টোকিওর ব্যস্ত নগরজীবনের মাঝেই আছে এক ছোট্ট কোণ, যেখানে বাতাসে ভেসে আসে বিরিয়ানির গন্ধ, দোকানের সাইনবোর্ডে ঝুলে থাকে বাংলা অক্ষর, আর আজানের ধ্বনি মনে করিয়ে দেয় নিজের দেশকে। জায়গার নাম-‘লিটল ঢাকা’। লিটল ঢাকা বলতে মূলত হিগাশি জুজো (Higashijujo) ও জুজো (Jujo) এলাকাকে বোঝায়, যা টোকিওর কিতা সিটি (Kita City) জেলায় অবস্থিত। টোকিও স্টেশন থেকে JR লাইনে উঠলে মাত্র ২০-২৫ মিনিটে আপনি পৌঁছে যাবেন হিগাশি জুজো স্টেশনে। সেখান থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই চোখে পড়বে সেই প্রাণবন্ত বাংলাদেশি পাড়া।
এলাকার কেন্দ্রেই রয়েছে মদিনা মসজিদ, টোকিও। চারতলা ভবনের এই ছোট্ট মসজিদটি স্থানীয় বাংলাদেশি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, শুক্রবারের জুমা, এমনকি ঈদের নামাজেও এই মসজিদে উপচে পড়ে ভিড়। মসজিদের নিচতলায় রয়েছে ছোট্ট ওজুখানা আর মহিলা নামাজিদের জন্য আলাদা জায়গা। লিটল ঢাকায় ঢুকলেই নজর কাড়বে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর সারি। প্রিন্স ফুড কর্নার, ঢাকা কাবাব হাউস, সুলতান ডাইন, টোকিও-নামগুলো শুনলেই বুঝবেন আপনি বাংলাদেশেই আছেন! এখানে গরম খিচুড়ি, চিকেন বিরিয়ানি, বেগুন ভাজি, চা আর সন্দেশ-সবই পাওয়া যায় ঘরোয়া স্বাদে। রান্নার ঘ্রাণ আর দোকানের টিভিতে চলতে থাকা বাংলা গান যেন টোকিওর মাঝে এক মুহূর্তে আপনাকে ফিরিয়ে নেয় ঢাকার মোহাম্মদপুর বা মিরপুরে। রাস্তায় হাঁটলেই চোখে পড়বে বাংলা ভাষার সাইনবোর্ড-হালাল মার্কেট, ঢাকা স্টোর, বাংলাবাজার।
এখানে ব্যবসারত বাংলাদেশিরা খুবই আন্তরিক। হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাবে। আর হয়তো চা-নাশতা অফার করবে। প্রবাসে বাঙালি মাত্রই স্বজন এ কথাটা তারা নতুন করে প্রমাণ করে। এখানকার গ্রোসারিগুলোতে পাওয়া যায় দেশি মসলা, শুঁটকি, চাল-ডাল, মাছ, কচুর লতি, শিমের বীচি থেকে বাংলাদেশি লাল-সাদা স্যান্ডেল পর্যন্ত।
লিটল ঢাকা শুধু ব্যবসার জায়গা নয়, এটি বাংলাদেশি সংস্কৃতি ও জাপানি সমাজের এক সুন্দর সহাবস্থান। ঢাকা বিক্রমপুরের বাসিন্দা গ্রোসারি স্টোরের মালিক আলী আমজাদ জানান, ১৯৯০-এর দশকে কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। আজ সেই ছোট্ট গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে একটি উষ্ণ কমিউনিটি-যেখানে নামাজের পর হাসিঠাট্টা, খাবারের টেবিলে গল্প আর ঈদের দিন একসঙ্গে মিলনমেলা ক্ষডুকের জন্য হলেও প্রবাসের দুঃখ-বেদনা ভুলিয়ে দেয়।
টোকিওর লিটল ঢাকা শুধু একটি এলাকা নয়, এটি প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশের গন্ধ মেলে ধরার এক আবেগময় ঠিকানা। যদি কখনো জাপানে গিয়ে দেশের স্বাদ, ভাষা, আর মানুষকে মিস করেন, তাহলে চলে যান হিগাশি জুজোতে। সেখানে পাবেন এক টুকরো ঢাকা, ঠিক টোকিওর বুকের ভেতরে।
ফুজির কোলে নিরাময়ের গ্রাম
টোকিওর কোলাহল পেছনে ফেলে এক সকালে আমি আর গাইড নিকিতা রওনা দিলাম ফুজি পর্বতের দিকে। শিনজুকু স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতেই নিকিতা হাসিমুখে বলল, আজ তোমাকে এমন একটা গ্রামে নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুমি আমাকে ধন্যবাদ দেবে। তখনো জানতাম না কত শান্ত আর নান্দনিক এক জায়গা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। নিকিতা জানায়, জাপানি ভাষায় Iyashi no Sato Nenba, অর্থ- ‘নিরাময়ের গ্রাম’। আর আমি আজ তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি ওখানেই। ট্রেনের জানালার বাইরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল শহরের ব্যস্ততা। জায়গা নিলো সবুজ পাহাড়, চেরি ফুলে ভরা গাছ আর ছোট ছোট কাঠের ঘর। প্রায় দুই ঘণ্টা পর পৌঁছলাম Kawaguchiko স্টেশনে। সেখান থেকে ছোট্ট Omni Bus-এ উঠলাম আমরা। গন্তব্য Iyashi no Sato Nenba।
রাস্তার দুপাশে Kawaguchiko-এর নীল জল, দূরে সাদা বরফে ঢাকা Mount Fuji, মনে হচ্ছিল যেন ভিউকার্ডের ছবি দেখছি। নিকিতা জানালো, এই গ্রামটা একসময় সাধারণ কৃষকদের গ্রাম ছিল। ১৯৬৬ সালের টাইফুনে ধ্বংস হয়ে যায় পুরো এলাকা। পরে এটাকে আবার গড়ে তোলা হয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়লো পুরোনো বাড়ি, বাঁশের বেড়া, কাঠের জানালা-সবই জাপানের প্রাচীন দিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। একটা ঘরে ঢুকে দেখি স্থানীয় এক বৃদ্ধা বাঁশের পাখা বানাচ্ছেন। তিনি আমাকে দেখাচ্ছিলেন, হাতে বানানো শিল্পকর্ম। আর নিকিতা তা অনুবাদ করে দিচ্ছিল। বৃদ্ধা হাসিমুখে বললেন, এই গ্রাম আমাদের ইতিহাস, তোমরা পর্যটকরা আমাদের নতুন জীবন। প্রতিটি ঘরকে মনে হচ্ছিল যেন একেকটা ছোট জাদুঘর। কোথাও আছে কিমোনো ভাড়ায় পরার সুযোগ, কোথাও মৃৎশিল্পের দোকান, আবার কোথাও পুরোনো কৃষিযন্ত্র।
নিকিতা বললো, তুমি চাইলে এখানে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ছবি তুলতে পারো। ফুজি পর্বতের পটভূমিতে সেটা দারুণ লাগবে। আমি পরলাম হালকা নীল কিমোনো, হাতে নিলাম কাগজের ছাতা-দূরে ফুজির বরফে মোড়া শিখর। ক্যামেরার ক্লিকে এক চিরস্মরণীয় মুহূর্ত বন্দি হয়ে গেল। গ্রাম থেকে থেকে ফুজি পর্বত দেখা যায় এমনভাবে, যেন পর্বতটি গ্রামেরই অংশ। নিকিতা জানায়, বিকেলের আলোতে পুরো গ্রাম রঙ বদলায়, সোনালি সূর্যের ছোঁয়ায় ঘরগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
আমি তাকে বললাম, এমন শান্ত জায়গা আমি আগে দেখিনি। সে হাসলো। নিকিতার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ প্রান্তে লেকের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। চারপাশে নরম বাতাস, পাখির ডাক আর ফুজি পর্বতের নীরব উপস্থিতি। ভাবছিলাম সত্যিই, এই জায়গা যেন ক্লান্ত মনকে নিরাময় করে দেয়, হয়তো এজন্যই এর নাম Iyashi no Sato, অর্থাৎ Healing Village বা নিরাময়ের গ্রাম।
ভোরের শহরে সমুদ্রের গন্ধ
ভোর ৩টা। টোকিওর রাস্তায় তখনো অন্ধকারের নরম ছায়া। শহর ঘুমিয়ে, কিন্তু একটা জায়গা তখন জেগে ওঠে সমুদ্রের প্রাণ নিয়ে, সুকিজি মাছের বাজার। গাইড নিকিতা আগেই বলে দিয়েছিল ওখানে যেতে হলে সূর্য ওঠার আগেই প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি আর নিকিতা টোকিও মেট্রো ধরলাম। গন্তব্য Tsukiji Station, হিবিয়া লাইনের ছোট্ট এক স্টপ। ট্রেনের জানালার বাইরে দেখা যাচ্ছিল ভোরের নরম আলোয় ভেজা রাস্তা, কোথাও কোথাও দোকানের শাটার খুলছে, গরম স্টিমে ভাসছে ভোরের প্রথম রামেন দোকান।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে যখন হাঁটছি, তখন বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ-সমুদ্র আর তাজা মাছের মিশ্রণ। সুকিজি বাজারের প্রবেশদ্বারে পৌঁছাতেই যেন অন্য এক জগত! সারি সারি দোকান, বিক্রেতাদের ডাক, আর বরফে ঢাকা বিশাল টুনা মাছ চোখে পড়ে। বাজারের মূল আকর্ষণ ভোরের টুনা নিলাম, যা সকাল ৫টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তবে সকাল ৮-৯টার দিকেও জায়গাটা জমজমাট-সুশির দোকানে পর্যটকদের ভিড়, জাপানি ছুরি বিক্রেতাদের ব্যস্ততা, আর ফ্রেশ সি-ফুডের রঙিন জগত।
আমরা পৌঁছলাম ভোর ৫টার আগে। একটা বিশাল গুদামঘরের মধ্যে বরফের ওপর সারি সারি টুনা মাছ সাজানো। প্রতিটি মাছ যেন বরফের ভাস্কর্য। নিলাম শুরু হতেই ঘণ্টা বাজল। নিলামকারীরা অদ্ভুত সুরে ডাকতে লাগলো দাম। নিকিতা জানালো একটা ব্লুফিন টুনা কখনো এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দামে বিক্রি হয়! নিকিতা জানায়, সুকিজি বাজারের ইতিহাস শুরু ১৯৩৫ সালে। তৎকালীন টোকিও শহরের মাছ ব্যবসা একত্রে সংগঠিত করার জন্য সরকার এই বিশাল বাজার তৈরি করে। এরপর প্রায় ৮০ বছর ধরে এটি বিশ্বের বৃহত্তম সামুদ্রিক খাবারের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। প্রতিদিন এখানে প্রায় দুই হাজার টন মাছ কেনাবেচা হয়। বাজারে কাজ করে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ-মাছ বিক্রেতা, শেফ, নিলামকারী, আর নানা দেশের পর্যটক।
নিলাম শেষ হলে শুরু হয় বাজারের আসল ব্যস্ততা। ছোট ছোট রিকশা আর ট্রলি দৌড়াচ্ছে চারদিকে, কেউ মাছ কাটছে, কেউ বরফ ভাঙছে, কেউ গ্রাহক টানছে। তাজা অক্টোপাস, লবস্টার, সালমন, স্কুইড, টুনা-প্রতিটি স্টল যেন একেকটা ক্ষুদ্র সমুদ্র।
নিকিতা বলল, চলো, আজ তোমাকে আসল জাপানি প্রাতঃরাশ খাওয়াই। বাইরে তখন সূর্য উঠেছে।জেগে উঠেছে শহর।আমরা ঢুকলাম বাজারের পাশের একটি পুরনো সুশি রেস্টুরেন্টে- Sushi Dai। শেফ আমাদের চোখের সামনে টুনা স্লাইস করে সুশি বানালো। মুখে দিলেই গলে গেল সেই সজীব সমুদ্রের স্বাদ। নিকিতা জানায়, ২০১৮ সালে মূল পাইকারি বাজারটি টোকিওর টয়োসু এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। তবে পুরনো সুকিজি এলাকা এখনও জীবন্ত- এখানে এখনো খোলা আছে শত শত ছোট রেস্টুরেন্ট ও দোকান, যেখানে পর্যটকরা আসে আসল টোকিওর স্বাদ খুঁজে নিতে।
টোকিও থেকে ওসিমা দ্বীপে
টোকিও শহরটি কখনো ঘুমোয় না। আকাশচুম্বী অট্টালিকা, আলোর ঝলকানি, রেললাইনের শব্দ আর মানুষের অন্তহীন ভিড়-সবকিছু মিলিয়ে দিন আর রাত যেন একসঙ্গে দৌড়ায়। এই শহরে প্রায় এক সপ্তাহধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। গাইড নিকিতাকে বল্লাম, এই ইট পাথরের শহরে যেন নিঃশ্বাস আটকে আসছে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও শহরের বাইরে গিয়ে প্রকৃতির কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ শ্বাস নিতে চাই। নিকিতা হেসে বল্লো- তাই হবে।
পরদিন সকালে আমরা দু’জন রওনা হলাম ওশিমা দ্বীপের পথে। টোকিওর অদূরেই অবস্থিত এক আগ্নেয় দ্বীপ, যাকে বলা হয় ইযু দ্বীপপুঞ্জের রানি। টোকিও থেকে ফেরিতে দেড় ঘন্টার পথ। টোকিওর আকাশে তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। আমরা দু’জন পৌঁছে গেলাম তাকেশিবা পিয়ারে। পিয়ারে পৌঁছে ফেরিতে উঠতেই মনে হলো আমি যেন শহর থেকে ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যাচ্ছি।
ফেরি ছুটে চললো প্রশান্ত মহাসাগরের বুক চিড়ে। বাতাসে নোনতা গন্ধ, ঢেউয়ের ছন্দ আর আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘ, মুহূর্তেই মন ভরে গেল। কখনো ডলফিনের ছায়া চোখে পড়ল, কখনো দূরে ভেসে থাকা জেলেদের নৌকা। টোকিওর উঁচু টাওয়ার আর অট্টালিকা ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল, আর সামনে খুলে গেল এক অবারিত নীল দিগন্ত। মাত্র দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম সেই জাদুকরী দ্বীপ-ওশিমায়। দ্বীপে নামতেই মনে হলো অন্য এক জগতে চলে এসেছি। শহরের কোলাহল নেই, শুধু সমুদ্রের শব্দ আর পাহাড়ের ছায়া। আমরা যাত্রা করলাম মিহারা পর্বতের দিকে-এটি একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। ইতিহাসে এই আগ্নেয়গিরির নাম বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। এর উদগীরণ বদলে দিয়েছে দ্বীপের ভূগোল আর মানুষের জীবনে এনেছে নতুন গল্প। ইতিহাস বলে, ১৯৮৬ সালে মিহারা এত প্রবল অগ্ন্যুৎপাত করেছিল যে টোকিও থেকেও লাভার আলো দেখা গিয়েছিল। দ্বীপবাসীরা এখনো সেই স্মৃতি বুকে ধরে রেখেছে।
আমরা পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে মিহারার চূড়ার দিকে উঠতে লাগলাম। কালো আগ্নেয় শিলা, উষ্ণ ধোঁয়ার রেখা আর চারপাশের সবুজ প্রকৃতি যেন পৃথিবীর আদিম সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। চূড়ায় পৌঁছে সমুদ্রের অসীম বিস্তার আর দ্বীপের সবুজ উপত্যকার মেলবন্ধন দেখে নিঃশ্বাস আটকে গেল। মনে হলো আমি প্রকৃতির এক অনন্ত নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি। নিকিতা জানায়, ওশিমা শুধু আগ্নেয়গিরির জন্যই নয়, এটি ক্যামেলিয়া ফুলের জন্যও বিখ্যাত। প্রতি বছর শীতকালে এখানে আয়োজন হয় ওশিমা ক্যামেলিয়া ফেস্টিভ্যাল, যেখানে হাজারো লাল-সাদা ফুল দ্বীপকে রঙে ভরিয়ে তোলে।
পাহাড় থেকে নেমে আমরা পৌঁছলাম হাতাহামা বিচে। সাদা বালির ওপর বসে ঢেউ গুনতে লাগলাম। প্রতিটি ঢেউ যেন দূরের অজানা গল্প শোনাচ্ছে। শিশুদের হাসি, সীগালের ডাক আর সমুদ্রের গর্জনে তৈরি হলো এক স্বপ্নীল বিকেল। সাগরের জলে পা ডুবিয়ে যখন তাকালাম দিগন্তের দিকে, মনে হলো আমি সত্যিই এক রূপকথার রাজ্যে আছি। দিনের ক্লান্ত শরীরকে শীতল করতে চলে গেলাম দ্বীপের অনসেনে। ওশিমার আরেক আকর্ষণ হলো অনসেন (গরম প্রস্রবণ)। দিনের ক্লান্তি শেষে গরম পানির উষ্ণতায় শরীর যখন ডুবে গেল, মনে হলো শরীরের সমস্ত ক্লান্তি যেন গলে গলে যাচ্ছে। দূরে সমুদ্রের গর্জন আর আকাশে রঙিন সূর্যাস্ত-এ মুহূর্তে আমি প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। শরীর উষ্ণ পানিতে ভেসে রইল, মন উড়ে গেল অনেক দূরে। অনসেন থেকে বেরিয়ে দ্বীপের এক ছোট্ট রেস্টুরেন্টে বসে খেলাম তাজা সামুদ্রিক খাবার। জানালার বাইরে সমুদ্রের নীল ঢেউ দুলছিল, আর ভেতরে সুস্বাদু গরম স্যুপের ভাপ। প্রতিটি কণা মনে করিয়ে দিলো, ভ্রমণের স্বাদ শুধু চোখে নয়, জিভেও লেগে থাকে।
বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো। আবার যাত্রা শুরু হলো টোকিওর পথে। পেছনে ফেলে এলাম আগ্নেয়গিরির দ্বীপ, নীল সমুদ্র আর তারাভরা আকাশ। যখন শহরের আলো দূর থেকে ভেসে উঠলো, মনে হচ্ছিল আমি যেন স্বপ্ন থেকে ধীরে ধীরে বাস্তবে ফিরে আসছি। তবে মনে থেকে গেল সারা দিনের স্মৃতি যেন আমি সত্যিই একদিনের জন্য পৃথিবীর বুকের এক অচেনা স্বর্গে গিয়েছিলাম।
জাপান-নিয়মের ভেতর নান্দনিক জীবন
জাপান এমন এক দেশ যেখানে নিয়মকানুন শুধু আইনে নয়, সংস্কৃতি ও মানসিকতার গভীর শিকড়ে গাঁথা। বিদেশিদের কাছে এ নিয়মগুলো অনেক সময় অবাক করা মনে হয়। টোকিওর এক সকাল। রাস্তায় নামতেই প্রথম চমকটা খেলাম-ব্যস্ত শহর, অথচ আশ্চর্য নীরবতা। হাজার মানুষ চলেছে, ট্রেন ছুটছে মিনিটের নির্ভুলতায়, কিন্তু কোথাও হট্টগোল নেই। মনে হলো, শহরটা যেন কোনো অদৃশ্য সুরে বাঁধা, যেখানে প্রত্যেক মানুষ তার নিজের ছন্দে নিঃশব্দে বাজছে। জাপানে হাঁটতে হাঁটতে বা ট্রেনে বাসে খাওয়া অভদ্রতা হিসেবে ধরা হয়। খাবার মানেই বসে শান্তভাবে খাওয়া-তা হোক পার্কে, অফিসে বা রেস্তোরাঁয়।
স্টারবাকস থেকে এক কাপ কফি নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ পাশের এক জাপানি ভদ্রলোক চোখে ইশারা করে জানালেন-‘ওটা এখানে নয়’। বুঝলাম, রাস্তার হেঁটে কফি খাওয়া এখানে অনুচিত। খাওয়া মানেই নির্দিষ্ট জায়গায় বসে, মনোযোগ দিয়ে খাওয়া। ট্রেনে টোকিও থেকে হিরোশিমা যাচ্ছি। চোখে পড়লো অদ্ভুত দৃশ্য-পুরো কামরা ভরা মানুষ, অথচ সবার মুখে নীরবতা। কেউ ফোনে কথা বলছে না, কেউ হাসছে না। সবাই নীরবে বই পড়ছে, কিংবা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। ট্রেনে পাশাপাশি দুটো করে সিট। আমার পাশের সিটে বসা তরুণীকে দেখলাম নিঃশব্দে বই পড়ছে। অন্য কেউ ফোনে নয়, চোখে চোখও নয়-সবাই নিজের জগতে ডুবে। জাপানিরা বিশ্বাস করে, ‘নীরবতা হলো সম্মানের ভাষা’।
পরে জেনেছিলাম ট্রেন, বাস বা পাবলিক প্লেসে ফোনে কথা বলা খুবই অশোভন বলে গণ্য হয়। মানুষজন সাধারণত মেসেজ করে কথা বলে বা নীরবে যাত্রা করে। প্রায় সব জাপানি ঘর, স্কুল-এমনকি কিছু রেস্তোরাঁয়ও জুতো খুলে ঢুকতে হয়। এটি পরিচ্ছন্নতা ও সম্মানের প্রতীক। জাপানে আমার ট্যুর গাইড নিকিতা একদিন দাওয়াত করলো তার বাড়িতে। দরজার সামনে পৌঁছাতেই সে হেসে বললো, জুতো খুলে আস। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ঘরের ভেতর একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। পরে জানলাম, তাদের কাছে বাইরে হাঁটা জুতার ধুলো মানে অশুদ্ধতা। রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েও পেলাম এক নতুন শিক্ষা। বিল মেটানোর পর টিপস দিতে যেতেই ওয়েটার হালকা মাথা নুইয়ে বললো, ‘না, ধন্যবাদ’। জাপানে ভালো সেবা মানেই কর্তব্য, টিপস নয়-এ যেন এক সংস্কৃতির মাধুর্য, যা টাকার চেয়ে বেশি দামি। রেস্তোরাঁ, ট্যাক্সি বা হোটেলে কাউকে টিপস দিলে তারা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ভালো সেবার জন্য টিপ নয়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশই যথেষ্ট বলে তারা মনে করে।
রাস্তার পাশে যখন ডাস্টবিন খুঁজে না পেয়ে অবাক হচ্ছিলাম, তখন এক বৃদ্ধা হেসে বললেন, ‘ময়লা নিজের ঘরেই নিয়ে যান’। বুঝলাম, পরিচ্ছন্নতা এখানে সরকার নয়, মানুষের অভ্যাস। অদ্ভুত শোনালেও সত্যি। জাপানে পাবলিক ডাস্টবিন খুব কম। সবাই নিজের ময়লা ব্যাগে করে বাড়ি নিয়ে যায়। পরিচ্ছন্নতা সবার ব্যক্তিগত দায়িত্ব। জাপানে কাউকে উপহার দিতে হলে দুই হাত প্রসারিত করে দিতে হয়। প্যাকেট খোলা হয় পরে, কখনোই উপহার দাতার সামনে বসে নয়। কারণ সামনে খোলা অসম্মানের ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়। একদিন আমার ট্যুর গাইড আমাকে একটি ছোট প্যাকেট দিলেন, দু’হাতে করে। আমি খুলতে যেতেই সে মৃদু হেসে বললো, পরে খুলো। বুঝলাম ওদের কাছে উপহার মানে শুধুই বস্তু নয়- সম্মানের প্রকাশ। সামনে খুলে ফেলা মানে যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সৌন্দর্য নষ্ট করা। জাপানে গিয়ে আমি সময়ের মূল্য নতুনভাবে শিখেছি। ট্রেন ঠিক নির্ধারিত সময়ে ছাড়ে, অফিসে দেরি মানে অসম্মান।
আমার গাইড জানান, একবার মাত্র দুই মিনিট দেরি হওয়ায় একজন ট্রেনচালক যাত্রীদের কাছে লিখিত ক্ষমা চেয়েছিলেন। জাপানিরা ‘সুমিমাসেন’ (দুঃখিত) শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করে-এমনকি ক্ষুদ্র ভুলের জন্যও। বিনয় তাদের সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একদিন আকিয়াবারার ব্যস্ত রাস্তা পার হওয়ার সময় সামান্য ধাক্কা লাগতেই লোকটি হালকা নুয়ে বললো, ‘সুমিমাসেন’। এই একটি শব্দ-দুঃখপ্রকাশ, ধন্যবাদ, সৌজন্য-সবকিছুর প্রকাশ। যেন বিনয়ের এক ভাষা, যা পুরো জাতির মর্মে বেঁচে আছে। একদিন টোকিওর শিবুয়া ক্রসিংয়ের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এই সমাজের সৌন্দর্য আসলে তাদের নীরব নিয়মেই। এরা আইন মানে শাস্তির ভয়ে নয়, সৌন্দর্যের জন্য। শৃঙ্খলা, নীরবতা, পরিচ্ছন্নতা- সব মিলিয়ে জাপান যেন এক চলমান কবিতা, যার প্রতিটি শব্দ ‘সম্মান’ দিয়ে লেখা।
দিনের শেষে টোকিওর আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এই শহরটা যেন নিয়মের নয়, শ্রদ্ধার। সময়, নীরবতা, পরিচ্ছন্নতা-সবকিছু তারা ভালোবাসে ভেতর থেকে। এ এক এমন সমাজ, যেখানে শৃঙ্খলা কোনো বাধা নয়, বরং জীবনযাপনের এক নান্দনিক রূপ।
ফুরানো ভ্রমণ
ভোরের আলোয় টোকিওর আকাশে সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের নিওন আলো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে আকাশের নরম আলোয়। আমি হানাদাএয়ারপোর্ট থেকে যাচ্ছি হোক্কাইদোর হৃদয়ে, ফুরানোর পথে। বিমানের ডানার নিচে টোকিওর বিস্তৃত নগরী ধীরে ধীরে সরে যায়, তার জায়গায় দেখা দেয় পাহাড়, নদী, হ্রদ আর তুষারের রেখা। এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট পর নামি নিউ চিতোসে এয়ারপোর্টে-এ যেন অন্য এক জাপান, আরো শান্ত, আরো নিঃশব্দ। যেখানে বাতাসে ঠান্ডা আর রোদের উষ্ণতা পাশাপাশি হাঁটে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্রেনে চেপে বসি ফুরানোর উদ্দেশে। পথে জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যায় সবুজ ধানের ক্ষেত, ঘাসভরা ঢাল, আর দূরে নীলচে পাহাড়ের সারি। রোদ তখন উজ্জ্বল, কিন্তু হোক্কাইদোর হাওয়ায় ঠান্ডার মৃদু ছোঁয়া। বাইরে ভেসে ওঠে ধানক্ষেত, নদী, আর ফুলের ঢালু পাহাড়। মনে হচ্ছিলো যেন কোনো ওয়াটারকালার ছবির ভেতর দিয়ে চলছি।
দুপুরের একটু পর পৌঁছাই ফোরানেতে। ফুরানো মানেই ল্যাভেন্ডার। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম Farm Tomita-এক রঙের রাজ্য, যেখানে মাটির ওপর বেগুনি ঢেউ নেচে ওঠে বাতাসে। সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করা ল্যাভেন্ডারের সারি যেন সময়কেও স্থির করে রাখে। Farm Tomita ফুরানোর সবচেয়ে বিখ্যাত স্থান। সূর্যের আলোতে ফুলগুলো ঝিলমিল করে, আর মাঝেমধ্যে হালকা বাতাসে সেই রঙ যেন নড়ে ওঠে, যেন বেগুনি সাগর। পাশে একটি ছোট্ট কাঠের ঘর-সেখানে বিক্রি হচ্ছে ল্যাভেন্ডার আইসক্রিম। একটা আইসক্রিম কিনে খেতে শুরু করলাম।
ঠান্ডা আইসক্রিমে গলে গেল দিনের ক্লান্তি। মনে হলো, ফুরানো মানে শুধু দেখা নয়, অনুভব করাও। এই রঙের দেশে, সুখও যেন ল্যাভেন্ডারের মতো নরম, শান্ত আর সুবাসিত।
বিকেলে যাই Ningle Terrace-এ। পাইনগাছের বনে কাঠের কটেজগুলো একটার পর একটা সাজানো, যেন কোনো রূপকথার গ্রাম। ভেতরে ছোট ছোট দোকান-কাচের অলংকার, কাঠের পুতুল, হস্তশিল্প, সবই স্থানীয় শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি। হালকা আলোয় কটেজগুলোর জানালা থেকে উঁকি দেয় উষ্ণতা। ছোট্ট এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমি শুনি বনের নীরবতা। এক ধরনের নরম শান্তি যা শুধু হোক্কাইদোর আকাশেই মেলে। পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ি Blue Pond (Aoiike)-এর দিকে। রাস্তায় গাড়ি চলে বন আর পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে। ফুরানোর পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি যখন এগোয় উত্তরের দিকে, জানালার বাইরে হালকা কুয়াশা আর সবুজ পাহাড়ের ছায়া। দূরে মেঘেরা ছুঁয়ে আছে পর্বতের কাঁধ, আর বাতাসে মিশে আছে ল্যাভেন্ডারের মিষ্টি গন্ধ। হঠাৎ এক মোড়ে এসে গাড়ি থেমে যায়, সামনে এক নীল বিস্ময়! এটি সেই বিখ্যাত Blue Pond, স্থানীয়রা যাকে বলে Aoiike।
প্রথম দেখায় মনে হয়- কোনো শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা এক নিখুঁত ছবি। জল এতটাই নীল যে মনে হয় আকাশ নিজেই নেমে এসেছে নিচে। বিজ্ঞানীরা বলেন, পাশের ইরবর নদী থেকে আসা অ্যালুমিনিয়াম ও খনিজ পদার্থ সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয়ে এই অসাধারণ নীল আভা সৃষ্টি করে। হ্রদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো গাছের গুঁড়িগুলো যেন সময়ের প্রতীক। নীলচে পানির হ্রদ, যার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে শুকনো গাছের কান্ডগুলো, নিঃশব্দ প্রতিচ্ছবির মতো। হালকা ঠান্ডা বাতাসে হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো গাছগুলো যেন আকাশের নীরব প্রহরী। পানির নীল এত গভীর যে মনে হয় আকাশ গলে এসে মিশেছে হ্রদের বুকে। বাতাসে হালকা ঠান্ডা, আর চারপাশে পাখির ডাক। হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর দূরে পাখির ডাকে প্রতিধ্বনি শুনছিলাম। টোকিওর ব্যস্ততার পর এই নীরবতা এক স্বস্তির চাদর হয়ে জড়িয়ে ধরে মনকে। মনে হচ্ছিলো এখানে সময় থেমে যায়, শব্দ মিলিয়ে যায়, কেবল রঙ আর জল কথা বলে ।
বিকেলে চলে যাই Furano Winery-তে
ছোট পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই ওয়াইন ফ্যাক্টরির টেরেস থেকে দেখা যায় নিচে পুরো শহরটা-সবুজ আর নীলের মিশেল। গ্লাসে ফুরানো ওয়াইন, গন্ধে মিশে থাকে ল্যাভেন্ডারের হালকা ইঙ্গিত। আমি হেঁটে ঘুরে দেখলাম ওয়াইনারির বিভিন্ন বিভাগ-আঙুরের ক্ষেত, চাষের সরঞ্জাম, ওয়াইন তৈরির প্রক্রিয়া, আর ছোট গ্লাসে ওয়াইন টেস্টিংয়ের স্থান। সূর্য ধীরে ধীরে নামছে পাহাড়ের পেছনে। আমি চড়ে বসি ফিরতি ট্রেনে। মনে হচ্ছিল ফুরানো কোনো শহর নয়, এটা এক শান্ত অনুভূতির নাম। মনের ভেতর বাজতে থাকে ফুরানোর নরম নীরবতা। ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ, নীল হ্রদের প্রতিচ্ছবি, আর বনের কটেজের আলো-সব মিলিয়ে এ সফর হয়ে ওঠে এক অবর্ণনীয় আনন্দের উৎস।
টোকিও ফিরে দেখি শহরের আলো আগের মতোই ঝলমলে। কিন্তু মনে রয়ে যায় ফুরানোর নরম রঙ, তার হাওয়ার মিষ্টি গন্ধ, আর সেই নিস্তব্ধ সৌন্দর্যের প্রতিধ্বনি।