প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শিকাগোতে জাতীয় নিরাপত্তা ও অভিবাসন ইস্যুতে সামরিক শক্তি ব্যবহারের ইঙ্গিত দেওয়ায় নতুন করে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট দেখা দিয়েছে। গত ৬ অক্টোবর সোমবার ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের গভর্নর জেবি প্রিত্জকার অভিযোগ করেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে যাতে ‘ইনসারেকশন অ্যাক্ট’ প্রয়োগের অজুহাত তৈরি করা যায়।
‘ইনসারেকশন অ্যাক্ট’ যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঐতিহাসিক ফেডারেল আইন, যা ১৮০৭ সালে প্রণীত হয়। এই আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট প্রয়োজনে ফেডারেল সেনাবাহিনী বা ন্যাশনাল গার্ডকে কোনো অঙ্গরাজ্যে মোতায়েন করতে পারেন। যদি সেখানে বিদ্রোহ, সহিংসতা বা আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে এবং রাজ্য সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। সাধারণত এই আইন নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার চূড়ান্ত ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ এটি সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়। ইতিহাসে এর ব্যবহার হয়েছে সীমিতভাবে, যেমন ১৯৫৭ সালে আরকানসাসে স্কুলে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ফেডারেল সৈন্য পাঠানো এবং ১৯৯২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েনের ক্ষেত্রে। সমালোচকরা বলেন, এই আইন প্রয়োগ অত্যন্ত সংবেদনশীল ও রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এটি সামরিক শাসনের আশঙ্কা সৃষ্টি করে এবং রাজ্য–ফেডারেল ক্ষমতার ভারসাম্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
প্রিত্জকার বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার দিয়ে রাতে আবাসিক ভবনে অভিযান চালানো হয়েছে যেন যুদ্ধক্ষেত্র। ইলিনয় রাজ্য ও শিকাগো সিটি সোমবার সকালে যৌথভাবে ফেডারেল আদালতে মামলা দায়ের করেছে, যাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ন্যাশনাল গার্ড ফেডারেলাইজেশন বা শহরে মোতায়েন রোধ করা যায়। মামলায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিককেই সামরিক দখলের ভয় নিয়ে বাঁচতে হবে না, কেবলমাত্র কোনো রাজ্য বা শহরের নেতৃত্ব প্রেসিডেন্টের অপছন্দ বলে।
গভর্নর প্রিত্জকার সাংবাদিক সম্মেলনে এক ভিডিও প্রদর্শন করেন, যেখানে দেখা যায় ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার থেকে অস্ত্রধারী ফেডারেল এজেন্টরা শিকাগোর সাউথ শোর এলাকার এক ভবনে নামছেন। ভিডিওটি পরে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সচিব ক্রিস্টি নোম সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন। প্রিত্জকারের ভাষায়, এটি মিডিয়া ক্যামেরার জন্য সাজানো রাতের নাটক। বাস্তবে এটি ভীতি সৃষ্টির কৌশল। তিনি আরও বলেন, ফেডারেল বাহিনী অশ্রু গ্যাস ও গ্যাস পেলেট ছুড়ে সাধারণ বিক্ষোভকারীদের ‘দাঙ্গাবাজ’ হিসেবে তুলে ধরছে। গভর্নর আরো বলেন, “তাদের উদ্দেশ্য সামরিক হস্তক্ষেপ বৈধ করার অজুহাত তৈরি করা।
ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির (ডিএইচএস) সহকারী সচিব ট্রিশা ম্যাকলাফলিন এক বিবৃতিতে বলেন, গভর্নর প্রিত্জকার তার অট্টালিকা ছেড়ে বাস্তবে রাস্তায় নামলে দেখতেন-কীভাবে তার ব্যর্থ নীতির কারণে শিকাগোতে অপরাধ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অকার্যকরতার কারণে ফেডারেল এজেন্টদের জীবন হুমকির মুখে। ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, আমি এখনও ইনসারেকশন অ্যাক্ট প্রয়োগ করিনি। কিন্তু যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, আমি তা করব।
গত সপ্তাহান্তে শিকাগোতে দুটি সহিংস ঘটনার কথা জানিয়েছে ডিএইচএস। তাদের দাবি, বিক্ষোভকারীরা ইমিগ্রেশন এজেন্টদের গাড়ি র্যাম করে আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে ফেডারেল অফিসাররা গুলি চালাতে বাধ্য হন। আহত এক নারীকে আটক করা হয়েছে; তার গাড়িতে অস্ত্র পাওয়া গেছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, ফেডারেল এজেন্টরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুলি চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
মামলায় ইলিনয় ও শিকাগোর আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছেন, ট্রাম্প কোনো বিদ্রোহ বা অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের প্রমাণ ছাড়াই ন্যাশনাল গার্ড ফেডারেলাইজ করার চেষ্টা করছেন, যা পস কমিটাটাস অ্যাক্ট লঙ্ঘন করে। তারা বলেন, “ইলিনয়ে কোনো বিদ্রোহ নেই, কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীও নয়। এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নাটক। ওরেগনে একই ইস্যুতে এক ফেডারেল বিচারক ট্রাম্পের নির্দেশ অস্থায়ীভাবে স্থগিত করেছেন। রায়ে বিচারক কারিন ইমারগাট লিখেছেন, এ দেশ সংবিধানের শাসনে পরিচালিত, এটি সামরিক শাসনে নয়।
এদিকে গত ৬ অক্টোবর সোমবার সকালে শিকাগোর মেয়র ব্র্যান্ডন জনসন শহরব্যাপী “আইস ফ্রি জোন” ঘোষণা করেন। তার নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী, শহরের কোনো সরকারি সম্পত্তি ইমিগ্রেশন এজেন্টদের অভিযানে ব্যবহার করা যাবে না। জনসন বলেন, আমরা আমাদের বাসিন্দা ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করব। ফেডারেল এজেন্টরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, শিশু ও পুলিশ অফিসারদের ওপর টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে। এটি আমরা মেনে নেব না।
হোয়াইট হাউসের উপপ্রধান উপদেষ্টা স্টিফেন মিলার পাল্টা মন্তব্যে বলেন, মেয়রের এই আদেশই প্রমাণ করে যে ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব আইন প্রয়োগের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। যখন আইস অফিসাররা ফেডারেল আইন অনুযায়ী কাজ করছেন, তখন তাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এটি সন্ত্রাসবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
এই সঙ্কটের কেন্দ্রে রয়েছে এক মৌলিক প্রশ্ন ফেডারেল সরকার কি রাজ্যের আপত্তি সত্ত্বেও স্থানীয় ন্যাশনাল গার্ডকে দখলে নিতে পারে? আইনবিদরা বলছেন, এই মামলা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃত্বের সীমারেখা নির্ধারণে একটি ঐতিহাসিক নজির তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে আইন ও শৃঙ্খলা ইস্যুতে নিজেকে শক্তিশালী নেতা হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন, আর শিকাগো সেই মঞ্চে পরিণত হয়েছে।