বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ একটি বহুল প্রচারিত গণমাধ্যমে তার মতামত জানাতে গিয়ে বলেছেন, যদি যেকোনো ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা আলোচনা করতে চান, আহ্বান করেন, আমরা যাব। এখন সনদ বাস্তবায়নের দাবি কেন রাজপথে যাবে? সালাহউদ্দিন আহমদ যখন এই কথা বলছেন তখন রাজপথেই নেমেছে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দফা দাবিতে ১১ নভেম্বর মঙ্গলবার রাজধানীতে এই সমাবেশ করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ভেতরে-বাইরে যে একটা অশ্বস্তি ভাব লক্ষ্য করা গেছে, তেমনি বড়ো দল হিসাবে বিএনপি’র মধ্যে আছে প্রচন্ড ক্ষোভ। আর এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে বিএনপি’র মহাসচিবের বক্তব্যেও। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরাসরি একটি দলের নাম উল্লেখ করেই বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন অজুহাত তুলে দেশকে একটা অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই বলা চলা চলে এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসলে হচ্ছে কি? কে কার হয়ে খেলছে? কার পেছনে কি শক্তি, এর শেষ-ই বা কি...।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট-ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াত বলা যায় মুখোমুখি। এখন দেখা যাক বিভিন্ন সূত্রের খবরে কি বলে? কেনো আসলে এই বিরোধ বা মুখোমুখি অবস্থান? এই বিরোধে কে বাতাস-ইবা দিচ্ছে কারা বা দিতে পারে?
কারো কারো মতে, এসব কিছুই এক ফুৎকারে নিভে যাবে যদি বিএনপি একটি সোহাগ করে একেবারে জামায়াতকে কাছে টেনে নেয়। এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি সংসদীয় আসনে বিএনপি ছাড় দিলেই জামায়াতের সুর পাল্টে যাবে। তবে রাজনৈতিকভাবে এসব পুরোনো তত্ত্বই বলে মনে করা হয়। তারপরেও একটি সূত্রে জানা গেছে জামায়াতের আরেকটি শর্ত হচ্ছে কোনোভাবেই ২৪’এর জুলাই বিপ্লবীদের নেতৃত্বদানকারী দল এনসিপির কাউকে নিয়ে বিএনপি কোনো ধরনের সমঝোতা যেনো না করে।
জামায়াত চায় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের চাবি যেনো তাদের হাতে থাকে। আর এসব আশ্বাসে জামায়াত মাঠ গরম করে দ্রুত নির্বাচনের দাবির কাতারেই থাকবে। এই সূত্রের যুক্তি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পরপর জামায়াত প্রথমে চেয়েছিল একটি জাতীয় সরকার গঠনে। বিএনপি কারণে জামায়াতের এই পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। কারণ বিএনপি মনে করে জামায়াত জাতীয় সরকারের দাবির পেছনে অন্য হিসাব কাজ করেছে। জামায়াত এই ধরনের প্রস্তাবের কথা বলে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বাগিয়ে নিয়ে প্রশাসনে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতেই জাতীয় সরকারের আওয়াজ তুলেছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াতের এই পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে বিএনপি’কে বিপদে ফেলতে দলটি দ্রুত নির্বাচন নয়, সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে। কিন্তু বিএনপি একের পর পর কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে অন্তর্বতী সরকার দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। সূত্রটির মতে জামায়াত যদি সত্যিকারের সংস্কার চাইতো তাহলে শুধুমাত্র এই দাবিতে স্থির থাকতো, কিন্তু এতে তারা আপোষহীন হয়নি। আর এরপরেও একের পর এক দাবি জানিয়ে মাঠে এগুতো না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট-এই ইস্যুতে জামায়াত মুখোমুখি অবস্থান নিতো না। তা-ই কারো কারো মতে, বিএনপি জামায়াতের দাবি মেনে নিয়ে এবং এর পাশাপাশি দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সাথে একটি প্রকাশ্য বৈঠক করতে পারলেই দলটির মতের অনেক পরিবর্তন আসতো।
জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে
তবে ভিন্ন একটি সূত্র জানায় মাঠে অস্থিরতা তৈরি করে আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাছে লাগিয়ে কোনো একটি বহিঃশক্তির কৌশলকে ব্যবহার দলটি নতুন করে একটি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এক্ষেত্রে কারো কারো মতে, জামায়াত এই চেষ্টা শুরু করে মাঠের অন্য একটি ইসলামী দলকে সাথে নিয়ে। কিন্তু ওই দলটি জামায়াতের পরিকল্পনা টের পেয়ে দূরে সরে যায়। এজন্য জামায়াত এখন ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে না। তারা আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাছে লাগিয়ে এগুতো চায়। তাদের কাছে উদারহন হচ্ছে ভারত আফগানিস্তানে তালেবানদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
এপক্ষের যুক্তি হচ্ছে আফগানিস্তান থেকে ২০২১ সালের আগস্টে বিশৃঙ্খলভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের করে নেয়। এতে করে সেখানে তালেবান ক্ষমতায় চলে আসে। অথচ তখন ভারত-ও বাধ্য হয়ে তার দূতাবাস দ্রুত বন্ধ করে কূটনীতিক ও নাগরিকদের সরিয়ে নেয়। কিন্তু সে-ই ভারত এখন তালেবানকে খাতির করছে। কিন্তু কেন ভারত এই খাতির করছে?
বিশ্লেষকদের মতে, আফগানিস্তানের পাশাপাশি এই অঞ্চলে পাকিস্তানের প্রভাব ঠেকাতে ভারত তালেবানদের কাছে টেনে নিয়েছে, তার দেশের স্বার্থেই। কারো কারো মতে, তালেবানদের পেছনে ভারতের এমন সহায়তা পাওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের মর্ধ্যে সীমান্তে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। কারো মতে, এই তত্ত্বকে ভিত্তি মেনেই জামায়াত বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের শাসনভার তাদের হাতেই চলে আসছে কিংবা পাওয়ার ব্যাপারে জন্য নিশ্চিত হয়েছে?
নাকি আওয়ামী কানেকশান
কারো কারো মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট-এই ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানে সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগই লাভবান হবে। তাদের মতে, কোনো একটি পক্ষ হয়তবা চায় দেশের ভেতরে এসব ইস্যুতে সংঘাত সংর্ঘষ প্রাণহানি ঘটলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়তবা নির্দিষ্ট সময়ে হবে না বা আদৌও হবে কি-না তা নিয়ে দেশে একটি অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। আর এতে পুরো লাভের ভাগিদার হবে পতিত আওয়ামী লীগ-ই।
তাদের মতে, ধরে নেয়া যাক অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন করে ফেললো। আর তাতে দেখা গেলো গণভোটেই গণজোয়ার-তো দূরে থাক ভোটার উপস্থিতি কম দেখা গেলো। এমন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও অন্তর্বতী সরকারকেই ভোটের আগেই বিতর্তিক করে ফেলা হলো। তাহলে সেক্ষেত্রেও হিসাব কসলে কার লাভ হবে?
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কার পালে কে হাওয়া দিচ্ছে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, আসলে কার খেলায় কে হাওয়া দিচ্ছে? নেপথ্যে কার ইশারা যা বুঝতে একটি সময় নিবেই। কারণ মূল খেলোয়াড়-রা দেশে এখন আফটার শক- নিয়ে ভাবছেন..।