গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার উপর প্রতিনিয়ত বাড়ছে ছাত্র জনতা হত্যা মামলা। সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দেয়া তথ্যমতে কোটাবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সহস্রাধিক নিহত হওয়ার ঘটনায় পতিত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেড় ডজনের বেশি মামলা হয়েছে। এ সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। একই সঙ্গে এসব মামলায় আক্রান্ত হাসিনার পরিবারের সদস্য শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, পুতুলও। এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদেরও নাম রয়েছে এসব মামলায়। গত ২০ আগস্ট মঙ্গলবার রাত অব্দি যেসকল মামলার খবর এসেছে তাতে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপিদের মধ্যে কে বাদ গেছেন সে আলোচনাটাই মুখ্য। তবে প্রতিটা মামলায় হেভিওয়েট মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে ওই এলাকার ছোট নেতাদের নামের পাশে অজ্ঞাত ২০০, ৩০০ (কম বেশি) করে নাম দেয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে এতে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত এলাকার অন্যসব নেতাদের আটক করতে পারলে এসব মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে নেবে পুলিশ। ফলে দল নিয়ে আওয়ামী লীগ ভাববে কখন। প্রাচীনতম ও প্রভাবশালী এ দলটির নেতাকর্মীদের এখন ত্রাহি অবস্থা। ছাত্র-জনতার রোষানল এড়াতে বেশিরভাগ গাঢাকা দেয়া। এরমধ্যেই আটক হয়েছেন সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, জুনায়েদ আহমেদ পলক, দীপু মনি, আরিফ খান জয় প্রমুখ। তবে আটকের প্রক্রিয়া অব্যাহত।
হত্যা মামলায় অভিযুক্ত উল্লেখযোগ্য যারা
হত্যা মামলার আসামীর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী মো. আনিসুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক এমপি রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক এমপি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, সাবেক এমপি দিলীপ বড়ুয়া, সাবেক এমপি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাবেক মৎস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, সাবেক মন্ত্রী কামাল আহম্মেদ মজুমদার ও সাবেক এমপি ইলিয়াস মোল্লা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত প্রমুখ রয়েছেন।
উঠে আসছে পুরনো হত্যা মামলাসমূহ
এমন কোনো দিন নেই দায়ের হচ্ছে না একাধিক হত্যা মামলা। এসবের বেশিরভাগ গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলা। এ ছাড়াও বিগত শাসনামলে গুম-খুনের মামলাও সুযোগে দায়ের হচ্ছে। উঠে আসছে পিলখানায় বিডিআর হত্যা ও শাপলাচত্বরে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে হত্যাকাণ্ডের মামলাও।
এতদিন মানুষ এসব নিয়ে প্রকাশ্যে তেমন কিছু বলতে পারেনি। এবার আলোচনায় বিডিআর হত্যা কান্ডের লোমহর্ষক কাহিনী ও হেফাজত ছাত্র কর্মী নিধনের ঘটনাপ্রবাহ। কেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট শতাধিকবার তারিখ পিছিয়েছে সেটাও আলোচনায়।
এসব প্রতিটা মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন তার সহযোগী যারা ছিলেন তারাও। এদের সঙ্গে র্যাব ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের বিগত ও বর্তমান বেশ বড় একটা অংশের কর্মকর্তাও রয়েছেন হত্যা মামলার তালিকায়। দীর্ঘ ১৫ বছরে সকল পুলিশ ও র্যাব প্রধানগণ। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য বেনজীর আহমেদ, হারুন অর রশীদ, বিপ্লব কুমার সরকার, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ। আছে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া অফিসার, র্যাব কর্মকর্তাও।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথম ১৩ আগস্ট হত্যা মামলা দায়ের হয় মোহাম্মাদপুর থানায় মুদি দোকানদার আবু সাইদ হত্যাকাণ্ডে। ছাত্রজনতার বিক্ষোভ দমাতে পুলিশের করা গুলি সাইদের মাথায় লেগে নিহত হন। সাইদের পরিবার সে মামলা অর্থের অভাবে না করতে পারলে তার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে একজন ঢাকার বাসিন্দা ওই মামলা করেছিলেন। ওই শুরু, চলছে অনাবরত।
শুধু হত্যা ছাত্র জনতার হত্যা মামলা তো চলছেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। একই সঙ্গে পিলখানায় বিডিআরের দরবার হলে সেনাবাহিনীর শীর্ষ অফিসারদের ম্যাসাকারের পুনুরায় তদন্ত করে মামলার উদ্যোগের দাবি জানিয়েছেন তাদের স্বজনেরা। বাংলাদেশ আর্মি মুখে না বললেও তাদের ওই সময়ের অফিসারদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিটা তাদের প্রাণের দাবি বলেই বিভিন্ন সময়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এটা নিয়ে কর্মরত অফিসারদেরও অগ্নিগর্ভ ক্ষোভ বিদ্যমান বলে জানান তারা। কিন্তু সুশৃঙ্খলবাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ও বাহিনীর সুনাম যাতে নষ্ট না হয় সে জন্যই তারা এসব মুখে আনছেন না। নীরিহ অফিসারদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইতিমধ্যে অবসরে যাওয়া অফিসাররা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তব্য প্রদান শুরু করেছেন। যাদের অনেকেই প্রাণের ভয়ে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানেও তারা নিরাপত্তার কথা ভেবে মুখ ফুটে বলেননি কিছু। এখন দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং একটা নৃশংসতার সত্য উদঘাটন ও তার সচ্ছ বিচারের জন্য সোচ্চার। প্রয়োজনে তারা সাক্ষী দিতেও প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানান দিচ্ছেন।
নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসারদের পরিবার বর্গও এ ব্যাপারে এখন সোচ্চার। প্রতিনিয়ত সাংবাদিক সম্মেলন করে এ হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ও সুষ্ঠু বিচারের দাবি তুলেছেন।
২০১৩ সনে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ ও ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থানের কর্মসূচি ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে আসা হেফাজত কর্মীরা সে দিন ঢাকার প্রবেশদ্বারে অবস্থান কর্মসূচি সেরে ফিরে যাবার কথা। কিন্তু কার উস্কানিতে তারা সেদিন মতিঝিল শাপলাচত্তরে এসেছিলেন এবং হঠাৎ বসে পড়েন সেখানে। একথা আজোও রহস্যঘেরা। এরপর রাতে ক্রাকডাউন। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার সম্প্রতি ৬৭ জনের হত্যাকাণ্ডের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেছে ওই শাপলাচত্বরে ম্যাসাকারের।
এটা তারা বিভিন্নস্থানে খোঁজ নিয়ে তৈরি করেছেন। যেহেতু হেফাজতে ইসলামের ওই কর্মসূচিতে অংশ নেয়াদের অধিকাংশ মাদ্রাসা ছাত্র। এবং যাদের অনেকেই এতিম। ফলে এদের মধ্যে যারা নিহত হয়েছেন তাদের অবশিষ্ট স্বজনেরা মৃত্যুর দাবি করতে পারেনি। কেননা এরা বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কম রাখেন। মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিং বা এতিমখানাতেই পড়ে থেকে লেখাপড়া করে বিভিন্নস্থানে স্যাটেল হওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে এমন যদি কেউ থেকে থাকেন তাদের হিসেব খুঁজে বের করা মুশকিল। তবুও মোটামুটি একটা সংখ্যা দাঁড় করিয়েছে অধিকার। যা ব্যাপক তদন্ত ও খোঁজখবর নিয়ে।
এর বাইরেও গত ১৫ বছরে বিএনপি তাদের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে যেয়ে হারিয়েছেন বহু নেতাকর্মীকে। যারাও আইনশৃংখলাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন বা আহত হয়ে পরবর্তিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ বেশ কিছু নেতা গুম হয়েছেন। যার সংখ্যা গুম হওয়াদের ফ্যামিলির করা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ প্রতিবছর দিয়ে আসছে। এরমধ্য থেকে হাতে গোনা কয়েকজন ‘আয়নাঘর’ থেকে ছাড়া পেয়েছেন। বাকিদের হদিস মিলছে না। স্বজনেরা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সোচ্চার হচ্ছেন। মামলা ঢুকতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন কেউ মামলা করছেনও। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট দেয়ার সময় সেঞ্চুরি পার হয়েছে। কেন একের পর এক সময়ক্ষেপণ হয়েছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এবার সে চার্জশিট দেয়ার পালা। কেন হত্যা করা হয়েছিল সাংবাদিক ওই দম্পতি সে কারণও এখন প্রকাশিত হওয়ার সময় এসেছে। চার্জশিট দিলে সেখানেও কারণ প্রকাশ পাওয়ার কথা।
ইতিমধ্যে এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ের বিশেষ করে ছাত্রজনতার হত্যাকাণ্ডে মানবাধিকার লংঘনের প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ- সেটা আন্তর্জাতিক ওই সংগঠন জানান দিয়েছে। ফলে এ বিষয় আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশের আদালতে তো আছেই, এরপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মামলা হলে উভয় সঙ্কট বাড়বে শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রী পরিষদ ও সহযোগীদের।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে নিষিদ্ধেরও দাবি তোলা হয়েছে। যদিও এটা তেমন হালে পানি মিলবে না। কারণ প্রাচীনতম এ সংগঠনের সবাই যে খারাপ সেটা নয়। তবে এ রাজনৈতিক সংগঠন ব্যাবহার করে যারা অপকর্ম করেছেন, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদের সচ্ছতার সঙ্গে বিচার হোক এটা বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা।