তারেক রহমানের অপেক্ষায় বিএনপি


মাসউদুর রহমান , আপডেট করা হয়েছে : 17-12-2025

তারেক রহমানের অপেক্ষায় বিএনপি

তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচনের বাতাস আরেকটু জোরেশোরে বইছে। জনমনে যেটুকু অস্বস্তি, সেটুকু দূর করতে সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। গত ১৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণেও নির্বাচনে ভোট দেয়া যে কতটা গুরুত্ব, সেটা বলেছেন। আইনশৃংখলাবাহিনী থেকে শুরু করে সর্বস্তরে প্রস্তুতির কথাও তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যতটা না তোড়জোড়, ভোটের মাঠে তার আমেজ সামান্য। বাংলাদেশে এয়োদশ নির্বাচনে কে জয়লাভ করবে এ প্রশ্নে এখন দুটি দলের নামই সর্বাগ্রে। জাতীয়তাবাদি দল বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম জামায়াতে ইসলামী দেশের ক্ষমতা আসার স্বপ্ন দেখছে ও জনগণের কাছে অতীত কর্মকান্ডের জন্য ক্ষমাপ্রার্থণা ও জামায়াত ভালো হয়ে গেছে উল্লেখ করে ভোট চাচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিষয়টা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে জামায়াতের এমন উত্থানে ভীত হচ্ছে আওয়ামী লীগের মত বিশাল বড় দলটি। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ৫ আগস্টের পর পালিয়ে যাওয়া ও বিগত ১৬ বছর তাদের ব্যাপক বিতর্কিত কর্মকান্ড ও জুলাই হত্যাকান্ডের জন্য দলটির কার্যক্রমে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এতে ত্রয়োদশ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই আওয়ামী লীগের অন্তত: প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে। 

ফলে তৃণমূলে কোটি কোটি আওয়ামী লীগ সমর্থক, নেতাকর্মীর যে ভোট তা কে পাবে সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের সমর্থক ও ভোটারদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা স্পষ্ট বলছেন, আওয়ামী লীগ তো ভোটের মাঠে নেই। বা নির্বাচন করতে দেয়া হচ্ছে না। তবে এমন অবস্থায় জামায়াতের যে তোড়জোড় এটা ভাল ঠেকছে না। আমাদের ভোট দিতেই যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তবে পরিস্থিতি যদি শেষ মুহূর্তে বাধ্য করে বা জামায়াতকে বিএনপি কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হয় অনুভব করি, তাহলে ঠিকই ভোট দিতে যাব এবং সে ভোট বিএনপিকেই দেব। কারণ বিএনপি অন্তত: মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল। যারা স্বাধীনতা বিরোধী, বাংলাদেশের বিরোধী তাদের ক্ষমতায় আসা প্রতিহত করতেই হবে। 

আওয়ামী লীগের একাধিক সমর্থকদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় এমন এমন অভিমত পাওয়া গেছে। 

ভোটের মাঠে বিএনপি জামায়াতের অবস্থান  

২০২৪ এর ৫ আগস্টের পর থেকেই জামায়াত তিন শ’ আসনেই তাদের প্রার্থী সিলেক্ট করে মাঠে নামিয়ে দেয়। নির্বাচন যখনই হোক না কেন, দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভোট চাইছেন তারা, সাধারণ মানুষের মন জয় করার চেষ্টায় ব্যস্ত। এটা তাদের পলিসি। এ ক্ষেত্রে প্রথমত তারা ভোট না চাইলেও পরিচিত হয়েছেন। তাদের কর্মকান্ড তুলে ধরেন। এবং সন্ত্রাস, চাঁদাবাজদের ভোট না দিয়ে ভাল মানুষকে ভোট দিয়ে দেশের উন্নতিতে শরীক হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। তৃণমূলের ওই কর্মকান্ডই এখন ভোটের আহ্বানে চলে গেছে। সরাসরি জামায়াতের মার্কায় ভোট চাইছেন। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। জামায়াতের এ প্রচার পরিক্রমা চলছে ব্যাপকভাবে। পোস্টারিং, ব্যানার ফেস্টুনও দেখা যায় বিভিন্ন এলাকায়। মটর সাইকেলে দলবেঁধে মহড়া, অফিসে কার্যক্রম, প্লান কষে ভোটারদের কাছে ভোট প্রত্যাশা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা- সবই চলছে। 

অপর দিকে এমন প্রচারকার্যে বিএনপি নেই বললেই চলে। দেরিতে হলেও বিএনপি ইতিমধ্যে প্রায় সব প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছে। কিছু বাকি থাকলেও সেটা নিয়েও সম্ভব্য প্রার্থীদের দৌঁড়ঝাপ চলছে। কিন্তু যারা মনোনয়ন পেয়েছেন, তারা সেভাবে কার্যক্রম শুরু করেনি এখনও। ইসি কর্তৃক নির্বাচনি তফশিল ঘোষণা হলেও বিএনপি প্রার্থীদের ঘুম ভাঙেনি। প্রার্থীতা সিলেকশন নিয়ে এলাকায় এলাকায় বিভেদ রয়েছে। তারা আন্দোলনও করছেন। কিন্তু এসব মেটানোর কেউ নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীতদের পক্ষে কাজ করার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, প্রার্থী নয়, মার্কা নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি এ কথাও বলছেন বারবার যে এবারের নির্বাচন মোটেও সহজ হবে না। কিন্তু এতেও নড়ছে না কেউ!  

অপেক্ষায় মূলত তারেক রহমান 

বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বেডে সুস্থ্য হয়ে ওঠার লড়াইয়ে। সুস্থ্য যদি তিনি হনও, তার যে তিন আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা, সেটা তিনি সম্ভবত আর পারবেন না। তার অবস্থা বেশ নাজুক। দীর্ঘদিন জটিল রোগে ভুগছেন। সময়মত হয়নি তার যথার্থ ট্রিটমেন্ট। এরপর জেল খেটেছেন। ওই জেল ছিল অস্বাস্থ্যকর একটা স্থানে। এতে করে তার সঠিক চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পর্যাপ্ত মেডিসিন না নেয়াতে তিনি দুর্বল হয়ে গেছেন। জটিল রোগগুলো ঝেঁকে বসেছে তার দুর্বল শরীরে। বিএনপির অগনিত সমর্থক তার জন্য প্রতিনিয়ত দোয়া করছেন। 

খালেদা জিয়ার অবর্তমানে তারেক রহমানই দলের প্রধান ভরসা। তারেক আসছেন, আসছেন বলে একটা দিনক্ষণ এখন ঠিক হয়েছে। আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে পা রাখবেন। তিনি প্রায় দেড়যুগ সময় লন্ডনে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছেন। 

তারেকের অপেক্ষায় এখন বাংলাদেশ এ কথা সত্য। খালেদা জিয়া কোনো এক সময় বলেছিলেন, তারেক বাংলাদেশে ফিরবে বীরের বেশে। খালেদা জিয়ার বহু ভবিষ্যত বাণী সফল হওয়ার সাথে সাথে এ কথাও এখন বাস্তব হচ্ছে। দেশের প্রয়োজনে বিএনপি তো দূরে থাক, আওয়ামী লীগও অপেক্ষায়। কারণ আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্বটা যেন এখন তারেক রহমানের উপর।

বিএনপির প্রার্থীদের অনেকেই গ্রামগঞ্জে যাচ্ছেন- করছেন  হ্যায়, হ্যালো। কিন্তু নির্বাচনী যে ওয়ার্ক, যেমন অফিস স্থাপন, সাধারণ মানুষের কাছে ভোট চাওয়া, মিছিল মিটিং, পোস্টারিং, ব্যানার ফেস্টুন তথা নির্বাচনি প্রচারাভিযান প্রভৃতি কার্যাদি। তবে এসবই যেন তারেক রহমানের দেশে ফেরার জন্যই আটকে রয়েছে! তারেক রহমান যখন দেশে পা রাখবেন তখন থেকেই বিএনপি ভোটের মাঠে তোড়জোড় শুরু করবেন এমন বক্তব্য দলটির তৃণমূলের নেতাদেরও মুখে মুখে। 

নির্বাচনের মাঠে বিএনপির প্রচার প্রচারণা প্রসঙ্গে সদ্য বিলুপ্ত হওয়া বরিশাল মহানগর বিএনপির বন ও পরিবেশ বিষায়ক সম্পাদক হোসেন চৌধুরী এ প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপি এখনও সেভাবে মাঠে নামেনি প্রচারণায়। বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেও কিছুটা ঢিলেমিও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর ভোট দিতে না যেয়ে যেয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা অনীহাভাব চলে এসেছে। বরিশালের সেন্ট্রালে মজিবর রহমান সারোয়ার মনোনয়ন লাভের পর বহু নেতাকর্মী এসে উচ্ছাস প্রকাশ করেন। বেশ কিছুদিন তারা আসা যাওয়া তথা সরব থাকলেও বর্তমানে কিছুটা পিছু টান দিয়েছেন। এরকারণ সকলেরই ব্যাক্তিগত কাজকর্মের ব্যস্ততাও থাকতে পারে। জামায়াতের প্রচারণা প্রসঙ্গে হোসেন চৌধুরী বলেন, হ্যাঁ, ওরা সাংগঠনিকভাবে বরাবরই সংগঠিত। ভোটার কম থাকলেও তারা আর্গানাইজ হয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা সংগঠন ও আর্থিক সব দিক থেকেই বর্তমানে শক্ত অবস্থানে। বিএনপির নেতাকর্মীরা দীর্ঘ ১৭ বছর নির্যাতনের শিকার। অনেকেই বিগত সরকার কর্তৃক মিথ্যা মামলা মোকদ্দমায় নিঃস্ব। এদের অনেকেরই চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য যা ছিল তা আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটাই শেষ করে দিয়েছে। ফলে নেতাকর্মীরা বিভিন্ন দিক থেকে দুর্বল। বিএনপি এ নেতা আরো বলেন, এখনও তো সময় রয়েছে। তারেক রহমানও আসছেন। ফলে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে সময় নাও লাগতে পারে। তাছাড়া দলের নেতাকর্মীদের অনেকেই মনে করে আওয়ামী লীগ না থাকায় এক তরফা জিতবে বিএনপি। এ ব্যাপারে বিএনপি ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। জামায়াত সেখানে বাধা হওয়ার সুযোগ নেই। কিছুটা রিল্যাক্স মুড এটাও একটা কারণ। তাছাড়া জনগণের কাছে বিএনপি পরিক্ষীত। গত ১৭ বছরে বিএনপির উপর যে অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে সেটাও মানুষ জানে। ফলে সঠিকভাবে দেশ চালাতে বিএনপির বিকল্প নেই- মানুষ সেটা খুব ভালই জানেন। এসব কারণে আপাতত বিএনপির নেতাকর্মীরা কিছুটা নিস্প্রভ বলে আমার মনে হচ্ছে। 

তারেক রহমান আসছেন, তার এ আগমন বা দেশে ফেরা তৃণমূলে কী কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে হোসেন চৌধুরী বলেন, অবশ্যই। দীর্ঘদিন পর নেতা ফিরছেন। এটা বিএনপির জন্য একটা গণজোয়ার সৃষ্টি হতে পারে। তিনি সাংগঠিক কর্মকান্ড সুদূর লন্ডন বসে চালিয়েছেন। এখন দেশে ফিরে সরাসরি প্রত্যক্ষ করবেন। নেতাকর্মীরা তাকে কাছ থেকে পেয়ে উজ্জীবিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। এতে ভোটের মাঠও সরগরম বাড়বে নিঃসন্দেহে। ভোটের মাঠে বিএনপি পরীক্ষিত দল। নেতাকর্মী এমন কি সাধারণ মানুষও জানেন। ফলে বিএনপি তারেক রহমানের নির্দেশনায় ব্যাপক প্রচারণা শুরু করলে এসব দুর্বলতা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আশা করছি বিএনপির প্রতি মানুষ গণজোয়ার সৃষ্টি করবে।  

ভোটের মাঠে বিএনপি ও জামায়াতের প্রচারণা প্রসঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলে সুনামের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়া সিনিয়র সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ এ প্রতিবেদককে জানান, সত্যি বলতে কী, বিএনপি ভোটের মাঠে প্রচারণা শুরুই করেনি সেভাবে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে তৃণমূলে অনেকেই গত বেশ কিছুদিন থেকে দোয়া, মিলাদসহ এ জাতীয় কার্যক্রম চালিয়েছে। এ ছাড়া এয়োদশ নির্বাচনের জন্য যারা মনোনয়ন পেয়েছেন সে সব প্রার্থীরাও এখনও মাঠে নামেনি সেভাবে। তবে এ ক্ষেত্রে জামায়াত ব্যাতিক্রম। দীর্ঘদিন থেকেই চষে বেড়াচ্ছেন। প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। তাদের পক্ষে নেতাকর্মীরাও ভোটারদের দ্বারস্ত হচ্ছেন। উঠান বৈঠক করছেন। লিফলেট দিচ্ছেন। তফশিল ঘোষণার পর থেকে প্রচারণায় কিছুটা বিধি নিষেধ থাকলেও ওই সময়ের পর আবারও তারা প্রচারণায় নামবে বলে অনুমান করা গেছে। 

বিএনপি কেন প্রচারণায় পিছিয়ে এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বগুড়া ৬ এ তারেক রহমান ও বগুড়া ৭ এ বেগম খালেদা জিয়া। তাদের পক্ষে কেউ কেউ প্রচারণা চালাচ্ছেন সেটা ঠিক। তবে এরা জাতীয় পর্যায়ের নেতা। তাদের প্রসঙ্গ আলাদা। অন্যরা এখনও কেন সেভাবে নামছেন না সেটা বোধগম্য নয়। হয়তো তারেক রহমান দেশে ফিরলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হতে অবশ্যই ভোটের মাঠে ভোটারের দ্বারস্থ হতে হবে। ভোটের মাঠে দীর্ঘ অনুপুস্থিত থাকা বিএনপি সেটা জানে। তারেক রহমান ফিরলে তার নির্দেশনা মোতাবেক দলটির নেতাকর্মীরা সক্রিয় হবেন এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ভোটের মাঠ নিয়ে শুধু এ দুইজনই নন, এমন চিত্রটা যেন সারা দেশজুড়েই। তবে কিছুটা ব্যাতিক্রম হতেই পারে। তবু বিএনপির ভোটের মাঠের প্রচারণা তারেক রহমান ফিরলেই জোরেশোরে চলবে, সে অপেক্ষাতেই যেন সবাই।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)