জাতি তাকিয়ে আছে আগামী ৭ দিনের দিকে


সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ , আপডেট করা হয়েছে : 05-11-2025

জাতি তাকিয়ে আছে আগামী ৭ দিনের দিকে

বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে গত ২ নভেম্বর রোববার বলেছেন, আপনাদের চারপাশে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গুপ্ত স্বৈরাচার কিন্তু ওৎ পেতে রয়েছে। নিজেদের মধ্যে রেষারেষি বিবাদ-বিরোধ এমন পর্যায়ে নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে করে প্রতিপক্ষ সুযোগ নিতে পারে। তারেক রহমানের কন্ঠে যখন নেতাকর্মীরা এই ধরনের বক্তব্য শুনছিলো ঠিক তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান ধরনের কানাঘুষা। কেননা এই তারেক রহমানই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনমনে সংশয় গণতন্ত্রের পথে সংকট তৈরি করতে পারে। নির্বাচনে অপপ্রচার ও অপকৌশল দৃশ্যমান হচ্ছে।’

কেনো এমন আশঙ্কা

তারেক রহমান যখন এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তখন জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। আর সেই উদ্বেগ বর্তমানে মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাঠে সক্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি ২৪ জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার ইমেজে গড়া দল এনসিপি’র মধ্যে সরাসরি কর্কশ বাকবিতণ্ডা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শুধু রাজনৈতিক পর্যায়ে থাকেনি। এটা অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় আদর্শিক জায়গায়ও ধাক্কা দিয়েছে। এখন দেখা যাক বিএনপি’র পক্ষ থেকে কি কি বলা হচ্ছে? 

বিএনপি কি বলছে

সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংসদ নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামী মিথ্যা কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তিনি জামায়াতের নাম মুখে না নিলেও এটা বোঝা যাচ্ছে ওই দলটিতে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন। তিনি বলেন, ‘ওই দলটি বলছে- বিএনপি নাকি নির্বাচন পেছাতে চায়।’ কিন্তু বিএনপি তো নির্বাচনমুখী দল। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বিএনপি নির্বাচনের কথা বলে আসছে। আমরা তো নির্বাচন পেছানোর কথা একবারও বলিনি। আমরা বার বার বলেছি যে, নির্বাচনটা অতি দ্রুত করতে হবে। আমি বলব, এসব মিথ্যা কথা বলে জনগণকে প্রতারণা করবেন না, মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। 

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরে এমন বক্তব্যের মধ্যেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘আমরা মওদুদী ইসলামের অনুসারী নই, আমরা মদিনার ইসলামের অনুসারী। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবারা যে ইসলাম চর্চা করেছেন আমরা সেই ইসলামের অনুসারী। রাজনীতির স্বার্থে ইসলামকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করা কখনো কাম্য নয়।’

জামায়াত কি বললো?

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে বিএনপি’র নেতাদের এধরনের বক্তব্যের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের একটি নতুন তথ্য দিয়ে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনে গিয়ে একটি দলের চাপের মুখে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কোনো চাপে নতি স্বীকার করবেন না।

হাড়ে হাড়ি ভাঙ্গলেন নাহিদ

এদিকে বিএনপি ও জামায়াত নেতারা যখন মিলে মিশে বাকবিতন্ডায় সারাদেশে উত্তাপ ছড়াচ্ছেন তখন হাড়ে হাড়ি ভাঙ্গতে দেখা যাচ্ছে এনসিপি নেতাদের দ্বারা। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জামায়াতের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, তাদের নির্বাচন পেছনোর অভিসন্ধি বা দুরভিসন্ধি আছে। বিএনপি ও জামায়াত গণভোটের তারিখকেই মূল করে দিয়েছে। এক দল সংস্কারকে ভেস্তে দিচ্ছে, আরেক দল নির্বাচনকে পিছিয়ে দিচ্ছে। 

এখন প্রশ্ন পরিস্থিতি আসলে কোন দিকে?

এদিকে রাজনৈদিক অঙ্গনে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ চরমে তখন দেখা গেলো জামায়াতে একটি উদার আহবান। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এই আহবান জানান। এতে তিনি বলেন, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন । তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে কোনো ঝগড়ায় লিপ্ত হতে চায় না। যা-ই করতেছেন এবার বন্ধ করুন। আসুন আমরা একসঙ্গে বসি। কিন্তু দেখা গেছে পরিস্থিতি এর আগেই অনেক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আর এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ৩ নভেম্বর সোমবার জাতীয় ঐক্যমত কমিশন কর্তৃক প্রণীত জুলাই সনদ এবং এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদের একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

বৈঠকে কি হলো...উপদেষ্টা কি বিরক্ত? 

সভায় সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপনের প্রচেষ্টার জন্য এবং বহু বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি ধন্যবাদ জানানো হলেও অনেক বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিরক্ত হয়েছেন বলে শোনা গেছে। আর একারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তাহলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে জানান। আরও বলা হয় যে, সম্ভব হলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এমন দিকনির্দেশনা প্রদান করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সমাধান কোন পথে...কি বলে বিশ্লেষণে

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, উপদেষ্টা পরিষদের একটি জরুরি সভা থেকে যে বলা হলো ‘সম্ভব হলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এমন দিকনির্দেশনা প্রদান করার আহ্বান জানানো হয়েছে।’ - এর অর্থ কি? এর নেপথ্যে কি? জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ কি এরা নিজেদের মধ্যে সমাধান করতে না পারলে কি হবে? কেনো প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় আন্তর্জাতিক ইমেজকে এক্ষেত্রে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না? প্রধান উপদেষ্টা সঙ্কটকালে দায়িত্ব নিতে পারেন বলেই অনেকে তার ওপর আস্থা আছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেই আস্থার জায়গায় কি ফাটল ধরেছে? তা নাহলে কেনইবা প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ড. ইউনূস, আপনি জনগণের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

যেটুকু সংস্কার দরকার, সেটুকু করে নির্বাচন দেবেন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে যে সংসদ হবে, সেই সংসদ সেসব সংস্কার করবে। এর বাইরে গেলে, ব্যত্যয় হলে তার দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে ড. ইউনূসের সরকারকে।’ আবার কেনোই বা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বল্লেন প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনে গিয়ে একটি দলের চাপের মুখে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন..। কেনোইবা জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ স্পষ্ট তখন কেনো আইন উপদেষ্টা এমন আক্ষেপ করলেন, অসহায় বোধ করলেন? বললেন, ‘আপনারা যদি এ রকম ভূমিকা নেন, সরকার কী করবে, আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। 

এত দিন আলোচনার পর যদি ঐকমত্য না আসে, তো আমরা আসলে কীভাবে কী করব, সত্যি আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে। চলমান এমন সঙ্কট যখন ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে বলে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তখন প্রশ্ন জেগেছে জনমনে, ‘কেনো এমন সঙ্কটের সময়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানদের সাক্ষাৎ? এই বিষয়টি নিয়ে-ও সারাদেশে নানান ধরণের কানাঘুষায় দেশ ভারী হয়ে উঠে। ১ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

সন্দেহের আবর্তে আগামী সাত দিন

দেশে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ চরমে এ-টা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন সঙ্কটে অনেকে গত ৩ নভেম্বর সোমবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন এই ভেবে যে দেখা যাক ‘উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা’য় কি আসে? কিন্তু সেখান থেকে আসলে একটি কড়া বার্তাই এসেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। তা-হলো ‘নিজেরা বসেই সমাধান করো’। কারো কারো মতে, এমটাই বৈঠকের ভাষা..। কারো কারো মতে, মাঠে রাজনৈতিক দলগুলি আচরনে প্রধান উপদেষ্টা আর কোনো পদক্ষেপই নিতে চাচ্ছেন না বলে শোনা যাচ্ছে। আর এই কারণে বৈঠক শেষে সাফ জানিয়ে দেয়া হয় যে, গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ‘ঐক্যবদ্ধ সুপারিশ’ দিতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ‘ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত’ নিতে না পারলে সরকার নিজেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি সেই সিদ্ধান্ত আসতে পারে? সোমবারে ‘উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা থেকে যখন এমন আওয়াজ এসেছে তখন স্বভাবতই রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় বইছে কি হবে একসপ্তাহ পরে? একটি সূত্র বলেছে, এমন সঙ্কটে প্রধান উপদেষ্টা আরও কয়েকবারই পড়েছিলেন। একবার শোনা গিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন। আর এমন খবর পেয়ে ওই সময়ে তার সঙ্গে দেখা করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। 

এরপরে আরেকবারের সঙ্কটে তিনি একটি রাজনৈতিক দলের মহাসচিবকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে, ২০২৬ নির্বাচন করতে না পারলে ওই বছরের মার্চের পরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আর দায়িত্বে থাকবেন না। ত-ই অনেকের মধ্যে এখন নানান ধরণের সন্দেহ ঘোরপাক খাচ্ছে কি হতে যাচ্ছে আগামী এক সপ্তাহে..। এদিকে এর মধ্যে মতভেদ কাটাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার যে প্রস্তাব দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ, তাকে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এর পাশাপাশি দলটি আলোচনায় ‘রেফারি’ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টাকে চেয়েছে। তবে এর বিপরীতে নতুন কোনো খবর চোখেই পড়েনি। 

আবার দেশের পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসতে জামায়াতে ইসলামীর আহ্বানেও কোনো সাড়া মিলছে না। প্রশ্ন এখন যে পরিস্থিতি একদিকে টার্ন নিলে কি হবে আগামী সাত দিন পর? পুরো জাতি এখন তাকিয়ে আসে আগামী সাত দিনের দিকেই।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)