লু প্রশ্নে মন্ত্রীর রেগে যাওয়ার পেছনে কি?


সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ , আপডেট করা হয়েছে : 15-05-2024

লু প্রশ্নে মন্ত্রীর রেগে যাওয়ার পেছনে কি?

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু নিয়ে প্রশ্ন করাতেই একজন মন্ত্রীর রেগে যাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এভাবে রেগে যাওয়া নিয়ে দলের ভেতরেই একেক জন একেক রকম ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ডোনাল্ড লু’কে গুরুত্বপূর্ণ না ভাবা হলে বা তার আগমনে সরকারের কিছু আসে যায় না থাকে- তাহলে এধরনের প্রতিক্রিয়ার হেতু কি? কি আছে এর পেছনে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। 

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত ১৪ মে মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ডোনাল্ড লুকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (উত্তর আমেরিকা অনুবিভাগ) খন্দকার মাসুদুল আলম। 

ডোনাল্ড লু নিয়ে কে কি বললেন?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু’কে দাওয়াত করে আনা হয়নি। তিনি নিজ দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আলোচনা করতে এসেছেন। তাকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? কোনো ভিসা নীতি, নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করে না সরকার। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিসহ কোনো ইস্যুকেই আমরা কেয়ার করি না। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় কালে তিনি এসব কথা বলেন। সেখানে উপস্থিত গণমাধ্যমের একজন কর্মী দেশ প্রতিনিধিকে জানান তাদের প্রশ্নে অনেকটা রেগে গিয়েই এমন মন্তব্য করেছেন বলে তার ধারণা। ওবায়দুল কাদের এ-ও বলেন, ডোনাল্ড লু’কে বিএনপি উপরে উপরে পাত্তা না দিলেও তলে তলে আবার কি করে কে জানে!

গঠনমূলক মন্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর 

ডোনাল্ড লু'র সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ গঠনমূলক মন্তব্য করেছেন। সফরকালের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি সহজীকরণ এবং র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে তার সাথে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। ১৩ মে সোমবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিলনায়তনে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ সম্পাদিত ’পদ্মা ব্রিজ : এন এপিক একমপিশমেন্ট’ গ্রন্থ এবং হাসানুজ্জামান মাসুম রচিত ’সোনার বাংলাদেশ দেখতে চাই’ দেশাত্মবোধক ভিডিও সংগীত উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। এর পাশাপাশি তিনি বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি এবং র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আলোচনা করব (লু’র সফর চলাকালীন), এর আগে যখন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজ এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা সফরে এসেছিলেন, তখনি আমরা এসব সহজীকরণ বা তুলে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেছি। এবারও এসব ব্যাপারে আলোচনা হবে। ’যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক’ আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে কর্মকর্তাই সফরে আসুক না কেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে তার সহযোগিতা করবে ঢাকা। 

বিএনপি’র প্রতিক্রিয়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বিএনপির কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ নন বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাছে ডোনাল্ড লু’র চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘কুকি-চিনের’ আচরণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সরকার এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।’

কে এই লু ও শেষ কথা

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীর এভাবে প্রতিক্রিয়া মন্তব্যে সরকারেরও দ্বৈন্যতা বা দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। অবশ্য আরেকজন মন্ত্রী অবশ্য রেগে গিয়ে এলোপাতাড়ি মন্তব্য করেননি। কিন্তু প্রভাবশালী ও এর পাশাপাশি বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হিসাবে সমাদৃত রাজনৈতিক ওই নেতার উত্তেজিত হয়ে যাওয়াকে কেউ কেউ রহস্যজনক মনে করেন। কেউ কেউ মনে করেন তার এমন আগমনে সরকারের এই মন্ত্রীর কাছে গণমাধ্যম কর্মীদের পক্ষ থেকে কিছু জানতে চাওয়ায় রেগে যাবার পেছনে কোনো কিন্তু অবশ্যই আছে। কেননা গত জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে এটি ডোনাল্ড লুর প্রথম সফর। অন্যদিকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে এটি ডোনাল্ড লুর প্রথম সফরের নিউজের হেডিংও ছিল অন্যরকম। নিউজের হেডিং ছিল‘ ফের ঢাকায় আসছেন ডোনাল্ড লু’। অনেকে নিউজটি এভাবেও করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু দুদিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের শীর্ষস্থানীয় এই কর্মকর্তার আগমনকে কেন্দ্র করে দেশের কূটনীতিপাড়ায় তোড়জোড় চলছে। রাজনৈতিক মহলের ঘরোয়া আলোচনায়ও একই নাম, ডোনাল্ড লু।

প্রশ্ন কে এই লু?

দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন এই কূটনীতিক ডোনাল্ড লু নিয়ে জোরেশোরে আলোচনার শুরু পাকিস্তানে ইমরান খানের পতনের সময়। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এবং ইমরানের দল পিটিআইসহ নানা দিক থেকে দেশটির সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে ডোনাল্ড লু’র নাম উঠে আসে। এমনকি ইমরান খান নিজেও ডোনাল্ড লুর নাম ধরে বলেছেন। বলেছেন, তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের নেপথ্যে ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন ডোনাল্ড লু। দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিকদের মধ্যে নিজের কূটনৈতিক কর্মপদ্ধতির জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন লু। তার কাজের পদ্ধতিকে অনেকে ‘জবরদস্তি মূলক’ হিসাবেও মন্তব্য করেন। পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় নানা ইস্যুতে ডোনাল্ড লুর সম্পৃক্ততা এ অঞ্চলে তার এমন ভাবমূর্তিই তৈরি করেছে। এছাড়া এর আগে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) কমপ্যাক্টে স্বাক্ষর করতে নেপালকে রাজি করানোর জন্য ডোনাল্ড লু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের বিষয়টি সবার জানা। এছাড়া শ্রীলঙ্কা অস্থিরতার মধ্যে নিমজ্জিত হলে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার জন্য রনিল বিক্রমাসিংহেকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনর্বহাল করার ক্ষেত্রে ডোনাল্ড লুর বড় ভূমিকা ছিল বলেও জানা গেছে। আর একারণে নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মাথায় ঢাকায় লু’এর আগমন নিয়ে প্রশ্ন করায় এমনটা রেগে যেতে পারেন কেউ কেউ। বিশ্লেষকদের মতে, উপরে যা-ই বলুক না কেনো সরকারের কোনো মন্ত্রীর এমনভাবে রেগে যাওয়া পেছনে আরো হেতু আছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক যদিও বলে যাচ্ছেন বিএনপি ও সমমনাদের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা নেই। বলেছেন, সম্প্রতি ঢাকায় তাদের দুটি সমাবেশও ব্যর্থ হয়েছে। তাদের (বিএনপি) কর্মীরা হতাশ, নেতাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ওবায়দুল কাদের এ-ও বলেন, ডোনাল্ড লু’কে বিএনপি উপরে উপরে পাত্তা না দিলেও তলে তলে আবার কি করে কে জানে! প্রশ্ন হচ্ছে এই জন্যই রেগে যাওয়া? উত্তেজিত হয়ে বলা.. ‘তিনি (ডোনাল্ড লু’) নিজ দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আলোচনা করতে এসেছেন। তাকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? কোনো ভিসা নীতি, নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করে না সরকার। আবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিসহ কোনো ইস্যুকেই আমরা কেয়ার করি না।’ আবার তিন দিনের ঢাকা সফরের সময় ডোনাল্ড লুর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময়ের যে কথা রয়েছে তা নিয়ে সরকারের মাথাব্যাথা আছে। কারণ এই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ অভিহিত করেন বিএনপি’ পন্থী বলে। তাই সব মিলিয়ে মুখে যা-ই বলুক না কেনো মন্ত্রী রেগে যা বা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া মুখ ফসকে বের হয়নি..।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)