একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘মিথ্যা’ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা মুহাম্মদ কামাজ্জামান ও মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অকপটেই কথাগুলো বলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দেশের একটি গণমাধ্যমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে তার এই বক্তব্য নিয়ে নানান ধরণের বির্তকের জন্ম দিয়েছে।
কেননা তিনি এই বক্তব্য এমন সময়ে দিয়েছেন যখন বিএনপির সাথে জামায়াতের দা-কুমড়ো সম্পর্ক। কেননা ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে জামায়াতের অনীহা একরোখা মবোভাবের পাশাপাশি নানান ধরনের বক্তব্য মন্তব্যতে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা দলটি সম্পর্কে বলা চলে ভীষণভাবে বিষিয়ে উঠেছে। কখনো সংস্কার কখনো পিআর পদ্ধতি নিয়ে পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি’কে একধরনের কোনঠাসা করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। কারো কারো মতে, এ-কাজটি জামায়াত সফলভাবে করতে ২০২৪ সালে জুলাই ছাত্র আন্দোলনে ইমেজে গড়া এনসিপি’কে সুচারুভাবে কাজে লাগায়। যদিও এনসিপি পরে বুঝতে পারে। এখন অবশ্য বাহির থেকে দৃশ্যমান যে জামায়াতের বিরুদ্ধে এনসিপি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। কিংবা তাদের ইশারায় এনসিপি কানে নিচ্ছে না।
আর ঠিক এই সময়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এ ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির পাশাপাশি এমনকি বিএনপির তরুণ প্রজন্মের নেতাকর্মীরাও অবাক হয়েছে। তাদের মতে, বিএনপি ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দলকে সর্বস্তরের জনগণের কাছে আগের চেয়ে বেশি কাছে নিয়ে গেছে। এর পাশাপাশি এই ইস্যুতে বিভিন্ন দলমতকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। দলমত নিবিশেষে সব পক্ষের মানুষ এখন বিএনপি’কে একটি শান্তির ছায়াতল মনে করে। আর ঠিক তখনই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরে মতো স্বজ্জন রাজনৈতিক ব্যক্তির মুখে জামায়াত প্রীতি রাজনৈতিক অঙ্গনে মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়ার মতোই। কেননা জামায়াতকে এখনো শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীই নয়, বাংলাদেশে চিরাচরিত ধর্মীয় মতাদর্শ, রাজনৈতিক, সামাজিক সংস্কৃতির বিপরীত পক্ষের দল বলে মনে করা হয়। এছাড়া বিএনপি’র মধ্যে এখন যে তারুণ্যের জোয়ারের সমাবেশ ঘটেছে তাতে দেখা যায় যে, এরাও মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিরোধীতাকে মেনে নিতেই পারছে না। এই দলটির আরও অনেক বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বিএনপি’র তরুণরা জামায়াতের সাথে বর্তমান ও ভবিষ্যতে ঐক্য মোটেও মেনে নিচ্ছে না। তারা চায় বিএনপি এখন থেকে প্রকৃত সাচ্চা জাতীয়তাবাদী নেতাকর্মীদের নিয়ে দলকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে।
অন্যদিকে বিএনপি’র জাতীয়তাবাদী আর্দশে বিশ্বাসী বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী এমন কি গণমাধ্যমও বড়ো ধরনের প্রতিরোধ, যড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এবপ্রকার যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যেনো বিএনপি আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা সাচ্চা জাতীয়তাবাদীদের সমাবেশ ঘটানো যায়। আর ঠিক সেসময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুখে জামায়াত নিয়ে এমন মধুর কন্ঠস্বর রাজনৈতিক মহলে দলটির আসল উদ্দেশ্য শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করেনি হোঁচট খাওয়ার মতো অবস্থা বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। তাদের মতে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে নিয়ে এমন দাবি করলে হয়তো তেমন আলোচনার ঝড় তুলতো না। যদিও দলের অন্যতম নীতি-নির্ধারক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার একদিন পরে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বিএনপি নেতারা। তাতে অবশ্যই বলেছিল, তাদের নেতা ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার’ শিকার। তবে সেসময়ে জামায়াতের কোনো নেতার ফাঁসি কার্যকরের পর বিএনপি কঠোর নিরবতাই পালন করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করে। সেই বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান, কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাসেম আলী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড হয়।
এখন কেনো এই বক্তব্য
প্রশ্ন হচ্ছে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শিক প্রশ্নে মুখোমুখির চরম পর্যায়ে দলের মহাসচিবের এমন বক্তব্য সম্পূর্ণ ইউটার্ন নাকি অন্য কিছু তা হয়তবা সময় বলে দেবে। কেননা এই সময়ে তাও আবার পত্রিকাটিকে জামায়াত সমর্থিত স্বীকার করে নিয়ে এমন বক্তব্য দেওয়া কতটা সমচীন তা অনেককে ভাবাচ্ছে। তিনি যখন এধরনের বক্তব্য দেন তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে শোনা যাচ্ছে, বিএনপি বাংলাদেশে সক্রিয়ভাবে হেফাজত ইসলামের সমর্থন নিয়ে আগামীতে নির্বাচন করবেন বলে মোটামুটি চূড়ান্ত। অন্য কোনো বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ইসলামী দলের সাথে বিএনপি ঐক্য করবে না তা-ও চূড়ান্ত। তাই এই সময়ে মির্জা ফখরুলের মুখে জামায়াতের পক্ষের মধুর সুরে কথা বলা বেমানান বলেই মনে করেন অনেকে।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের অন্য ব্যাখ্যা
তবে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে কেউ কেউ অন্যভাবে দেখছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। কেননা সম্প্রতি নীতিনির্ধারক পর্যায়ে চলে আসা বিএনপি’র একজন প্রভাবশালী নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী জামায়াতকে বাদ দিয়ে হেফাজতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামী দলকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে বিষয়টি সফল হয়ে গেলে বিএনপি’তে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটা ঠাওর করতে পেরে কি তিনি জামায়াতের পক্ষ নিয়েছেন কি-না? এমন আওয়াজ আলোচনা জমে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কেননা সম্প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গনে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে প্রথম সারিতে চলে আসা বিএনপি’র ওই প্রভাবশালী নেতার ব্যক্তিগত কারিশমার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কারণে আগামী দিনে তিনি দলের ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে আসছেন বলে শোনা যাচ্ছে।