতার ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন উঠছে, ভবিষ্যতে কি অবসরের বয়স বাড়তে চলেছে? ইতিহাস বলছে, ১৯৮৩ সালে তহবিল ঘাটতি মেটাতে পূর্ণ অবসর বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ করা হয়েছিল। বর্তমানে সোশ্যাল সিকিউরিটি আবারও আর্থিক চাপে পড়ায় অনেকে মনে করছেন বয়স আরো বাড়ানো হতে পারে। যদিও সোশ্যাল সিকিউরিটি প্রশাসনের কমিশনার ফ্রাঙ্ক বিসিগনানো সম্প্রতি পরিষ্কার করে বলেছেন, আপাতত বয়স বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।
অধিকাংশ আমেরিকানও অবসর বয়স বাড়ানোর বিরোধিতা করছেন। কারণ বয়স বাড়ানো মানেই কার্যত ভাতার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া। প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট সদস্য জন লারসন উল্লেখ করেন, প্রতি বছর বয়স বাড়ালে সুবিধা ৭ শতাংশ কমে যায়। রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পল সম্প্রতি অবসর বয়স ৭০ করার প্রস্তাব দিলেও সেটি পাশ হয়নি। কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসের বিশ্লেষণও বলছে, বয়স ৭০ করলেও দীর্ঘমেয়াদি ঘাটতি পুরোপুরি মেটানো যাবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স বাড়ালে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ তারা বাধ্য হয়ে ৬২ বছরেই সুবিধা নিতে শুরু করবেন। এক্ষেত্রে তাদের মাসিক আয় স্থায়ীভাবে কমে যাবে। এজন্য কিছু প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যেমন-একটি মৌলিক ন্যূনতম ভাতা চালু করা অথবা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বেশি হারে প্রতিস্থাপন ভাতা নির্ধারণ করা।
৯০ বছর পেরিয়ে আসা সোশ্যাল সিকিউরিটি যুক্তরাষ্ট্রে কেবল একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি নয়, বরং অবসর নিরাপত্তার প্রতীক। সাম্প্রতিক এই বিলটি পরিভাষাগত জটিলতা দূর করে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। যদিও অবসরের বয়স বাড়ানোর প্রশ্নে সরকার আপাতত ‘না’ বলছে, তবু ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক চাপ ও রাজনৈতিক দরকষাকষি পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সোশ্যাল সিকিউরিটির সংস্কার-সংক্রান্ত প্রতিটি সিদ্ধান্ত কোটি মানুষের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।