নিউইয়র্কের গণপরিবহন সিস্টেম উন্নতির মাঝেও অনিশ্চয়তার মেঘ


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 26-11-2025

নিউইয়র্কের গণপরিবহন সিস্টেম উন্নতির মাঝেও অনিশ্চয়তার মেঘ

নিউইয়র্কের গণপরিবহন ব্যবস্থা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে আবার শক্তভাবে এগিয়ে চলেছে। সাবওয়ে ও বাসে যাত্রী বাড়ছে, কনজেশন প্রাইসিং থেকে আসছে নতুন রাজস্ব, এবং বড় ধরনের অবকাঠামো প্রকল্প আবার গতি পাচ্ছে। তবে এই অগ্রগতির মধ্যেই রয়ে গেছে এক জটিল বাস্তবতা। ফেডারেল সরকারের চাপ, সম্ভাব্য তহবিল সংকট, জলবায়ু ঝুঁকি, ভাড়া চুরি, এবং রাজনৈতিক টানাপড়েন মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটির (এমটিএ) ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে। নিচের এই প্রতিবেদনটি নিউইয়র্কের গণপরিবহনের বর্তমান পথচলা, তার সাফল্য ও সংকট-সব মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে।

এমটিএর বার্ষিক সম্ভাব্য ২০২৬ সালের অপারেটিং বাজেট ২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এই বাজেট যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যের বাজেটের চেয়েও বড়। প্রতিদিন লাখো মানুষকে বহন করা এই দেশসেরা গণপরিবহন ব্যবস্থা ধীরে ধীরে মহামারি-পরবর্তী সময়ে ফিরে এসেছে তার স্বাভাবিক ছন্দে। এ বছরের শুরুতে কার্যকর হওয়া কনজেশন প্রাইসিং ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই শত শত মিলিয়ন ডলারের নতুন তহবিল এনে দিয়েছে, যা পুরোনো অবকাঠামো মেরামত, সিগন্যাল আধুনিকীকরণ এবং নতুন রেল ও সাবওয়ে প্রকল্প এগিয়ে নিতে ব্যবহার হচ্ছে। গ্রীষ্মের শেষে কনজেশন প্রাইসিং থেকে রাজস্ব দাঁড়ায় ৩৬৫ মিলিয়ন ডলারে এবং বছরের শেষে তা ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে বলে অনুমান করা হয়।

নিউ জার্সির মামলাসহ এখনো বেশ কয়েকটি মামলা ফেডারেল আদালতে চলমান থাকলেও কোনোটাই কনজেশন প্রাইসিং স্থগিত করতে পারেনি। জনসমর্থনও সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। একই সময়ে সেকেন্ড অ্যাভিনিউ সাবওয়ের দ্বিতীয় ধাপ, ব্রুকলিন-কুইন্স লাইট রেল এবং গভীরতর সিগন্যাল উন্নয়নসহ নানা প্রকল্পে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব পরিবর্তনের অস্থিরতা কাটিয়ে, ২০২১ সাল থেকে এমটিএ চেয়ারম্যান ও সিইও জ্যানো লিবারের নেতৃত্বে প্রকল্পগুলোর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে।

তবে অগ্রগতির বিপরীতে জমছে অনিশ্চয়তার মেঘ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নিউইয়র্কের গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন প্রকল্পগুলোকে সরাসরি নিশানা করেছেন। কনজেশন প্রাইসিং বাতিলের চেষ্টা, সেকেন্ড অ্যাভিনিউ সাবওয়ে ও গেটওয়ে টানেল প্রকল্পের বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল তহবিল স্থগিত ঘোষণা এবং ফেডারেল পরিবহন সচিব শন ডাফির কটূক্তিসুলভ মন্তব্যসহ সব মিলিয়ে নিউইয়র্কের গণপরিবহন ভবিষ্যৎকে নতুন চাপের সম্মুখীন করেছে। যদিও এমটিএ কর্মকর্তারা বলছেন যে তারা ফেডারেল নীতিমালার পরিবর্তন মেনে চলছে এবং অর্থ শেষ পর্যন্ত আসবে, তবুও অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।

নিউইয়র্ক স্টেট কম্পট্রোলার টমাস ডিনাপোলির অক্টোবর মাসের রিপোর্টে সতর্ক করেছেন যে অর্থনীতি মন্থর হলে যাত্রীসংখ্যা কমতে পারে, যা রাজস্বে শত শত মিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি করবে। একই সঙ্গে বাসে ব্যাপক ভাড়া চুরি যেখানে কিছু রুটে অর্ধেক পর্যন্ত যাত্রী ভাড়া দেয় না এবং সাবওয়েতেও উল্লেখযোগ্য ভাড়া ফাঁকি এমটিএ-র আয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সিটিজেনস বাজেট কমিশনের হিসেবে, ২০২৫ সালে ভাড়া ও টোল ফাঁকি মিলিয়ে ক্ষতি হতে পারে ৯০০ মিলিয়ন ডলার।এটি সংগৃহীত মোট ভাড়ার প্রায় এক-চতুর্থাংশ।

জলবায়ু পরিবর্তন আরেক বড় আতঙ্ক। ঘন ঘন প্রবল বৃষ্টি, উপকূলীয় বন্যা ও সুপারস্টর্ম স্যান্ডির মতো বিপর্যয় দেখিয়েছে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সাবওয়ে অবকাঠামোকে কত দ্রুত ধ্বংস করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরেই বলছেন নিউইয়র্কের পরিবহন অবকাঠামো ভবিষ্যৎ জলবায়ুর ঝুঁকির জন্য প্রস্তুত নয়।

অন্যদিকে এমটিএর আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা অব্যাহত। নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের রিপাবলিকান সিনেটর স্টিভেন রোডস অভিযোগ করেছেন, প্রতি বছর এমটিএ নতুন তহবিল চায় কিন্তু অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে তার জবাবদিহি নেই। তিনি একটি স্বাধীন ফরেনসিক অডিটের দাবি জানিয়েছেন। তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞ সারাহ কাউফম্যান বলেন, এমটিএর প্রকৃত সমস্যা অপর্যাপ্ত বিনিয়োগযা না হলে সুদূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা অসম্ভব।

আগামী বছর নিউইয়র্কবাসীকে ভাড়া বৃদ্ধির মুখোমুখি হতে হবে। সাবওয়ে ও বাসের বেসিক ভাড়া বাড়বে ১০ সেন্ট, এক্সপ্রেস বাসে ২৫ সেন্ট, আরলং আইল্যান্ড রেল রোড ও মেট্রো-নর্থে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। সেতু ও টানেলের টোলও বাড়বে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। রোডস বলেন, ভাড়া বাড়ালে মানুষ গণপরিবহন থেকে বিমুখ হবে এবং কনজেশন প্রাইসিংয়ের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।

অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে নতুন চাপ তৈরি করেছেন নিউইয়র্ক সিটির নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি, যিনি বিনামূল্যে বাস পরিষেবার পক্ষে। তিনি আরো বাস লেন তৈরি এবং ডাবল পার্কিং কঠোরভাবে দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গভর্নর ক্যাথি হোচুল বলেন, তিনি পুরোপুরি বিনামূল্যে বাস পরিষেবার পক্ষে নন, তবে নিম্নআয়ের যাত্রীদের ভাড়া ছাড় দিতে চান।

এদিকে অ্যালবানি রুটে অ্যামট্রাক সেবার সংকট মোকাবিলায় হোচুল মেট্রো-নর্থের একটি নতুন ট্রেন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন, যা অ্যামট্রাকের তুলনায় সস্তা হবে। পাশাপাশি তিনি ইন্টারবোরো এক্সপ্রেস প্রকল্প ব্রুকলিন-টু-কুইন্স লাইট রেল পরিবেশগত পর্যালোচনার জন্য অনুমোদন দিয়েছেন। ট্রেন স্টেশন সংস্কার প্রকল্পে হোচুলের নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করে ফেডারেল সরকারের হাতে হস্তান্তরের সিদ্ধান্তএবং প্রাক্তন এমটিএ কর্মকর্তা অ্যান্ডি বাইফোর্ডকে নেতৃত্ব দেওয়া নিউইয়র্কের পরিবহন রাজনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। অনেকেই মনে করছেন, ফেডারেল সরকারের হস্তক্ষেপ প্রকল্প এগিয়ে নেবে, আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, হস্তক্ষেপ প্রকল্পকে ধীরও করতে পারে। সমগ্র পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে এমটিএর সামনে আগামী বছরটি কঠিন পরীক্ষার। ফেডারেল চাপ, ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ, জলবায়ু ঝুঁকি, আর্থিক ঘাটতি ও নতুন পরিবহন পরিকল্পনাসহ সব মিলিয়ে নিউইয়র্কের গণপরিবহনের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি ও অনিশ্চয়তার এক জটিল দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে আছে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)