১০ ডিসেম্বর ঘিরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 06-12-2023

১০ ডিসেম্বর ঘিরে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা

১০ ডিসেম্বর। সাধারণভাবে এটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। কিন্তু সাম্প্রতিককালের বছরসমূহে ১০ ডিসেম্বর একরকম আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বাংলাদেশে। এ দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশের মানুষ এখন উসখুস করতে শুরু করে। ২০২১ সালের এ দিবসে ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের সাবেক ও সে সময়ের দায়িত্বপালন করা সাত কর্মকর্তার ওপর দেওয়া হয় মার্কিন স্যাংশন। যা নিয়ে হয় তোলপাড়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার বহু প্রচেষ্টা করেও সে স্যাংশন থেকে অব্যাহতি পায়নি।


মার্কিনিদের সঙ্গে বহু আলোচনা বিভিন্ন পর্যায়ে হয়েছে। কিন্তু উত্তর এসেছে একটাই যে, কারণগুলোর পরিপেক্ষিতে ওই মার্কিন স্যাংশন সেটাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি ঘটলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ থেকেই প্রত্যাহার করে নেবে। অদ্যাবদি ওই বিষয়ে আর কোনো টু শব্দ নেই। ভুক্তভোগীদের কিছুই করার নেই। ২০২২ সনের ডিসেম্বরেও অনুরূপ আরেক স্যাংশনের বেশ আওয়াজ ওঠে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতায়। কিন্তু সেটা আর হয়নি। এ নিয়ে রঙ্গ ব্যঙ্গ কম হয়নি। ওইদিন ঢাকায় বিএনপি মহাসমাবেশ করেছিল। যদিও সে সমাবেশ ঘিরে অনেক নাটকীয়তা হয়। 

আবারও এক ১০ ডিসেম্বর সমাগত। আর সপ্তাহ খানের মধ্যেই ওই দিবসটা চলে আসছে। এ দিবস ঘিরেও গুঞ্জনের অন্ত নেই। 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ দিবসেই একটা মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনা করেছে ঢাকায়। কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতায় এ দিবস বাংলাদেশে সরকারিভাবেই নরমাল অফিস ডে। এমন অফিস ডেতে আওয়ামী লীগ তো দূরে থাক, বিরোধীদল বিএনপিও কোনো মহাসমাবেশের কর্মসূচি দেয়নি বা দিচ্ছে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের কেনই এদিন বেছে নেওয়া এটা এখন আলোচনার ডালপালা ছড়াচ্ছে। 

তাহলে এ দিনে কী আবারও কোনো মার্কিন বা আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে কোনো শাস্তির খড়গ নেমে আসছে? ইতিমধ্যে ইসি থেকে এ ব্যাপারে আপত্তি এসেছে। ইসি জানিয়েছে, এখন মহাসমাবেশ করতে আওয়ামী লীগকে ইসির অনুমতি নিতে হবে। সেটা পরের কথা, আওয়ামী লীগ অনুমতি পেলে মহাসমাবেশ করবে, নতুবা নয়। বিএনপি এমন কিছু পরিকল্পনা করতে পারছে না এ কারণে যেহেতু দলটির অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা কারাগারে বিভিন্ন মামলায়। 

কী হতে পারে ১০ ডিসেম্বর?

বেশ কিছুদিন যাবৎ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে গুঞ্জন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারও একটা নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন দিতে যাচ্ছে। কবে নাগাদ ওই ধরনের সম্ভাবনা সেটা পরিষ্কার করতে না পারলেও আগামী ১০ ডিসেম্বর নাগাদ এমন এক সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহল থেকে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেহেতু এটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জাতিসংঘের পানেও। 

সম্প্রতি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করে গত ২০ নভেম্বর দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) মো. সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত এক চিঠি প্রেরণ করেছে। সেখানে উল্লেখ করেছেন তিনি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইস্যু করা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের ঘোষণা দেওয়া ‘মেমোরেন্ডাম অন অ্যাডভান্সিং ওয়ার্কার এমপাওয়ারমেন্ট, রাইটস অ্যান্ড হাই লেবার স্ট্যান্ডার্ডস গ্লোবালি’ শীর্ষক সংকলিত রিপোর্টটি সদয় বিবেচনার জন্য। যদিও এই ‘মেমোরেন্ডাম’ মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সব দেশের ওপরই প্রযোজ্য, তবু এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এর অন্যতম টার্গেট হতে পারে বাংলাদেশ। রিপোর্টটি প্রকাশের সময় নির্দিষ্ট করে বাংলাদেশের শ্রম ইস্যুকে উদ্ধৃত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভারপ্রাপ্ত শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী। 

এই ‘মেমোরেন্ডাম’ অনুযায়ী, শ্রমবিষয়ক ইস্যুগুলোতে সরাসরি প্রভাব (ইন্টার‌্যাক্ট/ডিল) বিস্তার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক মিশনগুলো। এই নীতির ফলে অনেক অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপে আগ্রহী মার্কিন কূটনীতিক বা মিশনগুলো উৎসাহিত হতে পারে। দৃশ্যত যদি তারা মনে করে বা বিশ্বাস করে যে, শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তাহলে এই সুযোগকে যে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরোপ করা হতে পারে। এই ‘মেমোরেন্ডামের’ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বহু কারণে উদ্বেগজনক হতে পারে। ‘মেমোরেন্ডামে’ শ্রম অধিকার বিষয়ে যা বলা হয়েছে, তার নেপথ্যে আছে রাজনীতি। যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন উপায়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে তা। তাই এই ‘মেমোরেন্ডাম’ বাংলাদেশের জন্য একটি সিগন্যাল। কারণ ‘মেমোরেন্ডামে’ বর্ণিত শ্রম ইস্যুর অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে। এই মেমোরেন্ডাম বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট অংশীদারদেরকে আগে থেকেই বিষয়টি আমলে নেওয়া উচিত।’

জাতিসংঘের কঠোর সতর্কবার্তা

বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে সবার অংশগ্রহণে। আবারো সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ। গত পহেলা ডিসেম্বর শুক্রবার, জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এক প্রশ্নের জবাবে এই তাগিদ দেন। এ সময় তিনি দেশের জনগণের ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সব পক্ষকে একযোগে কাজ করারও আহ্বান জানান। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক এ বিষয়ে ইংরেজিতে যে বাক্যটি বলেছেন, তা এরকম ‘দ্য ইনক্লুসিভ ইলেকশন্স বি ইনক্লুসিভ অ্যান্ড পিসফুল’। অর্থাৎ অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও সবার অংশগ্রহণে।

জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র আরো বলেন, ‘আমাদের পরামর্শ হলো নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সরকার, বিরোধী দল, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজসহ সবাই মিলে নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য কাজ করুন; যাতে মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেদের মতপ্রকাশ করতে পারে, স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে এবং যাতে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হয়।’

সবশেষে

জাতিসংঘের আহ্বান খুবই রূঢ় ভাষায় সেটা বলাই যায়। কারণ যে সময় এ আহ্বান জানানো হয়েছে, তখন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা শেষে ভোটের তারিখ (৭ জানুয়ারি) নির্ধারিত এবং মনোনয়নপত্র জমাদানের সময়ও শেষ। অথচ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি দল এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। যারা দীর্ঘদিন থেকেই দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, নির্বাচন অবাধ, গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু হচ্ছে না বলেই। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ২০১৪ ও ২০১৮ সনের জাতীয় নির্বাচন। এর সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনও রয়েছে। ফলে ওইসব রাজনৈতিক দল বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মানেই আরেকটি ২০১৮ ও ২০১৮ টাইফের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাকে সহযোগিতা করা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ এক কথায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশসমূহ চায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যা হবে আন্তর্জাতিক মানের। জাতিসংঘও এখন সেটাই বলছে। ফলে জাতিসংঘের এমন আহ্বান মোটেও উপেক্ষার সুযোগ নেই। এবারই তারা এমন কথা বলেনি, আরো আগ থেকে তারাও বলে আসছে। 

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনীতি, বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় থেকে শুরু করে গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা এবং তাদের আন্দোলনে কঠোররতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্দোলন দমাতে লাঠিপেটা, গুলি, টিয়ারশেল ব্যবহার করাতে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে উপরোল্লিখিত পক্ষ। এবার সে প্রেক্ষিতে কোনো বড় শাস্তির খড়গ নেমে আসে কি না এমন শঙ্কা বাংলাদেশের জনমনে। আর সেটা এই ১০ ডিসেম্বরেই নেমে আসতে পারে কি না সে উৎকণ্ঠাও এড়ানো যাচ্ছে না।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)