টোকিওর এক সকালে আমি আমার ট্যুর গাইড নিকিতাকে বললাম, আমার শহর নিউইয়র্কের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ পিটার লুগার স্টেক হাউস (Peter Luger Steak House)-এর একটি শাখা নাকি তোমাদের টোকিওতেও আছে। আমি সেখানে খেতে চাই। নিকিতা হাসলো, মাথা নেড়ে বললো, অবশ্যই! আমরা জাপানিরা ওই রেস্টুরেন্টকে বলি ‘আমেরিকান স্টেকের মন্দির’। চলো, আজ দুপুরটা সেখানে কাটাই।
নিকিতা আমাকে নিয়ে গেল টোকিওর মিনাতো জেলার অভিজাত এলাকা এবিসুতে (Ebisu)। এখানেই অবস্থিত পিটার লুগার স্টেক হাউস-টোকিও (Peter Luger Steak House ToKzo) নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের আসল শাখার মতোই এখানে রয়েছে একই রকম কাঠের ইন্টেরিয়র, ব্রাউন টোনের আসবাব আর সেই ক্লাসিক আমেজ। জাপানিরা তাদের নিজস্ব শৃঙ্খলা আর সূক্ষ্মতা বজায় রেখে যেন নিউইয়র্কের একটি টুকরোকে তুলে এনেছে এই শহরে।
রেস্তোরাঁর দরজায় প্রবেশ করতেই দেওয়ালে ঝোলানো দেখা যায় ব্রুকলিনের সেই ১৮৮৭ সালের ছবিটি, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল স্টেক কিংবদন্তির গল্প। নিকিতা জানায়, ১৮৮৭ সালে ব্রুকলিনে শুরু হওয়া পিটার লুগার স্টেক হাউস এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে ২০২১ সালে টোকিওয় তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক শাখা খোলে। এই শাখা গড়ে তোলার সময় আমেরিকা থেকে বিশেষভাবে কাঠ, আলো, এমনকি রান্নার গ্রিলও আনা হয়, যেন আসল স্বাদ বিন্দুমাত্র নষ্ট না হয়। এখানে কাজ করেন প্রশিক্ষিত জাপানি শেফরা, যারা নিউইয়র্কের মূল শাখায় গিয়ে স্টেক তৈরির কৌশল রপ্ত করেছেন। রেস্তোরাঁর প্রতিটি ডিশে সে ঐতিহ্যের ছোঁয়া স্পষ্ট।
নিকিতা অর্ডার করল Porterhouse Steak for Two, সঙ্গে Creamed Spinach, German Fried Potatoes, আরেক বাটি গরম Onion Soup। মাংসের প্রথম টুকরো মুখে দিয়েই মনে হলো, যেন আমি আবার ব্রুকলিনে ফিরে গেছি। রসালো মাংস, বাইরের হালকা চার, আর মাঝের লালচে কোমল অংশ- ঠিক সেই ‘মিডিয়াম রেয়ার’ পারফেকশন, যাপিটার লুগারের স্বাক্ষর।
স্টেকের সঙ্গে দেওয়া Luger’s Original Sauce এখনো আগের মতোই। তবে জাপানিরা এর সঙ্গে খায় তাদের নিজস্ব সাকে বা রেড ওয়াইনের হালকা চুমুক দিয়ে এক অন্য রকম রসায়ন। ডেজার্টে ছিল Hot Fudge Sundae নাম শুনে নিকিতা হাসলো, আর বললো এই নামটাই না সবচেয়ে আমেরিকান!
নিকিতা জানায়, টোকিও শাখা খোলার পর থেকেই এখানে ভিড় জমিয়েছেন জাপানের বিনোদন জগতের অনেক নামকরা মুখ। অভিনেতা তাকুয়া কিমুরা, গায়িকা উতাদা হিকারু, এমনকি আন্তর্জাতিক তারকা কিয়ানু রিভস টোকিও সফরের সময় এখানে খেতে এসেছেন। রেস্তোরাঁর একটি দেওয়ালে দেখা যায় তাদের সই করা ছবি। আর পাশে লেখা Good steak knows no borders.
যদিও রেস্তোরাঁটি টোকিওর, কিন্তু তার প্রতিটি কোণে নিউইয়র্কের ছায়া। কাঠের টেবিল, লেদারের চেয়ার, ওয়েটারদের ক্লাসিক ইউনিফর্ম-সবই যেন আমেরিকান ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। তবু জাপানিদের শৃঙ্খলাবোধ, নীরবতা আর সৌজন্য যোগ করেছে এক অন্যরকম পরিশুদ্ধ সৌন্দর্য। নিকিতা বললো, আমরা জাপানিরা প্রতিটি জিনিসের প্রতি সম্মান দেখাতে ভালোবাসি। তাই পিটার লুগারের ঐতিহ্য আমরা কপি করিনি, আমরা সেটিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। খাওয়া শেষে আমরা বেরিয়ে এলাম এবিসুর রাস্তায়। আকাশে সূর্য ডুবে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছিল, দূর নিউইয়র্কের একটুকরো ইতিহাস আজ মিশে গেছে টোকিওর বিকেলে।
আপনারা কেউ যদি টোকিওর এই আমেরিকান রেস্তোরাঁয় খেতে চান, তাহলে ঠিকানাটা টুকে নিন।
ঠিকানা: Peter Luger Steak House ToKzo
Ebisu Garden Place, Minato, ToKzo।
একাকী মৃত্যু ও স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া
জাপান এক দেশ, যেখানে প্রযুক্তি মানব জীবনকে করেছে সহজতর, কিন্তু সম্পর্কগুলো ক্রমে হারিয়েছে উষ্ণতা। এখানে একাকিত্ব কোনো সামাজিক ব্যাধি নয়, বরং জীবনের একটি স্বীকৃত বাস্তবতা। জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বয়স সত্তরের ওপর। অনেকেই থাকেন একা, কোনো পরিবার বা বন্ধুর সংযোগ ছাড়াই। একরুমের ছোট অ্যাপার্টমেন্টে কাটে দিন, আর শেষে ঘটে যায় নীরব এক সমাপ্তি। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ একাকী মারা যান, তাদের মৃত্যুর খবর কেউ জানে না, যতক্ষণ না ঘর থেকে আসে পচে যাওয়া দেহের গন্ধ।
এক সপ্তাহ পর পাশের ফ্ল্যাট থেকে গন্ধ আসে। পুলিশ আসে, দরজা খোলে, আর জানা যায়-এ মানুষটি অনেক আগেই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। জাপানে এই নীরব মৃত্যুকে বলা হয় ‘কোদোকুশি’-একাকী মৃত্যু। একটি সমাজ যেখানে প্রযুক্তি, শৃঙ্খলা ও কর্মব্যস্ততা আছে, কিন্তু সম্পর্কগুলো ক্রমে হয়ে উঠছে দূরবর্তী ও নিঃশব্দ। কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। যখন এসব ঘর অবশেষে খোলা হয়, তখন প্রবেশ করেন আরেক দল মানুষ-সাফাই কোম্পানির কর্মীরা। তারা আসেন না হইচই করতে বরং সম্মান জানাতে। প্লাভস পরে, মাস্ক মুখে, হাতে জীবাণুনাশক নিয়ে তারা প্রবেশ করেন সেই শেষ নিঃস্তব্ধ ঘরে, যেখানে সময় জমে থাকে ধুলোর মতো।
একজন সাফাই কর্মী বলেছিলেন, ‘আমি ঘরে ঢুকি ধীরে, যেন কাউকে জাগিয়ে না তুলি।’ দরজা খুলে যে গন্ধ আসে, তা মৃত্যু নয়, বরং অপেক্ষার গন্ধ। বিছানার পাশে অর্ধেক খাওয়া চা, টেবিলে কিছু পুরোনো চিঠি, দেওয়ালে থেমে থাকা ঘড়ি। ‘আমরা শুধু ঘর পরিষ্কার করি না’, তিনি বলেন, আমরা মানুষের শেষ নিঃসঙ্গতাও মুছে দিই, যেন তার মৃত্যুতে লজ্জা না থাকে।
প্রতিটি ঘরই বলে এক গল্প-ভাঙা ছবিতে দম্পতির হাসি, ডায়েরির পাতায় লেখা অতীত আর এমন এক ভালোবাসা, যা মৃত্যুর পরও বাতাসে রয়ে যায়। কাজ শেষে এই কর্মীরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘ওৎসুকারে সামা দেশু’-অর্থাৎ ‘আপনার পরিশ্রম শেষ হলো।’ সেই মুহূর্তে কাজ হয়ে ওঠে এক প্রার্থনা।
একজন বৃদ্ধ, হিদেকি তানাকা, মৃত্যুর আগে লিখেছিলেন এক চিঠি সাফাই কোম্পানির উদ্দেশে। ‘আমি জানি, আপনারা আসবেন, যখন আমি থাকবো না’, তিনি লিখেছিলেন-দয়া করে ঘরটা পরিষ্কার করবেন, কিন্তু জানালাটা খোলা রাখবেন। এই বাতাসে আমার নিঃশ্বাস আছে, আমি চাই সেটি মুক্ত হয়ে যাক আকাশে। তার ডায়েরিতে ছিল স্ত্রীর জন্য লেখা কিছু চিঠি, যা তিনি কখনো পাঠাতে পারেননি। তিনি অনুরোধ করেছিলেন, ওগুলো ফেলে দেবেন না। ওগুলোতেই হয়তো আমার ভালোবাসা বেঁচে থাকবে। চিঠির শেষে লিখেছিলেন, ঘর ছাড়ার সময় বিছানার পাশে একটি ফুল রেখে যাবেন। আমার স্ত্রী ফুল ভালোবাসতেন।
এই গল্পগুলো শুধু মৃত্যু নয়, জীবনের প্রতিচ্ছবি। জাপানে যেখানে নিঃস্তব্ধতা এখন এক ধরনের সামাজিক বাস্তবতা, সেখানে এই সাফাই কর্মীরাই হয়ে উঠেছেন মানবতার শেষ পুরোহিত। তারা মৃতদেহ নয়, পরিষ্কার করেন এক জীবনের ছায়া, রেখে যান ফুল, প্রার্থনা আর শ্রদ্ধা। জাপানের এই একাকী মৃত্যু নিয়ে কথা বলছিলাম আমার গাইড নিকিতার সঙ্গে। সে জানায়, জাপানে যেমন একাকী মৃত্যু একটা দিক তেমনি আরো একটি দিক রয়েছে তাহলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
কোলাহলে ভরা রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন কত মানুষ আসা-যাওয়া করে। কেউ অফিসে, কেউ স্কুলে, কেউবা নিঃশব্দে কোথাও হারিয়ে যায়। এমন মানুষও আছে যারা নিজ ইচ্ছায় অদৃশ্য হয়ে যায়, একটি ভোর না ফোটার আগেই, কোনো বিদায় না জানিয়ে, কোনো চিহ্ন না রেখে। জাপানি সমাজে এই রহস্যময় ঘটনাকে বলা হয় ‘জোহাতসু’ যার অর্থ ‘বাষ্প হয়ে যাওয়া’। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এভাবে হারিয়ে যায়। তারা মরেনি, আত্মহত্যাও করেনি- কেবল নিজেদের পুরোনো জীবন ছেড়ে পালিয়ে গেছে অন্য কোথাও। নতুন নাম, নতুন শহর, নতুন পরিচয় নিয়ে শুরু করেছে অজানা এক জীবন।
নিকিতা জানায়, এই ‘অদৃশ্য হওয়ার শিল্প’কে কেন্দ্র করে জাপানে গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত ব্যবসা-নাইট মুভার বা ‘ইওনিগেয়া’ নামে পরিচিত। তাদের কাজ, ক্লায়েন্টকে গোপনে স্থানান্তরিত করে দেওয়া। রাতের নিস্তব্ধতায় একটা ট্রাক আসে। কয়েক মিনিটে ঘরের সব জিনিস গুছিয়ে নেয় তারা-জুতো, বই, কাপড়, কখনো একটি ফটোফ্রেমও।
সকালে প্রতিবেশীরা জেগে দেখে-ঘর ফাঁকা, দরজা খোলা, আর সেই মানুষটি যেন কখনোই এখানে ছিল না। এই নাইট মুভার কোম্পানিগুলো নতুন বাসস্থান ঠিক করে দেয়, কাগজপত্র সামলায়, ফোন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিবর্তনে সহায়তা করে। কেউ কেউ আবার বিশেষভাবে গার্হস্থ্য নির্যাতনের শিকার নারী বা ঋতগ্রস্ত পরিবারকে গোপনে পালিয়ে বাঁচার পথ করে দেয়।
নিকিতা বললো, তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে পার কেন মানুষ হারিয়ে যেতে চায়! তার জবাবে বলবো, জাপান প্রযুক্তিতে যতই এগিয়ে থাকুক, সমাজ এখনো গভীরভাবে শৃঙ্খলা, সম্মান ও দায়িত্বের ধারণায় বাধা। এ কাঠামোর ভেতর কেউ ব্যর্থ হলে-চাকরি হারানো, বিবাহ ভাঙা, ঋত পরিশোধে অক্ষমতা, বা পরিবারের চোখে অসম্মান-সে লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে চায় শুধু এক পথেই: অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। আমার হারিয়ে যাওয়াই ছিল বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়-এমন স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে এক প্রাক্তন অফিসকর্মীর সাক্ষাৎকারে, যিনি পাঁচ বছর ধরে নতুন নামে বেঁচে আছেন ওসাকায়।
জাপানে আইনত, প্রাপ্তবয়স্ক কেউ নিজের ইচ্ছায় কোথাও চলে গেলে তা অপরাধ নয়। কিন্তু সমস্যা হয় যখন এতে প্রতারণা, দেনা বা পারিবারিক ক্ষতি জড়িত থাকে।
নাইট মুভার কোম্পানিগুলোর অনেকে গোপনে অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত-মানুষ পাচার, ব্ল্যাকমেইল বা প্রতারণার মতো কর্মকাণ্ডে। তবে একই সঙ্গে মানবিক সংস্থা হিসেবেও অনেকেই কাজ করছে, বিশেষ করে যারা নারীদের সহিংসতা থেকে পালাতে সাহায্য করে। টোকিও, ইয়োকোহামা ও ওসাকার কিছু কোম্পানি এখন এই সেবা প্রকাশ্যে দেয় ‘নিরাপদ পুনর্জীবন’ নামে। মজার ব্যাপার হলো, এই অদৃশ্য হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাপানে এখন একটি ‘গোপন অর্থনীতি’ তৈরি হয়েছে। নাইট মুভার সার্ভিসের খরচ ৫০ হাজার ইয়েন থেকে শুরু হয়ে কয়েক লাখ ইয়েন পর্যন্ত হতে পারে। নতুন শহরে বাসা ভাড়া, নথি বদল, কাজের সন্ধান-সব কিছুতেই খরচ লাগে। এ যেন এক ধরনের ‘অদৃশ্য হওয়ার শিল্প’, যেখানে ব্যবসা ও মানবিকতার সীমা মিশে গেছে। একবার অদৃশ্য হলে অনেকে আর ফিরে আসে না। পরিবার তাদের জন্য নিখোঁজ রিপোর্ট করে, কিন্তু অনেক সময় পুলিশও অনুসন্ধান করে না-কারণ এটি ‘স্বেচ্ছায় নিখোঁজ’ ঘটনা। জাপানে এমন অনেক এলাকা আছে, বিশেষ করে টোকিওর সানইয়া ও ওসাকার কামাগাসাকি, যেখানে এই জোহাতসুরা নতুন জীবন শুরু করে। কেউ হয় শ্রমিক, কেউ দোকানকর্মী, কেউবা কেবল ছায়ার মতো বেঁচে থাকে। জোহাতসুদের গল্প আসলে কোনো রহস্য নয়-এটি আধুনিক জীবনের মানসিক ক্লান্তির প্রতীক। যখন সমাজের শৃঙ্খলা মানুষকে নিঃশ্বাস নিতে দেয় না, তখন নিঃশব্দ অদৃশ্যতাই হয় একমাত্র মুক্তি। কেউ বলে তারা পালিয়ে গেছে। কেউ বলে তারা নতুনভাবে বেঁচে উঠেছে। টোকিওর রাতের শেষ প্রহরে যখন এক ট্রাক অন্ধকার গলিতে গড়িয়ে চলে যায়, কেউ জানে না, তার ভেতরে হয়তো একজন মানুষ নিজের পুরোনো জীবনকে চিরতরে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। আর শহরটি, যেভাবে অভ্যস্ত, তেমনি নিঃশব্দে আবার সকালকে স্বাগত জানায়।
নিকিতা জানায়, সমাজ যত আধুনিক হচ্ছে, মানুষ ততই একা হয়ে পড়ছে-জাপানের ‘জোহাতসু’ সংস্কৃতি আর ‘কোডোকুশি’ বা একাকী মৃত্যুর ঘটনা যেন সেই নিঃশব্দ সত্যের প্রতিচ্ছবি। কেউ নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে যায় পৃথিবী থেকে, কেউ অচেনা ঘরে নিঃসঙ্গতার ভারে হারিয়ে ফেলে শেষ নিঃশ্বাস। দুটো ঘটনাই একে অপরের প্রতিফলন- একদিকে জীবন্ত মানুষের অদৃশ্য হওয়া, অন্যদিকে অদৃশ্য জীবনের মৃত্যু। এই দুই বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, মানুষের ভেতরের নিঃসঙ্গতার গভীরতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। উন্নত নগরজীবন, প্রযুক্তির প্রাচুর্য এবং সামাজিক কাঠামোর যান্ত্রিকতা মানুষকে যে কত নিঃসঙ্গ করে তুলছে, জাপান তার নির্মম উদাহরণ।
তবু শেষ কথা আশারই-সমাজ যদি আবার মানুষের পাশে দাঁড়াতে শেখে, যদি সম্পর্কের বন্ধনগুলোকে পুনরায় উষ্ণ করা যায়, তাহলে হয়তো একদিন কেউ আর ‘অদৃশ্য’ হবে না, কেউ একা মরবে না। মানুষ আবার মানুষকেই খুঁজে পাবে-একটি উষ্ণ হাতের স্পর্শে, একটি ছোট আলাপের ভেতরেই।
ছোট জাপান বড় হৃদয়
প্রায় দুই সপ্তাহ হলো আমি জাপান ভ্রমণে আছি। টোকিও, কিয়োটো, হিরোশিমা, নারা, ইয়োকোহামা-প্রতিটি শহর ঘুরে দেখেছি। গিয়েছি অনেকগুলো দ্বীপে, জাপানের গ্রামাঞ্চলে। দেখেছি জাপানিদের জীবনধারা, তাদের সংস্কৃতি আর সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি তাদের মনোজগত। এ দেশকে প্রথম দেখায়ই চোখে পড়ে অদ্ভুত এক বৈপরীত্য। হোটেলের রুম ছোট, অ্যাপার্টমেন্টের আয়তন ছোট, রাস্তায় ছোট গাড়ি, ছোট চায়ের কাপ, এমনকি মানুষদের উচ্চতাও তুলনামূলকভাবে কম। সবকিছু যেন একেবারেই ছোট আকারের।
কিন্তু এই ছোট্ট বাহ্যিক আয়োজনে লুকিয়ে আছে বিশাল মনের মহত্ত্ব। জাপানিদের বিনয়, সরলতা আর সততা একেবারেই অনন্য। জাপানের ছোট ঘর, ছোট কাপ, ছোট রুমের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল হৃদয়। সেই আন্তরিক হাসি আর অদ্ভুত সরলতাই আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে। ট্রেনে একজন অপরিচিত বৃদ্ধ বসার জন্য আমাকে তার নিজের আসনটি ছেড়ে দিলেন, হারিয়ে গেলে এক ছাত্র হাতে মানচিত্র নিয়ে সাহায্য করলো, কিংবা কোনো দোকানদার হাসিমাখা মুখে ‘আরিগাতো’ বললো, সবই যেন তাদের হৃদয়ের দরজা খোলার প্রতীক। কিয়োটোর এক রেস্টুরেন্টে আমি যখন ভেজ মেনুর কথা বললাম, কর্মীরা সবটুকু আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করলেন যেন আমি অস্বস্তিতে না পড়ি। হিরোশিমার এক ট্যাক্সি চালক, ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠলো বেদনামাখা ইতিহাসের ছাপ। নারার পার্কে এক শিশু তার বিস্কুট ভাগ করে দিল, শুধু আমার হরিণকে খাওয়ানোর আনন্দ দিতে। এই কদিন জাপান ঘুরে আমার কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো-বাইরের আকারে বড় হওয়া জরুরি নয়। মানুষের ভেতরের মহত্ত্বই আসল। সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়, জাপান এক অদ্ভুত দেশ। এখানে জিনিসপত্র ছোট, জায়গা ছোট, কিন্তু মানুষের হৃদয় সমুদ্রের মতো গভীর। তারা যতটা বিনয়ী, ততটাই সৎ; যতটা সরল, ততটাই আন্তরিক।
আমার চোখে এ দেশটা যেন এক অনন্য শিক্ষা-বাইরের আকারে বড় হওয়া জরুরি নয়, ভেতরের মহত্ত্বই আসল। জাপান আমাকে শিখিয়েছে, ছোট ছোট হাসিই পারে অচেনা মানুষকে আপন করে নিতে। আর সেই উষ্ণ হাসিই এবার জাপান ভ্রমণে আমার সবচেয়ে বড় উপহার।
বিনয়ে মোড়া জাপান
জাপান ভ্রমণের দিনগুলো আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। টোকিওর ঝলমলে আলো থেকে শুরু করে হিরোশিমার নীরব স্মৃতিস্তম্ভ, কিয়োটোর বাঁশবন থেকে মিয়াজিমা দ্বীপের সাগর-প্রতিটি দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি আমাকে নাড়া দিয়েছে একটি বিষয়-জাপানিদের বিনয়। টোকিওতে প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে একই অভিজ্ঞতা-ভিড় থাকলেও ধাক্কাধাক্কি নেই, কণ্ঠ উঁচু করে কথা নেই। সাবওয়ে কিংবা শিনকানসেন, সবখানেই মানুষ যেন নীরব স্রোতের মতো চলে। জাপানে আমার দুই সপ্তাহ যেন কেবল শহর থেকে শহরে ভ্রমণ নয়, ছিল মানুষকে নতুনভাবে দেখার এক অভিজ্ঞতা। টোকিওর ঝলমলে আলো, কিয়োটোর মন্দির, নারার হরিণ, হিরোশিমার নিস্তব্ধতা, মিয়াজিমা দ্বীপের সমুদ্রের গর্জন কিংবা মাউন্ট ফুজির গম্ভীর মহিমা-প্রতিটি জায়গায় আমি দেখেছি এক অদৃশ্য আলোকরেখা। আর সেই আলো হলো জাপানিদের বিনয়।
টোকিওতে যখন ভিড়াক্রান্ত সাবওয়েতে নেমেছিলাম, তখন প্রথম অনুভব করলাম এই বিনয়ের স্বাদ। ঠাসাঠাসি ভিড়েও কেউ কণ্ঠ উঁচু করে না, কেউ ধাক্কা দেয় না। সবাই যেন নীরব স্রোতের মতো এগিয়ে চলে আর প্রতিটি স্টেশনে আমি যেন শুনি এক সুরেলা শব্দ-আরিগাতো। একদিন সুমিদা নদীর ক্রুজে উঠলাম। শহর তখন পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছি আমি আর নদীর বুক চিড়ে উঠে আসা বাতাসে ভেসে এলো টোকিও স্কাই ট্রির প্রতিচ্ছবি। নৌকায় থাকা জাপানিরা একে অপরকে জায়গা করে দিলেন, জানালার পাশে বসতে দিলেন আমাকেও। মনে হলো, এই বিনয় নদীর স্রোতের মতোই চিরন্তন।
কিয়োটোতে, বাঁশবনের নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এক বৃদ্ধা আমাকে ধীরে ধীরে পথ দেখালেন। তার চোখে মমতার হাসি, ঠোঁটে শান্ত স্বর, মনে হলো প্রকৃতির মতোই মানুষের বিনয়ও এই শহরের অলংকার। নারায়, মুক্ত হরিণের মাঝে দাঁড়িয়ে যখন বিস্ময়ে চারপাশ দেখছিলাম, স্থানীয় এক বালক আমাকে হাতে করে বিশেষ বিস্কুট দিলো, হরিণকে খাওয়ানোর জন্য। যেন সে বললো, অতিথি আপনি, আনন্দ ভাগ করে নেওয়াই আমাদের আনন্দ।
হিরোশিমায় পা রাখতেই অন্যরকম অনুভূতি। পারমাণবিক বোমার স্মৃতি বহন করা শহরটির মানুষদের চোখে দেখেছি এক অদ্ভুত প্রশান্তি। শান্তির স্মৃতিস্তম্ভের সামনে তারা যে নীরব অভিবাদন জানান, তা কেবল মৃতদের প্রতি নয়, জীবনের প্রতিও এক বিনম্র শ্রদ্ধা। মিয়াজিমা দ্বীপে বিশাল তৈরি গেট যখন জোয়ারের পানিতে ভাসতে থাকে, আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। পাশে দাঁড়ানো এক জাপানি পরিবার তাদের ছাতা আমার দিকে এগিয়ে দিলো বৃষ্টির ফোঁটা থেকে বাঁচাতে। বিনয়ের এই ক্ষুদ্র মুহূর্তটাই দ্বীপের সৌন্দর্যের চেয়েও বড় হয়ে উঠলো।
কোবে শহরের সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে দেখলাম সূর্যাস্ত। আকাশ যখন আগুনের মতো লাল, তখনো চারপাশের মানুষ শান্ত, পরস্পরের দিকে বিনয়ের হাসি ছুড়ে দিচ্ছে। ওসাকার জনবহুল রাস্তায়, লণ্ঠনের আলোয় ঘেরা দোকানে যখন তাকোয়াকি খাচ্ছিলাম, দোকানদার মহিলা দুহাত জোড় করে মাথা নত করে আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। মনে হলো, খাবারের স্বাদে যেমন উষ্ণতা, তেমনি মানুষটির বিনয়েও আছে এক মায়াময় সৌন্দর্য।
ফুজির পাদদেশে দাঁড়িয়ে যখন তাকালাম মহিমান্বিত পর্বতের দিকে, তখন মনে হলো- পর্বত যেমন উঁচু হয়েও বিনয়ে অবনত, তেমনি জাপানের মানুষও জীবনে সাফল্যের শিখরে থেকেও হৃদয়ে ধরে রেখেছে সরলতা। লেক আশির জলে ভেসে সেই বিনয়ের প্রতিচ্ছবিই আমি দেখেছি। টোকিওর জার্মান ভিলেজে আলো-ঝলমলে রাত আমাকে রূপকথার মতো মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু আলোয় নয়, মানুষের উষ্ণ সৌজন্যে রাতটা হয়ে উঠেছিল অনন্য।
জাপান আমার কাছে কেবল একটি ভ্রমণের দেশ নয়, বরং এক জীবন্ত পাঠশালা। এখানকার প্রতিটি নাগরিক যেন শেখায়-শ্রদ্ধা, সৌজন্য আর বিনয়ই মানুষের আসল পরিচয়।
টোকিও থেকে এনোশিমা
টোকিওর এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে আমি আর আমার জাপানি ট্যুর গাইড নিকিতা রওনা হলাম এনোশিমা দ্বীপের পথে। শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে মনে হচ্ছিল যেন আমরা এক নতুন জগতে যাত্রা করছি। শিনজুকু স্টেশন থেকে আমরা উঠলাম ওদাকিউ লাইন ট্রেনে। জানালার পাশে বসে দেখতে লাগলাম-টোকিওর আকাশচুম্বী ভবনগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট শহর আর সবুজ উপত্যকায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছলাম কাতাসে-এনোশিমা স্টেশনে। স্টেশন থেকে নামতেই মুখে লাগল নোনা হাওয়া। দূরে দেখা গেল প্রশান্ত মহাসাগর, তার নীল জল সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। নিকিতা হাসতে হাসতে বললো, এনোশিমা মানেই জাপানের সাগর-রোমান্স।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পা রাখলাম এনোশিমা ব্রিজে। সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে মনে হলো-আকাশ আর সমুদ্র যেন একে অপরকে জড়িয়ে আছে। বাতাসে ঢেউয়ের গর্জন, পাখিদের ডাকে এক অসাধারণ সুর তৈরি হচ্ছিল। দ্বীপে ঢোকার পর দেখি সরু গলিপথে দোকান আর খাবারের স্টল। কেউ বিক্রি করছে গ্রিল করা অক্টোপাস, কেউ আইসক্রিম। নিকিতা আমাকে নিয়ে গেল এনোশিমা শ্রাইন দেখতে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই ছোট ছোট ঘণ্টা, কাঠের প্রার্থনা ফলক আর হালকা ধূপের গন্ধে এক শান্ত পরিবেশ। এরপর আমরা উঠলাম এনোশিমা সি ক্যান্ডেলে, দ্বীপের অবজারভেশন টাওয়ারে। ওপরে গিয়ে দেখি চারদিকে শুধুই নীল সমুদ্র, দূরে মেঘের আড়ালে ফুজি পর্বত। নিকিতা মুগ্ধ হয়ে বললো, এই দৃশ্যটাই জাপানের আত্মা।
বিকালে আমরা সমুদ্রতটে বসে খেলাম স্থানীয় সি-ফুড ডনবুরি-তাজা মাছ, চিংড়ি, ভাত আর সামান্য সস। ঢেউয়ের শব্দ আর নোনতা বাতাসের মধ্যে সেই খাবারের স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। দিনের শেষে সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়লো, আমরা আবার ব্রিজের ওপর দাঁড়ালাম। আকাশ তখন কমলা আর গোলাপি রঙে রাঙা। নিকিতা মৃদুস্বরে বললো, এনোশিমার সূর্যাস্ত একবার দেখলে তা কখনো ভোলা যায় না।
টোকিও ফেরার ট্রেনে বসে মনে হচ্ছিল, আজকের দিনটা যেন এক রঙিন স্বপ্ন। প্রকৃতি, সংস্কৃতি, বন্ধুত্ব আর শান্তির মেলবন্ধন। এনোশিমা থাকবে আমার মনে চিরকাল নীল আকাশের নিচে, ঢেউয়ের মৃদু সুরে।