ভোরের টোকিও যেন সদ্যজাগা এক নগরী-ট্রেনের হুইসেলের তীক্ষ্ণ সুর কোলাহল ভেদ করে ডেকে নেয় নতুন নতুন অভিযানে। আমি চেপে বসলাম JR Utsunomiya Line-এর ট্রেনে-গন্তব্য ইউকি। ইউকি মূলত তিনটি কারণে বিশ্বজোড়া বিখ্যাত। প্রথমত ইউকির সবচেয়ে বড় গৌরব হলো হাতে তৈরি সিল্ক কাপড়। ইউনেস্কো ২০১০ সালে এটিকে Intangible Cultural Heritage (অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতো হাতে বানানো হয়, খুব সূক্ষ্ম, টেকসই এবং প্রতিটি কাপড়ই একেবারে অনন্য। মূলত কিমোনো ও অন্যান্য হস্তনির্মিত সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয়ত ইউকি শ্রাইন। এটি একটি প্রাচীন শিন্তো মন্দির, যা প্রায় ১ হাজার বছর আগে ইউকি বংশের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। স্থানীয়দের কাছে মন্দিগরটি শান্তি, সমৃদ্ধি ও পরিবারের মঙ্গল কামনার প্রতীক। মন্দিরে বার্ষিক উৎসব ও অনুষ্ঠান হয়, যা শহরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
তৃতীয়ত: ঐতিহ্য ও স্থানীয় সংস্কৃতি। ইউকি শহরের ছোট্ট রাস্তাঘাট, পুরোনো বাড়ি, স্থানীয় উৎসব ও খাবার-সবই প্রাচীন জাপানি গ্রাম্য জীবনধারার ছাপ বহন করে। বয়নশিল্প ও মন্দিরের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইউকি শিল্প, ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি জীবন্ত কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, ইউকি বিশ্বজোড়া বিখ্যাত হাতে তৈরি সিল্ক কাপড়, ঐতিহ্যবাহী মন্দির ও স্থানীয় সাংস্কৃতিক জীবনের জন্য। ট্রেন ছুটে চলছে। জানালার বাইরে শহরের আকাশচুম্বী ভবনগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল সবুজ মাঠের সঙ্গে। রেললাইন ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোচ্ছে ছোট নদী, টালির ছাদের ঘর, আর শীতল বাতাসে ভেসে আসছে গ্রামের স্বাভাবিক গন্ধ। ট্রেনের জানালায় ভেসে আসে শরতের নরম রোদ, দূরে পাহাড়ের অস্পষ্ট রেখা আঁকা যেন জাপানের জলরঙের ছবি।
কোইউ, শিমোদাতে, মিতো লাইনের স্টেশনগুলো পার হতে হতে বুঝলাম, আমি টোকিওর তাড়াহুড়া ফেলে এসে এক শান্ত জগতে ঢুকেছি। প্রায় দেড় ঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছে গেলাম ইউকি স্টেশন-এ। প্ল্যাটফর্মে নামতেই এক প্রশান্ত নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরল। গাইড নিকিতার সঙ্গে ছোট্ট শহরের নিস্তব্ধ রাস্তাগুলো ধরে হেঁটে পৌঁছে গেলাম ইউকি-সুমুগি ক্রাফটস মিউজিয়াম-এ। প্রবেশদ্বারেই যেন ইতিহাসের এক দরজা খুলে গেল-যেখানে সুতো শুধু সুতো নয়, বরং প্রজন্মের হাতে বোনা স্মৃতি। এখানে সংরক্ষিত আছে হাজার বছরের ঐতিহ্যের নিদর্শন। এই বয়নশিল্পের নাম ইউকি-সুমুগি। এর ইতিহাস যতটা পুরোনো, স্বীকৃতি ততটাই গৌরবময়।
নিকিতা জানায়, এই মিউজিয়ামটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ইউকি-সুমুগি সিল্ক বয়নশিল্পের সূচনা প্রায় দুই হাজার বছর আগে। কথিত আছে, কোফুন যুগ থেকেই স্থানীয়রা রেশমের কোকুন থেকে হাতে সুতো তৈরি করে কাপড় বুনতেন। এ শিল্পকলা টিকে গেছে মূলত কারিগরদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা শিক্ষার মাধ্যমে। কোনো যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়াই একেকটি কাপড় তৈরি হয় ধৈর্য, মনোযোগ আর নিপুণতার ছোটয়ায়। প্রতিটি কাপড় বোনা হয় হাতে কাটা সুতো দিয়ে। এজন্য সময় লাগে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত। এভাবেই কাপড় হয়ে ওঠে অনন্য সাধারণ-টেকসই, সূক্ষ্ম, আর শিল্পসমৃদ্ধ। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই ২০১০ সালে ইউনেস্কো ইউকি-সুমুগিকে Intangible Cultural Heritage (অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকতেই প্রথমেই চোখে পড়লো কাঠের পুরোনো তাঁত। তার মৃদু টক্টক্ শব্দে যেন এডো যুগের বাজারের গুঞ্জন ভেসে উঠলো। পাশে কারিগররা রেশমের কোকুন থেকে সুতো পাকাচ্ছেন, সাদা সুতোর সরু রেখা আলোর মতো ঝলমল করছে। একজন বৃদ্ধা কারিগর ধীরে ধীরে তাঁতে সুতো বসাচ্ছিলেন। তার হাতের ভাঁজে ছিল শতাব্দীর অভিজ্ঞতা, আর চোখের কোণে ছিল অদ্ভুত এক শান্তি। আমি দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম-একেকটি টান যেন শুধু কাপড় নয়, বুনে চলেছে জাপানের ঐতিহ্য।
গ্যালারিতে সাজানো রঙিন সুমুগি কিমোনো দেখে মনে হলো আমি রঙের সমুদ্রে ডুবে আছি। কোথাও শরতের পাতার ছোটয়া, কোথাও বসন্তের ফুলের রঙ, কোথাও আবার শীতের নীরব সাদা। শতাব্দী পুরোনো বয়নশিল্পের সেই নকশাগুলো চোখে পড়তেই মনে হলো, কাপড়ের সুতোতে যেন ইতিহাস বোনা হয়েছে। কারিগরদের নিপুণ হাতে তৈরি সূক্ষ্ম সিল্কের ছোটয়া আঙুলে নিয়ে ভাবছিলাম- এ কেবল এক শিল্প নয়, এ হলো সময়ের উত্তরাধিকার-ইউনেস্কো যাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করেছে।
মিউজিয়ামের ভেতরে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এখানে শুধু কাপড় বোনা হয় না, বোনা হয় এক জাতির ইতিহাস, মানুষের ধৈর্য আর সৌন্দর্যের প্রতি শ্রদ্ধা। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি সেই ইতিহাসকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে, কিন্তু ইউকির কারিগররা আসলে প্রতিদিনই সেই স্বীকৃতি বুনে চলেছেন নিজেদের হাতের নিপুণতায়। তারপর হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম ইউকি শ্রাইন-এ। কাঠের পুরোনো তোড়ি (Torii) গেট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন নীরবে জানিয়ে দিলো, এখানে প্রবেশ মানেই অন্য এক জগতে প্রবেশ করা। গেট পার হতেই পায়ের নিচে কাঁকরপথের মৃদু শব্দ আর চারপাশে শতবর্ষী গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি। বাতাসে ভেসে আসছিল ধূপের সুগন্ধ। মনে হলো প্রকৃতি আর প্রার্থনা এখানে একে অপরকে আলিঙ্গন করছে।
শ্রাইনের প্রধান প্রার্থনালয়টি কাঠের প্রাচীন স্থাপত্যে গড়া, সরল অথচ গম্ভীর। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ঘণ্টা বাজালাম। ঘণ্টাধ্বনি গাছের ডালে ডালে প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন স্বর্গীয় সুর হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করলাম, মন শান্ত হলো, হৃদয় প্রশান্ত হলো। চারপাশে কয়েকজন স্থানীয় মানুষকে দেখলাম, কেউ পরিবার নিয়ে এসেছে, কেউ একা। তারা ধীরে ধীরে নত হয়ে প্রার্থনা করছে, কেউ আবার তাবিজ কিনছে পরিবারের মঙ্গল কামনায়। বুঝতে পারলাম, এই শ্রাইন কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়-এটি মানুষের বিশ্বাস, আশা আর জীবনের রক্ষাকবচ। শ্রাইন চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে আমি এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রাচীন বৃক্ষের ছায়ায় বসে ভাবছিলাম, শত বছর আগে ইউকি বংশের শাসকরা হয়তো এখানেই প্রার্থনা করেছেন তাদের শহরের শান্তি আর সমৃদ্ধির জন্য। বয়নশিল্পের কারিগরেরা আজও এখানে এসে তাদের শিল্পকে রক্ষার জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করে।
বিকালের কনে দেখা রোদ যখন ধীরে ধীরে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন মনে হলো ইউকি শ্রাইন আমাকে এক অমূল্য উপহার দিল-শান্তি। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, ইতিহাস ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে এ মন্দিরে এসে বুঝলাম, কখনো কখনো প্রার্থনা কেবল শব্দে নয়, নীরবতার ভেতরেও জন্ম নেয়। শহরের পুরোনো রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম দোকানপাট, যেখানে স্থানীয় খাবার আর স্মারক বিক্রি হচ্ছে। ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে এক পেয়ালা সবুজ চা খেলাম, স্বাদে পেলাম গ্রামীণ মাটির গন্ধ।
বিকাল গড়িয়ে এলো, ট্রেন ডাক দিলো ফেরার
ফিরে চললাম টোকিওর পথে, তবে সঙ্গে রইলো ইউকির সেই শান্ত সুর, বয়নশিল্পের নিপুণতা আর মন্দিরের নীরব প্রার্থনা। জানালার বাইরে অস্তগামী সূর্যের রঙ মিশে যাচ্ছিল ধানক্ষেতের সোনালি ঢেউয়ের সঙ্গে। মনে হলো-আজকের দিনটিতে আমি শুধু একটি শহর নয়, এক টুকরো ইতিহাস, এক চুমুক ঐতিহ্য আর একচিলতে শান্তি নিজের ভেতর বুনে নিয়ে ফিরছি।
টোকিও থেকে নিক্কো
টোকিও শহরের সকালের আলো ধীরে ধীরে আকাশে মায়ার রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ব্যস্ত নগরীর কোলাহল ভেদ করে আমি তখন এগোচ্ছি ট্রেন স্টেশনের দিকে-যাচ্ছি নিক্কো। সঙ্গে আছে গাইড নিকিতা। নিক্কো হলো জাপানের টোচিগি প্রি-ফেকচারের একটি ছোট পাহাড়ি শহর, যা টোকিও থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দূরে অবস্থিত। এটি মূলত তার প্রাচীন মন্দির ও শ্রাইনগুলোর জন্য বিখ্যাত, বিশেষ করে তোশোগু মন্দির, যা টোকুগাওয়া ইয়েয়াসুর সমাধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শহরটি পাহাড়, নদী ও জলপ্রপাতের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা। জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানগুলো হলো-শিনকিয়ো ব্রিজ (পবিত্র লাল সেতু), তোশোগু মন্দির (সোনালি খোদাই ও কারুকাজের মন্দির ফুতারাসান মন্দির ও রিন্নোজি মন্দির,কেগন ফলস এবং লেক চুজেনজি।
নিক্কোকে বলা হয় জাপানের ঐতিহ্য ও প্রকৃতির এক অনন্য মিলনস্থল, যেখানে ইতিহাস, ধর্ম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একসঙ্গে মিলেমিশে দর্শককে মুগ্ধ করে। এখানে আছে দুটো ইউনেস্কো ওয়ারল্ড হেরিটেজ। শিনকানসেন ছুটে চললো নিক্কোর পথে। জানালার ফ্রেমে টোকিওর ব্যস্ততা মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আকাশচুম্বী ভবনের বদলে এল সবুজ পাহাড়, ধানক্ষেতের সোনালি ঢেউ, আর ছোট্ট গ্রামগুলোর নিস্তব্ধ উঠোন। মনে হচ্ছিলো আধুনিকতা থেকে প্রকৃতির দিকে একটি গোপন দরজা খুলে যাচ্ছে আমার জন্য। আমি যেন আধুনিক শহরের বুক থেকে ইতিহাসের প্রাচীন আঙিনায় প্রবেশ করছি। নিক্কো পৌঁছেই যে দৃশ্য প্রথমে মন কেড়ে নিলো, তাহলো শিনকিয়ো সেতু। লাল রঙের কাঠের সেতুটি যেন পাহাড়ি নদীর ওপর রক্তিম হাসি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর চারপাশের পাহাড়ি বাতাসে এক অদ্ভুত মিষ্টি স্নিগ্ধতা। মনে হলো, এই সেতু পেরোলেই আমি অন্য এক জগতে প্রবেশ করবো। নিকিতা জানায়, শিনকিয়ো ব্রিজকে বলা হয় জাপানের সবচেয়ে সুন্দর তিনটি সেতুর একটি। এর সৌন্দর্য শুধু চোখে দেখা যায় না, মনে এক ধরনের শান্তি ও শ্রদ্ধা জাগায়। এটি নিক্কোর অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এটি শুধু একটি সেতুই নয়, বরং জাপানি আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস আর প্রকৃতির এক মিলিত প্রতীক।
নিকিতা আরো জানায়, শিনকিয়ো মানে পবিত্র সেতু। এটি নিক্কোর ফুতারাসান শ্রাইনের অন্তর্ভুক্ত। সেতুটি প্রথম তৈরি হয় ১৬৩৬ সালে, যদিও তারও আগে এখানে কাঠের সাধারণ পারাপারের পথ ছিল। প্রচলিত আছে অষ্টম শতকে সাধু শোডো শোনিন যখন পাহাড় বেয়ে এখানে পৌঁছান, তখন নদী এতো উত্তাল ছিল যে পার হওয়া ছিল অসম্ভব। বলা হয়, দেবতা জিনজা-দাইও দুটি বিশাল সাপ ডেকে আনেন, আর সেই সাপ নদীর ওপর সেতুর মতো শরীর বিছিয়ে দেন। শোডো শোনিন ও তার শিষ্যরা তখন সেই সাপের পিঠে হেঁটে নদী পার হন। এ অলৌকিক ঘটনাকে স্মরণ করেই পরবর্তী সময়ে এখানে শিনকিয়ো ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। সেতুটি কাঠের তৈরি, উজ্জ্বল লাল রঙে রাঙানো। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮ মিটার, প্রস্থ ৭ দশমিক ৪ মিটার। নদী দাইয়া-গাওয়া (Daiya River)-এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জাপানের ঐতিহ্যবাহী শিন্তো স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে এটি আজও অক্ষত।
নিকিতা জানায়, বসন্তে যখন চারপাশে চেরি ফুল ফোটে, গ্রীষ্মে সবুজে ঢাকা থাকে, শরতে রঙিন পাতা ঝরে তখন সেতুর সৌন্দর্য দ্বিগুণ হয়। আর শীতে বরফে এটি সাদা চাদরে মোড়া এক রূপকথার দৃশ্য তৈরি করে। সন্ধ্যার আলোতে লাল সেতু আর গাঢ় সবুজ পাহাড় মিলেমিশে যেন এক স্বপ্নীল ছবি তৈরি করে।
শিনকিয়ো ব্রিজকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে (১৯৯৯ সালে, ‘Shrines and Temples of Nikko’-এর অন্তর্ভুক্ত)। এটি আজও নিক্কোর আধ্যাত্মিক প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত হয়।
একপর আমরা গেলাম তোশোগু মন্দিরে।
নিক্কোর পাহাড়ি বনের নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে আছে তোশোগু মন্দির। এটি জাপানের অন্যতম জাঁকজমকপূর্ণ ও ঐতিহাসিক শিন্তো মন্দির। এটি শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, বরং জাপানি শিল্প, স্থাপত্য আর ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। পাহাড় ঘেরা নীরবতার ভেতর টোকুগাওয়া ইয়েয়াসুর বিশাল সমাধি-তোশোগু শ্রাইন। সোনালি খোদাই, কাঠের জটিল নকশা, আর চারপাশে বনভূমির নিস্তব্ধতা-সব মিলিয়ে এ যেন মানুষের হাতের কারুকাজ আর প্রকৃতির মিলিত বিস্ময়। মন্দিরের ভেতর দাঁড়িয়ে মনে হলো, শত শত বছর আগের সামুরাইদের নিঃশব্দ পদধ্বনি এখনো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
নিকিতা জানায়, তোশোগু মন্দির নির্মিত হয় ১৬১৭ সালে, টোকুগাওয়া শোগুন বংশের প্রতিষ্ঠাতা টোকুগাওয়া ইয়েয়াসুর মৃত্যু পর তার সমাধি হিসেবে। প্রথমে এটি ছিল একটি সাধারণ মাজার, কিন্তু তার নাতি টোকুগাওয়া ইয়েমিতসু, যিনি তৃতীয় শোগুন ছিলেন, ১৬৩৬ সালে এটিকে বিশাল পরিসরে পুনর্র্নির্মাণ করেন। ইয়েয়াসুকে দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়, তার উপাধি দেওয়া হয় তোশো দাইগনগেন, অর্থাৎ ‘মহান আলোর দেবতা”। পরবর্তী সময়ে এই মন্দির টোকুগাওয়া শোগুনেটের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠে। তোশোগু মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর অলঙ্কারপূর্ণ কারুকাজ। কাঠের দেয়াল, বিম, দরজা, ছাদ-সবকিছুতেই সোনালি রঙ, সূক্ষ্ম খোদাই, ও উজ্জ্বল রঙের সমাহার দেখা যায়। এখানে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি খোদাইচিত্র আছে, যেখানে প্রাণী, ফুল, পৌরাণিক চরিত্র থেকে শুরু করে নানান প্রতীক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো- তিন বানর (Three Wise Monkeys) : মন্দ দেখো না, মন্দ শোনো না, মন্দ বলো না-এই শিক্ষা দেয়।
মন্দির কমপ্লেক্সটি ঘেরা আছে গভীর সবুজ পাহাড়ি বনে। লম্বা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে ইয়েয়াসুর সমাধি দেখতে পাওয়া যায়। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল পাইন ও সিডার গাছের ফাঁক দিয়ে বাতাস বইতে থাকে। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় ইতিহাস, ধর্ম আর প্রকৃতি যেন এক সুতায় বাঁধা। ১৯৯৯ সালে, তোশোগু মন্দিরসহ নিক্কোর আরো কয়েকটি মন্দির ও মঠকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করা হয়। আজও এটি জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র এবং ধর্মীয় গৌরবের প্রতীক। তোশোগু মন্দির কেবল টোকুগাওয়া ইয়েয়াসুর স্মৃতি নয়, বরং জাপানি সভ্যতার এক শিখর। যেখানে রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা ও শিল্প মিলেমিশে এক অনন্য মহিমা সৃষ্টি করেছে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ফুতারাসান মন্দির ও রিন্নোজি। পাইনগাছের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট মন্দিরগুলো দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। সূর্য ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছিল। সময় ফুরিয়ে আসছিল দ্রুত। নিকিতা আমাকে নিয়ে গেল কেগন ফলস ও লেক চুজেনজি দেখাতে। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা সেই স্রোত যেন আকাশ থেকে নামা রূপালি পর্দা। পাশে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি আমাকে জড়িয়ে ধরে এক অনন্ত প্রেমের গান শুনিয়ে দিচ্ছে। লেক চুজেনজির জলে প্রতিফলিত আকাশের নীলাভ আলোয় দিনের ভ্রমণটা যেন পূর্ণ হয়ে উঠলো। সন্ধ্যায় ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখলাম পাহাড়ের আঁধার আর গ্রামের আলোকবিন্দুগুলো একে অপরকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, নিক্কো আমাকে তার গল্প শোনাল, আর আমি সেই গল্পের একজন ক্ষুদ্র যাত্রী হয়ে ফিরছি টোকিওর আলো ঝলমলে পথে।
এডো-টোকিও মিউজিয়াম
সকালবেলায় টোকিওর ব্যন্ত সড়ক ছেড়ে রওনা দিলাম রেলস্টেশনের দিকে। ভ্রমণের শুরুতেই মনে হচ্ছিল, আজ আমি কেবল কোনো ভবনে যাচ্ছি না, সময়ের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছি ৪০০ বছর আগের এডো শহরে। টোকিও স্টেশন থেকে জেআর সোবু লাইন ধরলাম। ট্রেন ছুটে চললো শহরের বুক চিরে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, আধুনিক টোকিওর অগণিত টাওয়ার আর ব্যস্ত জীবনের কোলাহল। মাত্র ১০ মিনিটের পথ, গন্তব্য রিওগোকু স্টেশন, যা আবার সুমো কুস্তির জন্য বিখ্যাত। সেখান থেকে পায়ে হাঁটলেই পৌঁছে গেলাম সেই মহৎ স্থাপত্যের সামনে-এডো-টোকিও মিউজিয়ামে। এডো-টোকিও মিউজিয়ামের বিশাল ভবনের সামনে দাঁড়ালাম, মনে হলো সময় যেন আমাকে একটি দরজা খুলে দিলো-এক প্রান্তে আধুনিক টোকিওর আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর অন্য প্রান্তে হারিয়ে যাওয়া এডো যুগের নিসর্গ। ভবনটি দেখে মনে হলো কোনো বিশাল জাহাজ আকাশের বুকে ভাসছে। ধূসর রঙের আধুনিক স্থাপত্য, অথচ ভিতরে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের সোনালি ভান্ডার।
প্রবেশমুখে পা রাখতেই আমাকে স্বাগত জানাল একটি বিশাল কাঠের সেতু। সেতুটা পার হতে গিয়েই মনে হলো, আমি আর একুশ শতকের ভ্রমণকারী নই, বরং এডোর একজন পথিক, যিনি পা ফেলছেন ব্যস্ত বাজারে। চারদিকে কারিগরদের দোকান, পুতুলনাচ, রঙিন কিমোনো পরা মানুষ-সবই মডেল, অথচ প্রাণহীন মনে হয়নি। মনে হলো, আমি সত্যিই শুনতে পাচ্ছি হকারদের ডাক, সামুরাইদের দাপটের পদচারণা, কিংবা কাগজের লণ্ঠনের নিচে বসে থাকা কবির স্বপ্নমগ্ন নিঃশ্বাস।
এখানে শহরটা গড়ে উঠেছে নতুন কওে কখনো ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে আবার দাঁড়ানো, কখনো ভূমিকম্পের ছোবলে ভেঙে গিয়েও নবযাত্রা। ছোট্ট এক জেলেপাড়া থেকে সম্রাটের রাজধানী, আর সেখান থেকে আজকের মেট্রোপলিশ। প্রদর্শনী ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম, কীভাবে একসময় টোকিও ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়েছিল, আবার কীভাবে ভূমিকম্পের ছোবলেও তারা হাল ছাড়েনি। প্রতিটি ধ্বংসের পর শহর দাঁড়িয়ে গেছে নতুন রূপে যেন ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির পুনর্জন্ম। মিউজিয়ামের প্রতিটি কোণ জ্বল জ্বল করছে সামুরাই বর্মের ধাতব দীপ্তি, এডোর নাট্যমঞ্চের রঙিন দৃশ্যপট, কিংবা যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের ছবিগুলো সব মিলিয়ে মনে হলো আমি হাঁটছি না, বরং ভাসছি সময়ের স্রোতে।
কীভাবে যাবেন: টোকিও স্টেশন থেকে জেআর সোবু লাইন ধরে রিওগোকু স্টেশনে নামতে হবে। চাইলে টোই ওয়েডো সাবওয়ে লাইনেও রিওগোকু আসা যায়। স্টেশন থেকে হেঁটে মাত্র ৩-৫ মিনিটেই পৌঁছে যাবেন মিউজিয়ামের প্রবেশদ্বারে।
টোকিও থেকে মাউন্ট মিতাকে
টোকিও শহরের ভোর। শিনজুকুর ব্যস্ত স্টেশন থেকে আমি আর নিকিতা যাত্রা শুরু করলাম মাউন্ট মিতাকে ভ্রমনে। মাউন্ট মিতাকে (Mount Mitake) টোকিও শহরের পশ্চিমে, চিচিবু-তামা-কাই জাতীয় উদ্যানে (Chichibu-Tama-Kai National Park) অবস্থিত এক পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ৯২৯ মিটার। এটি প্রাচীনকাল থেকে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে বিখ্যাত মুসাশি মিতাকে মন্দির (Musashi Mitake Shrine), যার ইতিহাস দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো বলে মনে করা হয়। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য মিতাকে দারুণ আকর্ষণীয়। ঘন বন, পাথুরে ঝরনা, খাড়া গিরিখাত ও রঙিন মৌসুমি ফুল এই পাহাড়কে অনন্য করে তুলেছে। বিশেষত ‘রক গার্ডেন’ নামের উপত্যকায় ছোট ছোট জলপ্রপাত ও শৈবালের সবুজে ভরপুর দৃশ্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখছিলাম টোকিও শহরের কংক্রিটের দেয়াল ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, জায়গা করে নিচ্ছে ধানক্ষেত, নদী আর পাহাড়ি ছায়া। ধীরে ধীরে ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে শহরতলির সবুজ বুকে।
শিনজুকু থেকে ওমে, তারপর মিতাকে স্টেশন। সেখান থেকে উঠলাম কেবল কারে। পাহাড়ের বুক চিরে যখন কেবল কার ওপরে উঠছিল, মনে হচ্ছিল আমি যেন মেঘের সিঁড়ি বেয়ে আকাশের দিকে এগোচ্ছি। পাহাড়চূড়ার পথে পা রাখতেই যেন নীরব এক জগৎ খুলে গেল। চারপাশে ঘন সবুজ বন, শৈবালে ঢাকা পাথর আর ফিসফিস করা ঝরনার সুর। পথে পথে কাঠের ছোট্ট ঘর, যেখানে চা আর গরম নুডলসের ধোঁয়া পাহাড়ি হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। পাহাড় চূড়ায় মুসাশি মিতাকে শ্রাইন। প্রাচীন কাঠের মন্দির, শ্যাওলায় মোড়া পাথরের সিঁড়ি, আর দেবতার প্রতীকী উপস্থিতি যেন পাহাড়ের বুকজুড়ে ছড়িয়ে আছে। পাখিদের ডানায় ভেসে আসা সুর মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত সংগীত ঝংকার তুলছিল।
গাইড নিকিতা জানায়, মাউন্ট মিতাকে অবস্থিত এই শিন্তো মন্দিরের ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছরেরও পুরোনো। জাপানি কিংবদন্তি অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতেই এখানে পাহাড় দেবতার পূজা শুরু হয়েছিল। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিস্টীয় ৯০ সালে, সম্রাট সুজিনের শাসনামলে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মন্দিরটি পাহাড় উপাসনা (Mountain Worship) বা শুগেনদো প্রথার কেন্দ্র ছিল। সাধক ও ইয়ামাবুশি (পাহাড়ি সন্ন্যাসী) এখানে ধ্যান ও সাধনায় নিযুক্ত হতেন, বিশ্বাস করতেন পাহাড়ের দেবতারা মানবজীবনে শক্তি ও সুরক্ষা দান করেন।
এই মন্দির মূলত উৎসর্গ করা হয়েছে ওওকামি (okami) নামের এক দেবতাকে, যাকে অনেক সময় ‘জাপানি নেকড়ে দেবতা’ হিসেবেও পরিচয় দেওয়া হয়। জাপানি পুরাণে তিনি পাহাড় ও বনজীবনের রক্ষক। গ্রামাঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করতো, এ দেবতা ফসল ও গৃহপালিত পশুদের শত্রু প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা করেন। এজন্য জাপানে মিতাকে মন্দির আজও ‘রক্ষাকারী নেকড়ে মন্দির’ নামেও পরিচিত। মন্দিরটি অবস্থিত ৯২৯ মিটার উঁচু মাউন্ট মিতাকের চূড়ায়। কাঠের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যে নির্মিত মন্দিরটির মূল ফটক, প্রশস্ত সিঁড়ি ও শান্ত আঙিনা পাহাড়ি পরিবেশের সঙ্গে মিশে এক অপার্থিব আবহ তৈরি করেছে। চারপাশে বিশাল সিডার ও পাইন গাছ, যেগুলোকে স্থানীয়রা পবিত্র হিসেবে মানেন।
মন্দির চত্বরে একটি ছোট্ট ‘ওইনু (Oinu) মূর্তি’ রয়েছে, যা নেকড়ে দেবতার প্রতীক। দর্শনার্থীরা এখানে তাবিজ (Omamori) কিনে থাকেন, বিশেষ করে গৃহপালিত প্রাণী ও পরিবারের সুরক্ষার জন্য। নিকিতা জানায়, এডো যুগে (১৭০০-১৯০০ শতাব্দী) মিতাকে মন্দিরে তীর্থযাত্রা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। টোকিও (তখনকার এডো) শহর থেকে সাধারণ মানুষ এখানে আসতেন প্রার্থনা করতে। আজও স্থানীয় পরিবাররা বিশেষ করে নতুন বছরের শুরুতে ও উৎসবের সময়ে মন্দিরে প্রার্থনা করতে আসেন। প্রতি বছর মিতাকে উৎসব (Mitake Matsuri) পালিত হয়, যেখানে ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা ও দেবতার প্রতীক পাহাড় থেকে নামিয়ে আনা হয়।
আমরা হাঁটা শুরু করলাম অরণ্যের পথে। বনের ভেতর শ্যাওলায় ঢাকা বিশাল পাথর, ছোট ছোট জঙ্গল-ঝরনা আর ঘন সিডার গাছের ছায়া। আমার মনে হচ্ছিল, এ পথ ধরে হেঁটেছেন হয়তো প্রাচীন সাধকরা, কবিরা, কিংবা একলা পথিকরা, যারা শান্তির খোঁজে এসেছিল। প্রতিটি বাঁকে বাতাসে ভেসে আসছিল কুয়াশার গন্ধ, আর পাতার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া রোদের দাগ যেন আঁকছিল পাহাড়ি কবিতা। মাউন্ট মিতাকের চূড়ায় মুসাশি মন্দিরটি ঘুরে ফিরে দেখে নিচে নামলাম এক আঁকাবাঁকা পথে, সেই পথই আমাকে নিয়ে গেল পাহাড়ের গোপন রাজ্যে, রক গার্ডেন-এ।
মাউন্ট মিতাকের বুকের গভীরে লুকিয়ে আছে এক টুকরো নীরব স্বর্গ-রক গার্ডেন। ছোট্ট উপত্যকা, সরু পাহাড়ি পথ, আর পাথরের ওপর ঝরনা বয়ে চলেছে শত শত বছর ধরে। পথের দুপাশে বিশাল সিডার গাছ, পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া রোদ যেন মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। পায়ের নিচে পুরোনো পাথর, কানে বাতাসের শিস, আর দূর থেকে ভেসে আসা জলের শব্দ-সব মিলিয়ে মনে হলো আমি ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি প্রকৃতির এক পবিত্র মন্দিরে।
নিকিতা জানায়, এই রক গার্ডেন কোনো মানুষের হাতে গড়া বাগান নয়, বরং সময়ের হাতে আঁকা শিল্প। বহু শতাব্দী আগে পাহাড়ি সাধকরা এখানে আসতেন ধ্যান করতে। তারা বিশ্বাস করতেন, ঝরনার কলকল ধ্বনিই হলো দেবতার ভাষা, আর শৈবালের সবুজ হলো পবিত্রতার প্রতীক। ছোট ছোট জলপ্রপাত-আয়ামে-নো-তাকি আর নানায়ে-নো-তাকি- তাদের কাছে ছিল শুদ্ধির উৎস। তারা বলত, এই জল শুধু দেহ ধোয় না, মনকেও ধুয়ে দেয়। মন্দির থেকে নেমে যখন রক গার্ডেন-এর দিকে হাঁটছিলাম, মনে হচ্ছিল ঝরনার শব্দে পাহাড় যেন গান গাইছিল। শৈবালে ঢাকা পাথরের গায়ে জলধারা নেমে আসছিল ধীরে ধীরে, যেন প্রকৃতি নিজেই ধ্যানমগ্ন। আমি এক জায়গায় বসে দেখলাম-সূর্যের আলো ভেদ করে যখন পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ছে, তখন পুরো দৃশ্যটা এক অদ্ভুত জ্যোতিতে ভরে গেল। মনে হলো, পাহাড়ের দেবতা আজও বেঁচে আছেন এই প্রকৃতির প্রতিটি নিঃশ্বাসে। রক গার্ডেনে গিয়ে চোখে পড়লো পাথরের গায়ে নরম মখমলের মতো সবুজ শৈবাল ঢাকা। তার ওপর দিয়ে ঝরে পড়ছে স্বচ্ছ স্রোত। সূর্যের আলো যখন সেই জলে প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয়, যেন হাজার বছরের প্রার্থনার আলো ঝরে পড়ছে।
গার্ডেনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিলো প্রতিটি পাথরই যেন কোনো অদৃশ্য ইতিহাসের পাতায় লেখা একেকটি শব্দ। পায়ের নিচে মচমচে পাতা, কানে ঝরনার ফিসফিস আর চোখের সামনে সবুজে মোড়া শিলা-সব মিলিয়ে প্রকৃতি এখানে এক জীবন্ত কবিতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এক জায়গায় থেমে চোখ বন্ধ করলাম। মনে হলো প্রতিটি ফোঁটা জলের ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো প্রাচীন মানুষের নিঃশ্বাস, তার আশা আর প্রার্থনা। এই উপত্যকা যেন ইতিহাসের এক নিঃশব্দ দলিল, যেখানে প্রকৃতিই লিখে রেখেছে মানুষ আর বিশ্বাসের গল্প।
শেষ বিকেলে যখন ফেরার পথে দাঁড়ালাম, তখন পাহাড়ের গায়ে সূর্যাস্তের রঙ ছড়িয়ে পড়েছে- কমলা, সোনালি, আর লাল রঙের ঢেউ। মনে হলো, আজকের এই যাত্রা কেবল ভ্রমণ নয়, বরং এক অন্তর্লীন ধ্যান- প্রকৃতি আর আত্মার মিলনের কাহিনি। ঝরনার সুর তখনো কানে বাজছিল। মনে হচ্ছিল, কিছুটা নীরবতা, কিছুটা শান্তি, আর কিছুটা ইতিহাস সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। (শেষ)