মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নিউইয়র্ক শহরের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির বৈঠকটি ছিল বহুল প্রতীক্ষিত। স্থানীয় সময় শুক্রবারের ওভাল অফিসের বৈঠকটি নিয়ে অনেকের ধারণা ছিল, দুই চরম বিপরীত মেরুর এই রাজনীতিবিদের মধ্যে সরাসরি বিরোধ দেখা যাবে। কিন্তু যা ঘটল, তা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত—বৈঠকটি পরিণত হলো এক বিরল আন্তরিকতা ও প্রশংসার উৎসবে। ফলে এই বৈঠক বলতে গেলে, নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় কৌশলকেই প্রশ্নবিদ্ধ করল।
নবনির্বাচিত মেয়র মামদানি বরাবরই নিজেকে মুসলিম এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী (ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট) নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। রিপাবলিকানদের তিনি এখন ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের রাজনৈতিক ‘জুজু’ হয়ে উঠেছেন। ট্রাম্প তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়ে নিউইয়র্ক সিটির ফেডারেল তহবিল বন্ধের হুমকিও দিয়েছিলেন। এত কিছুর পরও বৈঠকের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বৈঠকের সময় সাংবাদিকেরা বারবার দুই নেতার মধ্যকার মতপার্থক্য এবং অতীতের কটু মন্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করলেও, তাঁরা বারবারই সংঘাত এড়িয়ে যান এবং সাধারণ ঐক্যের জায়গাগুলো তুলে ধরেন। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখ থেকে একের পর এক প্রশংসা বাক্য বেরিয়ে আসে। তিনি বলেন:
‘আমি মনে করি, তিনি আসলে কিছু কনজারভেটিভদের অবাক করতে যাচ্ছেন। তার কিছু ধারণা সত্যিই আমার ধারণার মতোই। আমি যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি বিষয়ে আমরা একমত। আমি মনে করি এই মেয়র এমন কিছু করতে পারেন যা সত্যিই দুর্দান্ত হবে।’

সাংবাদিকেরা সিটির ফেডারেল তহবিল বন্ধের হুমকি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে ট্রাম্প বলেন, তিনি মামদানির ক্ষতি করা নয়, সাহায্য করার কথাই ভাবছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দিক থেকে প্রশংসা বেশি এলেও, মামদানি কৌশলে ট্রাম্পকে নিয়ে সরাসরি সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে মতবিরোধ নিয়ে আলোচনা না করে, বারবার তাঁর নির্বাচনী এজেন্ডা—জীবনযাত্রার ব্যয় ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাতে ফিরে যান।
এমনকি, এক সাংবাদিক যখন মামদানিকে ইসরায়েল-গাজা প্রসঙ্গে তাঁর পূর্ববর্তী মন্তব্য (যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে গণহত্যার সহযোগী বলা) নিয়ে প্রশ্ন করেন, তখন তিনি তা স্বীকার করেও দ্রুত আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে সাশ্রয়ী ব্যবস্থার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিকে নিয়ে আসেন।
অভ্যন্তরীণ ও কূটনৈতিক নীতিতে মামদানি ট্রাম্পকে সমর্থন না করলেও, তিনি প্রেসিডেন্টকে খানিকটা স্বস্তি দিয়ে বলেন, ‘আমি বলতে পারি, জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর আপনার মনোযোগের কারণে অনেক নিউইয়র্কবাসী সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। আমি সেই সাশ্রয়ী এজেন্ডা বাস্তবায়নে একসঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় আছি।’
বৈঠকে শুধু প্রশংসাই নয়, মনে হচ্ছিল যেন ট্রাম্প তাঁর নতুন ‘সঙ্গী’র ঢাল হিসেবে কাজ করছেন। মামদানি অতীতে ট্রাম্পকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বা ‘স্বৈরশাসক’ বললেও, ট্রাম্প তাতে গুরুত্ব দেননি।
এক সাংবাদিক মামদানিকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে ট্রাম্প হালকাভাবে বলেন, ‘ঠিক আছে। আপনি শুধু হ্যাঁ বলতে পারেন! ব্যাখ্যা করার চেয়ে এটা বরং সহজ।’ আরেকবার মামদানির ‘স্বৈরশাসক’ বলা প্রসঙ্গে ট্রাম্প হেসে বলেন, ‘আমাকে এর চেয়েও খারাপ কিছু বলা হয়েছে।’
ট্রাম্প এমনকি নিউইয়র্ক রিপাবলিকান গভর্নর পদপ্রার্থী এলিস স্টেফানিকের সেই আক্রমণাত্মক বক্তব্যও নাকচ করে দেন। যেখানে স্টেফানি মামদানিকে ‘জিহাদি’ বলেছিলেন। ট্রাম্প বলেন, ‘না, আমি তা মনে করি না...প্রচারণার সময় এমন কিছু কথা হয়েই থাকে।’
এই অপ্রত্যাশিত আন্তরিক বৈঠকটি রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় কৌশলকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট এবং ফ্লোরিডার সিনেটর রিক স্কটসহ শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকানরা এই বৈঠকের আগে মামদানিকে ‘আক্ষরিক অর্থেই কমিউনিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পুরো ডেমোক্রেটিক পার্টিকে তাঁর নীতির সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন।
কিন্তু ট্রাম্পের এই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার এবং তাদের মধ্যে ‘ঐকমত্য’ খুঁজে বের করার চেষ্টা, সেই কৌশলকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্প হয়তো মামদানির রাজনৈতিক দক্ষতা এবং সাশ্রয়ী জীবনযাত্রার সংকটের মতো জনপ্রিয় একটি ইস্যুতে তাঁর সাফল্যকে সম্মান জানিয়েছেন। তবে এর ফলে এখন কনজারভেটিভ মহলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সমঝোতামূলক আচরণের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা আসে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।