নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুদের খেলার গুটি বানানো হয়


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 27-06-2023

নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুদের খেলার গুটি বানানো হয়

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক মাত্রায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, অতীতে যেকোন নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে সংখ্যালঘুদেরকে টার্গেট করে একটি বিশেষ মহল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। তাদের লক্ষ্য একটাই- দেশটাকে সংখ্যালঘু শূণ্য করা। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের অবস্থ কি দাঁড়াবে তা নিয়ে আমরা উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেও এই আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তাকে বলেছি, নির্বাচনের আগে আমাদের বড় ভয় হয়। কারণ নির্বাচন এলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদেরকে খেলার গুটি বানানো হয়। 

রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে সম্প্রতি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ঢাকা বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত এসব কথা বলেন। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু বিষয়ক জাতীয় কমিশন গঠন, দেবোত্তর সম্পত্তি আইন প্রণয়ন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও পার্বত্য ভূমি কমিশন যথাযথ বাস্তবায়ন, সমতলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ সরকারি দলের বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুত সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব অঙ্গিকারসমূহ বাস্তবায়নের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই প্রতিনিধি সভা আয়োজন করা হয়। 

অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত আরো বলেন, সংবিধান এখনো ধর্মনিরপেক্ষ হয়নি, আমরা এখনও রাষ্ট্রধর্ম থেকে মুক্তি পাইনি। বরং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসকের করা রাষ্ট্রধর্মের বিধানকে সংবিধানে পাকাপোক্ত রূপ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে সংখ্যালঘুদের নিয়ে এই অবস্থা রোধ করতে হলে অবশ্যই সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও সংখ্যালঘু বিষয়ক জাতীয় কমিশন গঠনসহ ৭ দফা দাবি  দফা বাস্তবায়ন করতে হবে। এই ৭ দফা কেবল আমাদের দাবি নয়, বরং আমাদের দাবিকে আমলে নিয়ে বিগত নির্বাচনের আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই দাবিগুলো বাস্তবায়ননের অঙ্গিকার করেছিলো। তাই এই ৭ দফা এখন সরকারি দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এগুলো বাস্তবায়ন সরকারের রাজনৈতিক দায়িত্ব। এই দাবিতে আমরা একাধারে আলোচনা ও আন্দোলন অব্যাহত রাখবো।

অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে লেখা ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠির প্রসঙ্গে বলেন, ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠিতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্ত কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে যে কথা বলা হয়েছে, তা ঠিক নয়। বরং পাকিস্তান আমল থেকেই এদেশে সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া চলে এসেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছিলো। একে বলা চলে ‘ইথনিক ক্লিনজিং প্রসেস’। আমরা আশা করেছিলাম, স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রসেস থেকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সরকারি ও বেসরকারি লেবাসে বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তানী ধারায় নিয়ে যাওয়ার তৎপরতা শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে সামরিক ফরমান বলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক সংবিধানে পরিণত করা হয়। ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আড়াই কোটি মানুষকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয় এবং পাকিস্তানী সংখ্যালঘু সংকোচন নীতিকে খন্দকার মোস্তাক, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ এগিয়ে নিয়ে যায়। এই অপতৎপরতা থেকে আমরা এখনও মুক্তি পাইনি। 

সম্প্রতি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রাণা দাশগুপ্ত বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে একটানা সংখ্যালঘু নির্যাতন চালানো হয়েছে। ঐ ঘটনায় বর্তমান রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে সাহাবুদ্দিন কমিশন বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে। ওই তদন্ত কমিটির কাছে আমরা ৫৮ হাজার ঘটনার তথ্য উপাত্ত দিয়েছি। ২০১১ সালে ঐ কমিশন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করে। ঐ রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছিলো বিএনপি ও জামায়াতের কোন কোন নেতা কোথায় কীভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন-নিপীড়ন করেছিলো। সাহারা খাতুনের কাছে আমরা বারবার বলেছি ঐ রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে। পরবর্তীতে মহিউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে তার কাছেও আমরা বারবার ধর্ণা দিয়েছি। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছেও বারবার বলেছি। কিন্ত আজ পর্যন্ত ঐ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। কল্যাণ ফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলনে একপাক্ষিকভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কেবল আওয়ামী লীগ আমলের ১৩ বছরের সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের নির্যাতন-নিপীড়নের কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই তাদের বক্তব্য রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় সংগঠন নয়, নিরপেক্ষভাবেই আমরা সকল সরকারের আমলের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাবলি তুলে ধরে সমঅধিকার ও সমমর্যাদা রক্ষার লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।

রাণা দাশগুপ্ত বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশকে আফগানিস্তান, ইরাক, সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। তারা দেশকে সংখ্যালঘু শূণ্য করতে চায়। বাংলাদেশ সোমালিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক হয়ে যাক তা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক মেনে নিতে পারে না। তিনি সব রাজনৈতিক দলকে ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই স্লোগানের সঙ্গে ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই’ এই লাইনটি যুক্ত করার আহ্বান জানান।

অধ্যাপক আবুল বারকাতের সংখ্যালঘু বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে রাণা দাশগুপ্ত বলেন, চলমান সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আগামী দুই দশক পরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া যাবে না।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও ঢাকা বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর চিত্ত রঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে প্রতিনিধি সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, প্রেসিডিয়াম সদস্য যোসেফ সুধীন মণ্ডল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ। সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অতুল চন্দ্র মণ্ডল। এছাড়াও জেলা নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মুন্সীগঞ্জ জেলা সভাপতি এ্যাড. অজয় চক্রবর্ত্তী, নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি প্রদীপ কুমার দাস, নরসিংদী জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্ত্তী, মাদারীপুর জেলা সভাপতি শ্যামল দে, ঢাকা জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার দাস, নারায়ণগঞ্জ মহানগর সাধারণ সম্পাদক নিমাই দে, গাজীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. নির্মল চন্দ্র মল্লিক, টাঙ্গাইল জেলা সাধারণ সম্পাদক সমরেশ পাল, গোপালগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক দুলাল বিশ্বাস, শরীয়তপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত ঘোষ রানা, কিশোরগঞ্জ জেলা আহ্বায়ক অধ্যাপক প্রণব কুমার সরকার, মানিকগঞ্জ জেলা নেতা অ্যাডভোকেট দীপক ঘোষ। সভা সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মতি লাল রায় ও ঢাকা মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হৃদয় চন্দ্র গুপ্ত।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)