প্রবাসীরা কি সোনার হাঁস!


হাবিব রহমান , আপডেট করা হয়েছে : 05-06-2024

প্রবাসীরা কি সোনার হাঁস!

গত ২৪ মে সন্ধ্যায় লা গোর্ডিয়া ম্যারিয়টের বলরুমে আয়োজিত অফশোর ব্যাংকিংয়ের একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অগ্রণী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্রাক ব্যাংক এবং সিটি ব্যাংক সম্মিলিতভাবে এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। প্রতিটি ব্যাংকের এমডি ছাড়াও অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসীদের মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট সংক্রান্ত প্রচারের জন্যই ছিল মূলত এই আয়োজন। 

অনুষ্ঠানে তারা জমাকৃত টাকার ওপর ৮.৪ শতাংশ হারে সুদ প্রদানের কথা জানান। পাশাপাশি তারা এ-ও বলেন যে, আমেরিকার ব্যাংকগুলোতে সুদের হার খুবই কম। তাই এখানে অর্থ না রেখে অফশোর ব্যাংকিংয়ের ফিক্সড ডিপোজিটে অর্থ রাখার আহ্বান জানান। 

আমরা প্রবাসে থাকলেও বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর করুণ অবস্থার কথা অজানা নয়। ব্যাংক মালিকদের সহায়তায় ব্যাংকে লুটপাট চলছে। ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখে টাকা না থাকায় ওঠাতে গেলে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। এসব কথা তারা মোটেও উল্লেখ করেননি। অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল। অনেকেরই প্রস্তুতি ছিল এসব বিষয়ে প্রশ্ন করার। কিন্তু এক অজানা কারণে প্রশ্নোত্তর পর্বটি বাদ দেওয়া হয়। 

বাংলাদেশ যখন ডলার সংকটের মুখোমুখি হয়, তখনই ব্যাংকার এবং সরকারের কর্মকর্তারা ছুটে এসে প্রবাসীদের দ্বারস্থ হন। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলেন। দেশের অগ্রগতির জন্য অর্থ প্রেরণ করতে প্রবাসীদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু তারা একবারও ভাবেন না, কিছু পেতে হলে কিছু দিতেও হয়। সরকারের প্রয়োজনের সময় প্রবাসীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু প্রবাসীরা যে, দেশে কীভাবে লাঞ্ছিত হন, সে কথা তারা একটিবারও ভেবে দেখেন না বা জানলেও এর প্রতিকারে তারা এগিয়ে আসেন না। আমি এখানে প্রবাসীদের অবহেলার কিছু চিত্র তুলে ধরছি। 

এ প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে জন এফ কেনেডির একটি বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন-

My fellow Americans, ask not what your country can do for you, ask what you can do for your country.

যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়, আমার আমেরিকান স্বদেশবাসীরা, জিজ্ঞাসা করো না তোমার দেশ তোমার জন্য কি করতে পারে, জিজ্ঞাসা করো তোমার দেশের জন্য তুমি কি করতে পারো।

বাংলাদেশ সরকার, তার মন্ত্রী-আমলা, ব্যাংক কর্মকর্তা সব সময় দেশের প্রতি প্রবাসীদের দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চান। আমরা প্রবাসীরা যদি জন এফ কেনেডির সুরে বলি, হে দেশের প্রতিনিধিরা! প্রবাসীদের প্রতি আপনাদের যে দায়িত্ববোধ তার কতটুকু আপনারা পালন করেছেন বা করছেন?

আসুন, প্রবাসীদের প্রতি সরকারের দায়িত্ববোধ পালনের নমুনাগুলো একটা একটা করে দেখি!

সরকারি পরিভাষায় যাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধা বলা হয়, তাদের বিদেশে যাওয়া এবং ফেরত আসা দুটি প্রক্রিয়াই যেন দুর্ভোগ আর অবহেলার একটি মডেল। শুরুতেই পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ফরম পূরণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অন্তহীন হয়রানির শিকার হন সাধারণ প্রবাসগামীরা। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের নিজস্ব দালাল বা স্থানীয় সিন্ডিকেটের হাতে তারা জিম্মি। অভিযোগ রয়েছে বিদেশে গমনের পূর্বে মেডিকেল চেকআপ থেকে জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রবাসীদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। 

দীর্ঘ বিড়ম্বনার পর ভিসা পেয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করে কাস্টমস্, ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে দালাল ও প্রতারক চক্রের হাতে পদে পদে হয়রানির চিত্র একটি ওপেন সিক্রেট। কখনো স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসীদের সামান্য ভুল বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে না থাকাকে কেন্দ্র করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। বিদেশগামীদের বন্ধুসুলভ সহযোগিতা প্রদানের পরিবর্তে অশোভনীয় আচরণ একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিমানবন্দরে প্রায় ১২ ধাপে হয়রানির শিকার হন প্রবাসগামী যাত্রীরা। বিমানবন্দরে যাত্রীসেবায় নিয়োজিত কাস্টমস্, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ও বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ মিডিয়ায় প্রচার করা হলেও এর খুব একটা প্রতিকার মেলে না। 

বিদেশে গিয়েও হয়রানি প্রবাসীদের পিছু ছাড়ে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের দূতাবাস কর্তৃক যথাযথ সেবা না দিতে পারার অভিযোগও অনেক পুরোনো। বিশেষ করে বিদেশে শ্রম উইংগুলো, দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার, পাসপোর্ট করতে অতিরিক্ত টাকা দাবি, অসহযোগিতামূলক মনোভাবের ঘটনার কথা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সহজেই চোখে পড়ে। যে কারণে শত সমস্যায় জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীরা সহজে দূতাবাসমুখী হতে চান না বলেও অভিযোগ রয়েছে। 

প্রবাসীদের সর্বস্বান্ত করার আরেকটি নাম হলো দালাল চক্র। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক ভিসায় বিদেশে যেতে মোটা দাগে মাথাপিছু খরচ হয় ৩ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। বড় অঙ্কের এই ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ যায় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের পকেটে। এসব দালাল চক্রের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে অবৈধ অভিবাসন। এই দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্দিষ্ট কাঠামো ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে নানা সময় নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিছু বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থাও কাজ করছে। কিন্তু অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। এখনো প্রতারিত হচ্ছে শ্রমিক। অবৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করা যায়নি। 

প্রবাস থেকে যারা দেশে আসেন, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের পরিবার-পরিজন। বিদেশ থেকে সবার জন্য নানান কিছু নিয়ে আসবেন এটাই সবার প্রত্যাশা থাকে। প্রবাসীরা নিজ নিজ সাধ্যমতো আত্মীয়স্বজনের জন্য বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে আসেন। একটি ছোটখাটো লাগেজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে প্রাবাসীদের এক একটি স্বপ্ন। ঢাকা বিমানবন্দরে প্রবাসীদের লাগেজসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাগ চুরি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি হয়। কিন্তু কত জন প্রবাসী তাদের মালামাল ফেরত পান তার খোঁজ কেউ রাখে না। একজন প্রবাসীর কষ্টের মালামাল যদি দেশে এসে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে চুরি হয়ে যায় এর কষ্ট একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। 

বিমানবন্দরে ট্রলি-সংকট প্রবাসীদের ভোগান্তি আরো বাড়িয়ে দেয়। অনেক যাত্রীকে মাথায় ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে দেখা যায়। শতকোটি টাকার উন্নয়ন প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়, কিন্তু কি দুর্ভাগ্য আমাদের সামান্য কয়টি অতিরিক্ত ট্রলি কেনার টাকা বাজেটে থাকে না। 

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও দেশে টাকা পাঠানোর মেশিন এই রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের ন্যূনতম কোনো মর্যাদা নেই। বিদেশে কোনো প্রবাসী মারা গেলে সরকারিভাবে তার লাশটা পর্যন্ত দেশের মাটিতে আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। 

দুষ্টচক্রের হাতে প্রবাসীদের জায়গা-জমি বেহাত হওয়া নিয়মিত ঘটনা। ভূমি ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ সুদূর অতীত থেকে সক্রিয়। ভুয়া নামজারির মাধ্যমে প্রবাসীর সম্পত্তি অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ অতি পুরোনো। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেশে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রবাসীরা এর সহজ সমাধান পান না। এছাড়া অন্যান্য অবহেলা তো আছেই। 

গত কিছুদিন আগে নিউইয়র্কের একটি পত্রিকায় একটি আশঙ্কাজনক খবর প্রকাশিত হয়েছিল। খবরের শিরোনাম ছিল-‘দেশমুখী হতে উত্তরাধিকারীদের অনীহা এবং বেহাত হওয়ার শঙ্কায় দেশের সম্পত্তি বিক্রি করছেন প্রবাসীরা।’ খবরে বলা হয়, নতুন প্রজন্মের অনেকেই দেশে থাকা তাদের পৈতৃক সম্পত্তি দেখভাল করাকে ঝামেলাপূর্ণ মনে করছেন। 

আমরা প্রবাসীরা মনে করি, সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে নতুন প্রজন্মের এই ভীতি কমানোর। তারা যদি দেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তা পরবর্তীতে রেমিট্যান্সপ্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে, যা হবে দেশ এ জাতির জন্য চরম ক্ষতিকর। 

আমাদের দাবিসমূহ:

বিদেশে মৃত প্রবাসী বাংলাদেশির লাশ দূতাবাসের মাধ্যমে সরকারি খরচে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা। 

দেশে প্রবাসীদের সন্তানসন্ততির জন্য সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও সশস্ত্র বাহিনীতে নির্দিষ্ট কোটা চালু করা। 

দেশে আসা প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে নজর রাখা এবং দেশে প্রবাসীর পরিবারগুলোকে নানারকম অন্যায়-অবিচার থেকে রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক নিরাপত্তা দেওয়া। 

সব প্রবাসীকে বীমার আওতায় নিয়ে আসা, যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীরা বীমার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। 

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে তাদের জন্য এককালীন পেনশন স্কিম ও ইন্স্যুরেন্সের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করা। এতে বৈধপথে বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ যেমন বাড়বে, তেমনি প্রবাসজীবন শেষে পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি নিশ্চিত জীবনযাপন করা সম্ভব হবে।

প্রবাসীদের সম্পত্তি যাতে বেহাত না হয়, তার উদ্যোগ নেওয়া। বেহাত হওয়া সম্পত্তি দ্রুত ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনে বিশেষ কোর্টের ব্যবস্থা করা। 

নতুন প্রজন্ম যেন দেশের প্রতি আগ্রহী হয়, সেজন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া। 

আর এসব সমস্যা সমাধানে যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সরষের মধ্যে যে ভূত আছে, তা তাড়ানোর ব্যবস্থা হয়, তাহলে দেশের প্রতি যেমন একদিকে প্রবাসীদের ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বিনিয়োগ বাড়বে এবং নিজের দায়িত্বেই তারা আরো বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্যোগী হবেন। 

ব্যাপারটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন, এই প্রত্যাশা সবার সঙ্গে আমাদের। 


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)