ষাট, সত্তর দশকের তিলোত্তমা ঢাকা নগরী এখন যানজট, জলজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, চাঁদাবাজি, চিন্তায়, মবসন্ত্রাসের চারণভূমি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশ। অনেকেরই দূরন্ত কৈশোর, সৃজনশীল কৈশোর কেটেছে ছায়া, সুনিবিড় শান্তির শহর অনেক প্রতিশ্রুতির ঢাকায়। চারদিকে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদী, নগরজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খাল-জলাশয়। পুষ্প পল্লবে সুশোভিত ঢাকা নগরীর সম্ভাবনা ছিল প্রাচ্যের ভেনিস বা আমস্টারডাম হিসেবে গড়ে ওঠার। কিন্তু মহান স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর জাতিগত ব্যর্থতার কারণে অসংখ্য ব্যর্থতার পুঞ্জীভূত প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা একটি পরিত্যক্ত নগরী হতে চলেছে। কোনো পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা কাজে আসেনি। সমাজের সব স্তরের দুর্বৃত্তায়নের কারণে নদী-খাল, জলাশয়গুলো দখল হয়েছে, অবৈধভাবে দখল করা প্লাবন ভূমিতে নির্মাণ বিধি না মেনে নির্মিত হয়েছে আকাশছোঁয়া অনেক সুরম্য অট্টালিকা। পুরোনো ঢাকার কথা বাদ দিলাম ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা এখন কংক্রিটের বস্তি। অপরিকল্পিভাবে ভুগর্ভস্ত পানি ব্যবহার করে পানির স্তর নামিয়ে ঢাকার তলদেশ ফাঁকা করা হয়েছে। যাতে এখন নতুন যোগ হয়েছে ভূমিকম্প আতঙ্ক। যে হারে ভূমিকম্প মৃদু থেকে বড় আকরের আঘাতে কাঁপাচ্ছে, তাতে ভয়ানক কিছু একটা ঘটে যায় কি না, তেমনই আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে।
রাজধানীতে উন্নয়নের নামে হয়েছে ব্যাপক বৃক্ষ নিধন। সবুজ বলতে অবশিষ্ট আছে সামান্য। যে শহর বড়জোর ৭৫ লাখ থেকে এক কোটি জনধারণ করতে পারে সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করছে সাড়ে ৩ কোটি মানুষ। অপ্রশস্ত সড়কে লাখো যানবাহনে সারাদিন লেগে থাকে যানজট। জলাশয় ভরাট হওয়ায় সামান্য বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলজট। নানা দাবিদাওয়া নিয়ে সড়ক অবরোধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট সৃষ্টি নিত্যদিনের ঘটনা। ঢাকার বাতাসে মিথেন, ধুলোবালি। এমনিতেই ভৌগোলিক এবং ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে ঢাকা আছে ভূমিকম্পের আতঙ্কে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন ৬+ রিখটার মাপের ভূমিকম্প হলেই ধসে পড়তে পারে ৭৫-৮০ শতাংশ ভবন। উপরে থাকা বিদ্যুৎ লাইন, নিচে থাকা গ্যাস পাইপলাইনে আগুন ধরে ঢাকা পরিণত হতে পারে টাওয়ারিং ইনফেরানোতে।
অথচ সবকিছুই হতে পারতো সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাধীনতার আগে বিচক্ষণ মাদানী ঢাকা উন্নয়নের মহাপরিকল্পণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পরেও নানা সরকার বিদেশি পরামর্শকদের সম্পৃক্ত করে মহাপরিকল্পনা করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং সর্বস্তরে দুর্বৃত্তায়নের কারণে কেউ কারো কথা শুনেনি। সরকারগুলোর ক্ষমতার লোভ, দুর্নীতির কারণে ঢাকার পরিবেশ এখন দারুণভাবে বিষাক্ত বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে। যেভাবে চলছে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু করা না হলে ঢাকা হয়তো পরিত্যক্ত নগরীতে হবে অথবা ভূমিকম্পের মত বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত হবে। যা এখন রীতিমতো মরণফাঁদ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
প্রথমেই প্রয়োজন আরবান-রুরাল রিভার্স মাইগ্রেশন
ঢাকাকে বাঁচাতে সর্বপ্রথম প্রয়োজন ঢাকা থেকে অন্তত ৫০-৬০ শতাংশ জনগণকে ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়া। সেটি করতে হলে পরিকল্পিতভাবে সব কিছু বেকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। মন্ত্রণালয় বিকেন্দ্রীকরণ করে ঢাকা সংলগ্ন জেলাগুলোতে সরিয়ে নিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল ঢাকা থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে সরাতে হবে। ঢাকার আশপাশে শহরগুলোর-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, বিনোদনব্যবস্থা সম্প্রসারিত করতে হবে। ঢাকার কেন্দ্রস্থলে থাকা সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পিলখানা বিজিবি হেডকোয়ার্টার্স পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নিতে হবে। আবাসস্থল ঠিক রেখে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করতে হবে। পুরোনো তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বিমান ঘাঁটি ঢাকার বাইরে নিতে হবে। একই সঙ্গে আবাসিক এলাকায় ব্যাঙের ছাতার উপর গড়ে ওঠা ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠান শিল্পস্থাপনা স্থানান্তর করতে হবে। কিন্তু কে করবে কাজগুলো? ঢাকার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত এই কাজগুলো করতে ঐকমত্য সৃষ্টি করা ছাড়া মুক্তির পথ নেই।
নদী-জলাশয়গুলো দখলমুক্ত করে নদীমাতৃক সংস্কৃতি গড়ে তোলা
দুনিয়ার অধিকাংশ আধুনিক মহানগরী একটি বা বড়জোর দুটি নদীকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আমি লন্ডন, প্যারিস, ভেনিস, আমস্টারডাম, সিডনি, মেলবোর্নে, ব্রিসবেন দেখেছি। ঢাকা প্রাকৃতিকভাবে চার চারটি নদীবেষ্টিত হয়েও সঠিক পরিকল্পনা এবং সব পর্যায়ে দুর্বৃত্তায়নের কারণে সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারেনি। এখনো সুযোগ আছে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করে নদী-খাল, জলাশয়গুলো দখলমুক্ত করে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ পুনরায় উদ্ধার করা। জলপথে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নীত করা, সারফেস ওয়াটার ব্যবহার বাড়ানো এবং পরিবেশ দূষণ রোদ করা। বর্তমান সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। আশা করি, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার উদ্যোগগুলো সফল করবে।
ভূমিকম্প বিষয়ক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ
অবিলম্বে ইতিমধ্যে চিন্নিত বসবাস অযোগ্য ভবনগুলো ভেঙে অপসারণ করতে হবে। ঢাকার অনেক ভবন আছে ২০০-৩০০ বছর পুরোনো। এগুলো অনেক আগেই বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি অনেক সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়েছে সব ধরনের বিধিবিধান অমান্য করে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এগুলো চিহ্নিত করে সংস্কার বা অপসারণ করতে হবে। আবাসিক ভবনের নামে নির্মিত ভবনের বা বাণিজ্যিক ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। অব আবাসিক এলাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় সরিয়ে ফেলতে হবে, ঢাকাজুড়ে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন স্থানে ভূগর্ভস্থ ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করতে হবে। সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্যোগ ব্যবস্থায় ন্যূনতম উপকরণে সাজাতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করতে ফায়ার সার্ভিস এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে। ন্যূনতম সময়ে মাটির নিচে থাকা শতছিন্ন গ্যাস পাইপলাইন পরিত্যক্ত করতে হবে। যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চত করে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার সম্প্রসারণ করতে হবে।
উপরের কাজগুলো করতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে এসে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হবে। কাজগুলো অনেক চ্যালেঞ্জিং হলেও নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানো যাবে না। কিন্তু আমরা নিজেরা জীবন দর্শন পরিবর্তন করে অবশ্যই আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই ঢাকা উপহার দিতে পারবো।