হেঁটে হেঁটে টোকিও


হাবিব রহমান , আপডেট করা হয়েছে : 08-10-2025

হেঁটে হেঁটে টোকিও

টোকিও কেবল জাপানের রাজধানী নয়, এটি অনুভূতি, গল্প আর আবেগের শহর। প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে এক নতুন দৃশ্য, নতুন গল্প। আমার ভ্রমণে সবচেয়ে স্পর্শ করেছে এ পাঁচটি এলাকার সৌন্দয-রোপ্পঙ্গী, শিনাগাওয়া, মিনাতো, তাইতো এবং চিয়োদো। গাইড নিকিতাকে সঙ্গে নিয়ে এসব এলাকা হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখছিলাম। আর গল্প শুনছিলাম তার কাছে।

প্রথমেই রোপ্পঙ্গী। নিকিতা বলছিল, রোপ্পঙ্গী নামের অর্থ ছয়টি গাছ, কিন্তু আজ এটি শহরের শিল্প ও নাইটলাইফের প্রাণকেন্দ্র। রোপ্পঙ্গীর মোরি আর্টস মিউজিয়ামে এ উঠে জানালার বাইরে তাকালাম-নিচে বিস্তৃত শহর, দূরে লাল আলোয় টোকিও টাওয়ার। মনে হলো শহরটা এক বিশাল ক্যানভাস, আর আমি সেই ক্যানভাসের একমাত্র দর্শক। 

নিকিতা বল্লো, রোপ্পঙ্গী রাত হলে নিয়ন আলোয় ঝলমল করে, আর রেস্তোরাঁ ও বারগুলো যেন গল্প বলে।

এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম শিনাগাওয়া রেলস্টেশনে। শিনাগাওয়া শুধু ট্রেন স্টেশন নয়, এটি শহরের ছন্দ। শিনকানসেনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মনে হলো মানুষের পদচারণা আর ট্রেনের শব্দ যেন একটি জীবন্ত সিম্ফনি বাজাচ্ছে। আমাদের পরবর্তী গন্তব‍্য মিনাতো এলাকায়। নিকিতা জানায়, মিনাতো টোকিওর একটি প্রাণবন্ত এলাকা, যেখানে আধুনিক স্থাপত্য, করপোরেট অফিস এবং দূতাবাসগুলো একসঙ্গে মিলে শহরের আন্তর্জাতিক রূপ তুলে ধরে। এখানে রয়েছে টোকিও টাওয়ার, রোপ্পঙ্গী হিলস, আধুনিক শপিং মল ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

রাত হলে মিনাতোর উঁচু ভবনগুলো নিয়ন আলোয় ঝলমল করে, আর রেস্তারাঁ, বার ও গ্যালারি এলাকা শহরকে জীবন্ত করে তোলে। মিনাতো হলো আধুনিক টোকিওর প্রতিচ্ছবি- ব্যস্ততা, নকশা ও বৈচিত্র্যের এক অনন্য মেলবন্ধন। তাইতো টোকিওর একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকা, যেখানে প্রাচীন মন্দির, পার্ক এবং সাংস্কৃতিক স্থাপত্য মিলেমিশে শহরের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আকাকুসা ও সেনসেজি মন্দির এখানে দর্শনীয়, যা জাপানের প্রাচীন ধর্ম ও সংস্কৃতির কেন্দ্র।

নিকিতা জানায়, উয়েনো পার্ক এবং উয়েনো জু শহরের সবুজায়ন ও বিনোদনের কেন্দ্র। তাইতো এলাকা তার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রাণবন্ত রাস্তাঘাটের মাধ্যমে ভ্রমণকারীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা উপহার দেয়।

চিয়োদো টোকিওর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক হৃদয়। এখানে অবস্থিত ইম্পেরিয়াল প‍্যালেস যা সম্রাটের আবাস এবং ঐতিহাসিক বাগান নিয়ে গঠিত। এছাড়াও ন‍্যাশনেল ডায়েট বিল্ডিং শহরের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। চিয়োদো এলাকা তার নীরবতা, সবুজায়ন এবং স্থাপত্যের সৌন্দর্যের মাধ্যমে ভ্রমণকারীদের কাছে ইতিহাসের গভীর ছোঁয়া পৌঁছে দেয়। নিকিতা জানায়, রাত্রে টোকিও ভিন্ন রূপে জেগে ওঠে। নিয়ন আলো, আর্ট গ্যালারি, মন্দিরের নিস্তব্ধতা-সব মিলিয়ে শহরকে এক অবিস্মরণীয় অনুভূতিতে ভরে তোলে। 

রোপ্পঙ্গী থেকে চিয়োদো, মিনাতো থেকে তাইতো-প্রতিটি এলাকা যেন আমার ভ্রমণের গল্পে নতুন অধ্যায় লিখেছে। শিল্প, ইতিহাস, আধুনিকতা আর আবেগের এক অদ্ভুত মিলনে টোকিও আমার মনে রয়ে থাকবে চিরকাল।

ন‍্যাশনাল আর্টস সেন্টার

টোকিও সিটির রোপ্পঙ্গি এলাকার ব্যস্ত রাস্তা আমাদের নিয়ে এলো টোকিও ন্যাশনাল আর্ট সেন্টারে। দূর থেকেই চোখে পড়ছিল এর কাচে মোড়ানো ঢেউখেলানো স্থাপত্য, যেন কংক্রিটের শহরে হঠাৎ উদিত হওয়া এক স্বচ্ছ সমুদ্রের ঢেউ। নিকিতা জানায়, ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিল্পকেন্দ্র জাপানের সবচেয়ে ভিন্নধর্মী মিউজিয়াম। কারণ এর নিজস্ব স্থায়ী কোনো সংগ্রহ নেই। এটি একটি এক্সিবিশন সেন্টার। বছরের পর বছর ধরে এখানে আয়োজন করা হয় দেশি-বিদেশি শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। ফলে একবার দেখা মানে শেষ নয়, প্রত্যেকবার আসলেই নতুন কোনো অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে। প্রদর্শনীতে থাকে আধুনিক শিল্প, সমকালীন ভাস্কর্য, পেইন্টিং, ইনস্টলেশন আর ফটোগ্রাফির বিস্ময়কর মিশ্রণ। খ্যাতনামা স্থপতি কিশো কুরোকাওয়া এই ভবনটি নির্মাণ করেন। এর ঢেউখেলানো কাচের দেওয়াল সূর্যের আলোয় যেন একেকটি রঙিন সুর বাজায়। ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে বিশাল অ্যাট্রিয়াম, যেখানে ঝুলন্ত কন-আকৃতির কাঠামো যেন ভবিষ্যতের শিল্পবৃত্ত। উপরে আছে ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ। যেখানে বসে শিল্পকর্ম দেখার পর এক কাপ কফি হাতে শহরের ব্যস্ততাকে বাইরে রেখে শান্তির আবেশে ডুবে যাওয়া যায়।

আজ এই আর্টস সেন্টারে যে প্রদর্শনীটি হচ্ছিলো এর শিরোনাম ছিল ঊঃবৎহধষ ঊপযড়বং : ঠড়রপবং ড়ভ ঈড়হঃবসঢ়ড়ৎধৎু। এখানে সমকালীন জাপানি শিল্পীদের কাজ প্রদর্শিত হচ্ছিল। গ্যালারির দরজা খুলতেই যেন প্রবেশ করলাম রঙ, শব্দ আর নীরবতার এক নতুন মহাবিশ্বে।

প্রথমেই চোখে পড়ল শিল্পী আয়া তাকাহাশির একটি বিশাল ক্যানভাস। কালো আর রক্তিম রঙে আঁকা রেখাগুলো মনে হচ্ছিল আগ্নেয়গিরির অন্তর্গত গোপন বিস্ফোরণ। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ, মনে হচ্ছিল তিনি ক্যানভাসে নিজের হৃদয়ের যন্ত্রণা ছুড়ে দিয়েছেন। এরপর ঘুরে এলাম কেনজি মরির ইনস্টলেশনে। ঝুলে থাকা শত শত স্বচ্ছ কাচের টুকরো, প্রতিটি টুকরোয় আলোর প্রতিফলন যেন রঙিন বৃষ্টির ফোঁটা। আলো যখন ভেঙে পড়ছিল টুকরোগুলোর ভেতর দিয়ে, মনে হচ্ছিল আমি এক ঝলমলে বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে আছি।

অন্য এক প্রান্তে ছিল হিরোকো ইয়ামাজাকির ফটোগ্রাফি সিরিজ-টোকিওর পুরোনো গলির ছবি। সেখানে ছিল শৈশবের খেলার মাঠ, পুরোনো বাড়ির দেওয়ালে লেগে থাকা রঙের চিহ্ন, কিংবা সন্ধ্যার নিস্তব্ধ আলো। শহরের কোলাহল হঠাৎ থেমে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠেছিল টোকিওর অন্যরকম দৃশ‍্য। ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো প্রতিটি শিল্পকর্মের সঙ্গে যেন আমার এক অদৃশ্য আলাপ চলছে। আমি কথা বলছি না, কিন্তু তারা উত্তর দিচ্ছে আলো, রঙ আর আকারের ভাষায়। যেন এই প্রদর্শনী শুধুই দর্শন নয়, বরং আত্মদর্শন।

প্রদর্শনী শেষে উপরে ক্যাফেতে বসে কফির কাপে চুমুক দিলাম। জানালার ওপারে অস্তগামী সূর্য ঢেউখেলানো কাচের দেওয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমি যেন এক বিশাল শিল্পকর্মের অংশ হয়ে আছি, যেখানে শহর, আলো, আর্ট সেন্টার আর আমি-সবই মিলেমিশে এক হয়ে গেছি ঊঃবৎহধষ ঊপযড়বং প্রদর্শনী আমাকে মনে করিয়ে দিলো, শিল্প শুধু দেখার নয়, অনুভব করারও। প্রতিটি শিল্পকর্ম মানুষের ভেতরগোপন দরজা খুলে দেয়।

অচেনা দেশ, চেনা স্বাদ

টোকিওর রঙিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে পরিচিত মুখগুলো-স্টারবাকস, ম্যাকডোনাল্ড এবং সেভেন-ইলেভেন। যদিও শহরটি সম্পূর্ণ নতুন, অচেনা, কিন্তু এ দোকানগুলো আমাদের মতো একজন বিদেশি পর্যটককে মানসিকভাবে সান্ত¦না জোগায়। এসব দোকানের উপস্থিতি বিদেশি পর্যটকদের খাবারের চিন্তা কমিয়ে দেয়। টোকিওতে আমার হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটছি। মোড়ে মোড়ে চোখে পড়ছে স্টারবাকস কফির পরিচিত সব চিহ্ন। গলা ভেজাতে একটা দোকানে গিয়ে কফির অর্ডার দিলাম। ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো, আমি যেন নিউইয়র্কের কোনো স্টারবাকসে বসে আছি। পরিচিত কফির সুবাস, হালকা মিউজিক এবং চেনা পরিবেশ-সব মিলিয়ে হঠাৎই অচেনা শহরটিকে যেন পরিচিত লাগছে। জানা যায়, জাপানে স্টারবাকস কফির মোট শাখার সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮০৯টি। বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর তৃতীয় সর্বাধিক।

গাইড নিকিতা জানায়, শুধু টোকিও শহরেই স্টারবাকসের শাখা রয়েছে প্রায় ২ হাজার। এই সংখ্যা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত। যেমন গিনজা, শিবুয়া, শিনজুকু, হরাজুকু, ওদাইবা, এবং আরো অনেক জায়গায়। এসব দোকান বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশেষভাবে সুবিধাজনক। এখানে পাওয়া যায় কফি, স্যান্ডউইচ, পাউরুটি, কলা, পানি এবং অন্যান্য হট ফুড, যা খাবারের সংকট দূর করে। অনেক শাখায় ইংরেজি জানা কর্মী পাওয়া যায়, যা ভাষাগত সহায়তা প্রদান করে। নিকিতা আরো জানায়, টোকিওর গিনজা এলাকায় অবস্থিত স্টারবাকসের শাখাটি বিশ্বের ২০০০তম শাখা হিসেবে খোলা হয়েছিল, যা ব্র্যান্ডের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

টোকিও শহরের উজ্জ্বল বিলবোর্ড ও নিয়ন আলো জানালার বাইরে ঝলমল করছিল। কফির কাপ হাতে নিয়ে, জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবছিলাম নিউইয়র্কের সেই সকালের অনুভূতি যেন ফিরে এসেছে। অথচ চারপাশে টোকিওর জীবন ঝলমল করছে। এই ছোট্ট মুহূর্ত আমাকে মনে করিয়ে দিলো, পরিচিত স্বাদ ও অভিজ্ঞতা যে কোনো নতুন শহরকে আরো ঘনিষ্ঠ এবং আপন করে তুলতে পারে।

একই অবস্থা ম‍্যাকডোনাল্ডের ব‍্যাপারেও। জাপানে ম্যাকডোনাল্ড রেস্তোরাঁর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৯৮৯টি। এটি জাপানকে বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় এবং চীনের পর তৃতীয় অবস্থানে রেখেছে। নিকিতা জানায়, এই বিপুল সংখ্যক ম্যাকডোনাল্ড রেস্তোরাঁ জাপানের প্রতিটি শহর, গ্রাম-এমনকি ছোট্ট গলিতেও পাওয়া যায়। যেমন-টোকিওর সিনজুকু, শিবুয়া, হরাজুকু, গিনজা-এমনকি ছোট্ট শহরগুলোতেও ম্যাকডোনাল্ডের শাখা খুঁজে পাওয়া যাবে। এগুলো বিদেশি পর্যটকদের জন্য এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি! হিসেবে কাজ করে। টোকিও থাকা অবস্থায় আমি এসব ম‍্যাকডোনাল্ড থেকে ফিস বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কোক বা স্প্রাইট নিয়ে লাঞ্চ বা ডিনার করেছি।

ম্যাকডোনাল্ডের এ উপস্থিতি বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক। বিশেষ করে আমেরিকান পর্যটকদের জন্য, ফ্যামিলিয়ার খাবারের অভাব পূরণ করে। এছাড়া ম্যাকডোনাল্ডের ২৪ ঘণ্টা খোলা শাখাগুলো রাতে খাবারের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে কাজ করে। নিউইয়র্কের মতোই, জাপানে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেভেন-ইলেভেন দোকান খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো শুধু স্থানীয়দের নয়, বিদেশি পর্যটকদের জন্যও একটি খাবার সমস‍্যার সহজ সমাধান করে।

এক পরিসংখ‍্যানে জানা যায়, ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত জাপানে সেভেন-ইলেভেনের মোট দোকান সংখ‍্যা প্রায় ২১ হাজার ৭৪৩টি। এটি বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক সেভেন-ইলেভেন দোকান রয়েছে এমন দেশ। বিশ্বব্যাপী ৮৫ হাজারেরও বেশি সেভেন ইলেভেন দোকানের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ জাপানে অবস্থিত। টোকিও শহরেই রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮২৪টি দোকান। আমি জাপানে যেসব হোটেলে থেকেছি তার প্রতিটির পাশেই ছিল সেভেন-ইলেভেন দোকান। প্রয়োজনে পানি, পাউরুটি, কলাসহ প্রয়োজনীয় অনেক খাবার দাবার এসব সেভেন-ইলেভেন থেকে সংগ্রহ করতে পেরেছি।

জাপানে ভ্রমণরত বিদেশি পর্যটকদের জন্য সেভেন-ইলেভেন একটি অপরিহার্য সঙ্গী। এখানে আপনি পাবেন পরিচিত পাউরুটি, কলা, পানি, হট ডগ, স্যান্ডউইচ, ডোনাট, কফি এবং এমনকি এটিএম-এ ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দিয়ে নগদ অর্থ উত্তোলনও সম্ভব। এছাড়া এসব দোকানে বিল পেমেন্ট, টিকেট বুকিং, ফটোকপি, ইন্টারনেট সার্ভিসের মতো সুবিধাও রয়েছে। পর্যটকদের জন্য বিশেষ সুবিধা হলো এসব সেভেন-ইলেভেন ২৪ ঘণ্টা খোলা। যেজন‍্য যে কোনো সময় খাবার বা বা অন‍্যান‍্য প্রয়োজনীয়তা মেটানো যায়। পাওয়া যায় বাজেটের মধ্যে মানসম্মত খাবার, তাজা ফল, সালাদ, ওটমিল, দই ইত্যাদি। সেভেন-ইলেভেন অনেক বড় দোকান বিধায় অনেক দোকানে ইংরেজি জানা কর্মী থাকে যা একজন বিদেশি বা পর্যটকের জন‍্য বিশেষভাবে উপকারী হয়।

জাপানের ঐতিহ্যবাহী সুমো লড়াই

জাপানের পুরোনো রাজধানী কিয়োটো থেকে টোকিওতে ফিরে এসে হোটেল নিয়েছি রিয়োগোকু এলাকায়। নাম রিয়োগোকু ভিউ হোটেল। টোকিওর রিয়োগোকু এলাকা সুমো সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এখানকার কোকুগিকান স্টেডিয়াম সুমো রিংয়ের ঐতিহ্য ও গৌরবের সাক্ষী। প্রতি বছর জানুয়ারি, মে, জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে এখানে গ্র্যান্ড টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দেশি-বিদেশি রেসলাররা তাদের শক্তি ও কৌশলের প্রদর্শনী করে। সুমো হচ্ছে জাপানের জাতীয় খেলা। পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে জাপানেই পেশাদারি পর্যায়ে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। সুমো লড়াই ১২০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। প্রাথমিকভাবে এটি সিন্তো ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান হিসেবে উদ্ভূত। রেসলাররা লবঙ্গ ছিটিয়ে, মাটিতে নেচে ধুুলিকতা দূর করে, যা দুষ্টশক্তি দূর করার প্রতীক। প্রতিটি লড়াই তাই কেবল খেলা নয়, বরং প্রাচীন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রকাশ। এখন সুমো খেলার সিজন। হোটেল রিসিপশনের বললে তারাই খেলার টিকেট সংগ্রহ করে দিলেন।

জনস্রোতে মিশে ঢুকে পড়লাম স্টেডিয়ামে।

আমি রিংয়ের কাছে দাঁড়িয়েছি। চারপাশে দর্শকরা চুপচাপ, প্রত্যেকে যেন শ্বাসরুদ্ধ করে মুহূর্তটি উপভোগ করছে। হঠাৎ রেসলার দুইজন ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। তাদের পদক্ষেপে দৃঢ়তা, চোখে আত্মবিশ্বাস। মনে হলো, সময় যেন থমকে গেছে। রেসলাররা হাত মাটিতে স্পর্শ করে, পা স্থির করে শক্তি সঞ্চয় করছে। তারা দেহকে প্রসারিত করে, ঘাড় এবং কোমর ঠিক করে। দর্শকরা নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে আছে, প্রত্যেকটি নড়াচড়াই গুরুত্বপূর্ণ। রিংয়ে মুখোমুখি দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ছে। ধীরে ধীরে তারা একে অপরকে ঠেলে, ভারসাম্য পরীক্ষা করছে। হঠাৎ এক রেসলার চাপের সঙ্গে এগোলে, অন্যজন পেছনে সরে, দর্শকরা চিৎকার করে ওঠে। রিংয়ের মাটি যেন প্রতিটি ধাক্কায় স্পন্দিত হচ্ছে।

দুই রেসলার ঘূর্ণন করে, একে অপরকে ঠেলে এবং ফাঁদে ফেলে। হঠাৎ তাদের হাত এবং কাঁধের শক্তি, পায়ের অবস্থান-সব মিলিয়ে যেন এক নৃত্য। দর্শকরা চিৎকার করছে, উচ্ছ্বাসে বুক ধড়ফড় করছে। চোখের সামনে কৌশল আর শক্তির সংমিশ্রণ। হঠাৎ এক রেসলার অন্যজনকে ধাক্কা দিয়ে ব্যালান্স হারাতে বাধ্য করে। মাটিতে ধাক্কা, আর বিজয়ী সাফল্যের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শকরা হাততালি দিচ্ছে, জয়ী রেসলারকে সম্মান দেখাচ্ছে, চোখে গর্বের ছোঁয়া। শেষে বিজয়ী রেসলার রিংয়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে পুরস্কার গ্রহণ করে। এভাবেই সুমো লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে।

সুমোতে বিজয়ী হওয়া মানে কেবল খেলার জয় নয়। এটি সম্মান ও মর্যাদা অর্জন। এ জয় সমাজে তাদের মর্যাদার প্রতীক।

জাপানের দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকা নিষিদ্ধ!

হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো টোকিওর বিভিন্ন দেওয়ালে সিটি কর্তৃপক্ষের লাগানো একটি পোস্টার। তাহলো দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকা নিষিদ্ধ। আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই মৃদু হেসে নিকিতা জানায়, জাপানের অনেক শহরের দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো আইনগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক।

আইনগত কারণ হলো জাপানে উধসধমবং ঃড় চৎড়ঢ়বৎঃু অপঃ. বা সম্পত্তি ধ্বংস/ক্ষয় আইন অনুযায়ী, অন্যের সম্পত্তি বিনা অনুমতিতে ক্ষতিগ্রস্ত করা অবৈধ। তাছাড়া গ্রাফিতি এক ধরনের ভিত্তিক ক্ষয় হিসেবে ধরা হয়, তাই এটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। পুলিশ সাধারণত কঠোরভাবে শহরের দেওয়াল, ট্রেন, স্টেশন এবং পাবলিক স্পেসে গ্রাফিতি করা নিয়ন্ত্রণ করে।

আর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ হচ্ছে জাপানে শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। শহরের সৌন্দর্য বজায় রাখা এবং সাধারণ মানুষকে নিরাপদ পরিবেশ দেওয়াই প্রাথমিক লক্ষ্য। ভাঙা বা আঁকা দেওয়াল সাধারণত সামাজিক অসন্তোষ বা অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত ধরা হয়।

এছাড়া আর্থিক ও নাগরিক কারণও রয়েছে। তাহলে গ্রাফিতি মুছে ফেলা বা দেওয়াল পুনর্নির্মাণে উচ্চ খরচ হয়। শহরের ব্যবসা ও পর্যটনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে আশার কথা হলে জাপানে গ্রাফিতি আঁকা একেবারেই নিষিদ্ধ নয়। অনুমোদিত ‘গ্রাফিতি ওয়াল’ রয়েছে যেখানে গ্রাফিতি আঁকা যায়।

সবুজ বাতিতে পাখির ডাক

অনেকক্ষণ নিকিতাকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছিলাম। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। তাকে জানাতেই চোখ ইশারায় রাস্তার ওপারে একটা কফিশপ দেখিয়ে বললো চলো ওখানে যাই। অপেক্ষা করছিলাম রাস্তা পারাপারের জন‍্য। সবুজ বাতি জ্বলতেই রাস্তা পেরোতে লাগলাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড মধুর স্বরে পাখি ডেকে উঠলো। চারদিকে চেয়েও কোনো গাছপালা দেখতে পেলাম না। এবারও দেখলাম, আমার দিকে চেয়ে নিকিতা মৃদু মৃদু হাসছে। বললো, জাপানিরা রোমান্টিকতা পছন্দ করে। তাই প্রতিটি রাস্তায় সবুজ বাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের প্রাকৃতিক সংগীতময় পাখির ডাক সেট করে দিয়েছে, যা শহরের ব্যস্ততার মধ্যে এক রোমান্টিক ছোঁয়া এনে দেয়। জাপানের শহরে ছোট ছোট এ রোমান্টিক মুহূর্তগুলো শহরের ব্যস্ততা ভুলিয়ে দেয়। অনেক জাপানি কবি ও লেখক এ দৃশ্যকে ‘শহরের হৃদয়ে প্রকৃতির নিঃশব্দ প্রেম’ বলে বর্ণনা করেছেন।

নিকিতা বললো, দেখো তোমার চোখে লাইটের সবুজ আলো পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল। তখন সেই পাখির ডাক হৃদয়ের সঙ্গে মিশে শহরের ভিড়কেও এক মধুর সুরে পরিণত করে তুললো। এ আকিয়াবারার ব‍্যস্ত রাস্তায়, একটি সবুজ বাতি এবং একটি পাখির ডাক মিলিয়ে শহরের ভিড়ের মধ্যেও মুহূর্তটা তোমার কেমন একান্ত আপন হয়ে গেল তাই না?

৫ অক্টোবর ২০২৫


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)