প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানুষ সৃষ্ট সংকটের কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বলয় বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় আঞ্চলিক এবং বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই কোভিড প্যানডেমিক, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সম্ভাবনা বিশ্বকে আতঙ্কিত করে রেখেছে।
এরই মধ্যে দেশে দেশে বৃক্ষনিধন, জলাশয় বেদখল, ফসিল ফুয়েল যথেচ্ছ ব্যবহারজনিত কারণে পরিবেশ বিরূপ আচরণ করছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রচণ্ড শীত এবং মারাত্মক দাবদাহ বিরাজ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে চার টার্ম ক্রমাগত দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সরকার। দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও দেশে গণতন্ত্র দৃঢ় ভিত্তি পায়নি। সুশাসন, আইনের শাসনের অভাবে দুর্নীতি, লুটেরা অর্থনীতি সমাজে শ্রেণি-বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। সৃজনশীল জন কল্যাণমূলক রাজনীতি দেশে অনুপস্থিত। রাজনীতি ভীষণভাবে কলুষিত। লুটেরা ব্যবসায়ী, দুর্নীতিপরায়ণ আমলাদের নিয়ন্ত্রণে রাজনীতি শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা আর ক্ষমতা অর্জনের নির্লজ্জ কার্যক্রমে সীমিত।
দীর্ঘসময় একাধারে ক্ষমতায় থাকার কারণে শাসক দলের নেতা-নেত্রীদের বৃহৎ অংশ তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকে পরিণত। তৃণমূলের সঙ্গে যে বিস্তর দূরত্ব তৈরি তার জ্বলন্ত প্রমাণ উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রধান বিরোধীদলসহ অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। কিন্তু এরপরও নির্বাচনের মাঠ উত্তপ্ত। কেন্দ্রের কথা শুনছে না। চিত্র ভেসে উঠছে বর্তমান নেতা ও সাবেকদের সঙ্গে যে দূরত্ব বা দ্বন্দ্ব সেটা। বলতে দ্বিধা নেই, কেন্দ্রের সিনিয়রদের তৃণমূলে যোগাযোগ থাকলে এতোটা নিয়ন্ত্রণহীন হতো না।
বিরোধীদল দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে। জনঘনিষ্ঠ বিষয় নিয়ে সঙ্গবদ্ধ হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। এতে করে নির্বাচনসমূহ মূলত এককেন্দ্রিক এবং অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে শাসক দল রাজনীতিকদের চেয়ে সুযোগসন্ধানী আমলাদের ওপর একান্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় দেশ মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ সমতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে ধনী-গরিবের বিভাজন সৃষ্টি করেছে। কিছু মানুষ অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থবিত্তের অধিকারী হয়ে দেশ বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। সীমাহীন দুর্নীতি, অবাধ লুটপাট নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রকৃতপক্ষে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। ব্যাংকিং তথা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারল্য সংকট, সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেনার দায়ে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যক্রম সরকার ঘনিষ্ট সিন্ডিকেটগুলোর কারসাজিতে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারছে না।
অথচ এই দেশের সৃজনশীল কৃষকসমাজ নিয়মিত সোনার ফসল ফলাচ্ছে, পরিশ্রমী শ্রমিক সমাজ দেশে-প্রবাসে কাজ করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। কিন্তু সরকারি অব্যবস্থাপনার কারণে কৃষক না পাচ্ছে ফসলের সঠিক মূল্য, শ্রমিক না পাচ্ছে শ্রমের মূল্য। মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট তৈরি করে লুটে খাচ্ছে চাষির শ্রমের প্রকৃত মূল্য। লুটেরা গোষ্ঠী দুর্নীতি করে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। মাঝেমধ্যে চুনোপুঁটিদের ধরা হলেও দুর্নীতির মাস্টার মাইন্ডরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অনেকের অভিযোগ ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট লুটেরা অনেকেই নিরাপদে থেকে রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।
দেশে উন্নয়নের জোয়ারের আড়ালে সুবিধাবাদী কতিপয় আমলা, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী মহল লুটপাট করে হাজার কোটি টাকা অর্জন করেছে। অথচ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সৎ-নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আছে নিদারুণ আর্থিক সংকটে।
প্রধান বিরোধীদল বিএনপির কথাই ভাবুন। ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে। সরকারি ফাঁদে পা দিয়ে নানাভাবে বিতর্কিত হয়ে এখন অনেকটা অসহায়। দলপ্রধান আদালতে দণ্ডিত হয়ে সাজা ভোগ করছেন। ছেলে নানা দুষ্কর্মের জন্য দণ্ডিত হয়ে দেশের বাইরে। দল চলছে ঝিমিয়ে সঠিক দিকনির্দেশনাবিহীনভাবে। দলের তৃণমূল নানা কারণে হতাশ। জাতীয় পার্টি চলছে সরকারি নির্দেশে সরকারের দয়ায়। অন্যান্য বিবৃতিসর্বস্ব ডানবাম তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর কথা নাই-বা বললাম। দেশের ক্রান্তিলগ্নে শক্তিশালী সুসংগঠিত বিরোধীদল থাকা শাসক দল তথা, গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। প্রয়োজন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন।
দেশে কিন্তু মেধাবী তরুণসমাজ অত্যন্ত সৃজনশীল। সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারলে তরুণসমাজ কিন্তু দেশের খোল নলচে পাল্টে দিতে পারে। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থায় মেধাবী তরুণরা কিন্তু অতিমাত্রায় বিদেশমুখী। সরকার সবক্ষেত্রে দুষ্টের দমন এবং সিস্টের পালন নিশ্চিত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে অচিরেই গভীর থেকে গভীরতর সংকটে পড়বে দেশ।
আশা করি, সরকারপ্রধান পরিস্থিতির গভীরতা অনুধাবন করে ন্যূনতম ইস্যুর ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেবেন। বর্তমান অবস্থায় প্রভাবশালী প্রতিবেশীর পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যাবে না-এটি সরকারপ্রধানের বোঝার মতো রাজনৈতিক পরিপক্বতা আছে বলেই মনে করি।