গ্যাস সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সংকটে


সালেক সুফী , আপডেট করা হয়েছে : 21-08-2024

গ্যাস সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সংকটে

বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রধান অন্তরায় এখন প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ সংকট, বিশেষ করে গ্যাস স্বল্পতা। ২০০০-২০২৪ ক্ষমতায় থাকা কোনো সরকার জলে-স্থলে গ্যাস অনুসন্ধানের কোনো বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। প্রমাণিত গ্যাস সঞ্চয় নিঃশেষ হতে থাকায় বিকল্পব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বজ্বালানি বাজার থেকে জ্বালানি আমদানির ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে জ্বালানি সেক্টর, তথা দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক সংকটে ফেলেছে। সেখানেও প্রয়োজনীয় আমদানি অবকাঠামো স্থাপনে ব্যর্থতা আমদানিকেও সংকটে ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলছে মাতারবাড়ীতে ল্যান্ড বেসড টার্মিনাল নির্মাণ পরিকল্পনা। এলএনজি আমদানি নিতান্ত একটি গোষ্ঠীর কবলে তুলে দেওয়ার অভিযোগ আছে।

দেশে এখন গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দুটি ভাসমান টার্মিনাল একসঙ্গে চালু থাকলে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব। কখনো একটি, কিছু সময় দুটি ভাসমান টার্মিনাল কার্যক্ষম না থাকায় তীব্র গ্যাস সংকটে ভুগছে জ্বালানি সেক্টর। গ্যাসভিত্তিক বিউটি উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত। অধিকাংশ সার কারখানা গ্যাসের সংকটে বন্ধ আছে, শিল্পকারখানাগুলো গ্যাস সংকটে ধুঁকছে। সিএনজি, গৃহস্থালি গ্যাস ব্যবহার নিদারুণ সংকটে। যতটুকু গ্যাস আছে, সেখানেও গ্যাস চুরি, অদক্ষ ব্যবহারের কারণে মহাসংকটে গ্যাস সেক্টর।

২০০৯ সদ্য বিদায়ী সরকার ক্ষমতায় আসার পর চতুর্মুখী ব্যবস্থাপনার চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়েছে গ্যাস ও জ্বালানি সেক্টর। মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রধানমন্ত্রী নিজে মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী, সচিব থাকা সত্ত্বেও একজন বিতর্কিত আমলাকে তার জ্বালানি উপদেষ্টা করে তাকে স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান থেকে সেক্টরে স্বেচ্ছাচার চালিয়েছেন। দুই উপদেষ্টার সংকটে জ্বালানি সেক্টর বিশেষত পেট্রোবাংলা নিদারুণ সংকটে পড়েছে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ নিয়ে মেতে থাকায় জ্বালানি সেক্টর উন্নয়নকে অবজ্ঞা করেছেন। মাঝেমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব জ্বালানি সেক্টরের কাজে প্রভাব বিস্তার করেছে।

বাপেক্সকে আর্থিক বা কারিগরীভাবে দক্ষ করা হয়নি। দেশের গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বাপেক্সকে কারিগরি এবং আর্থিকভাবে দক্ষ না করে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে ব্যাহত করা হয়েছে। অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সৃষ্ট গ্যাস উন্নয়ন তহবিল বাপেক্সকে অনুদান হিসেবে না দিয়ে যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি বাপেক্সের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদেশি কোম্পানিকে অধিক অর্থ প্রদান করে অনুসন্ধান কাজ করতে দেওয়া হয়েছে। ১৫ বছর একাধারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেও বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের কোনো বাস্তবমুখী কার্যক্রম নিতে পারেনি সরকার।

গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানিকে অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে বাধ্য করে পঙ্গু করা হয়েছে। গ্যাস সঞ্চালন দায়িত্বে থাকা একটি গতিশীল কোম্পানির কার্যক্রম সরকারের দূরভিসন্দিমূলক কার্যক্রমের কারণে সংকটে ফেলা হয়েছে। প্রথম দুর্নীতি হয়েছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় জি টিসিএলের বাস্তবায়নাধীন তিনটি গ্যাস কমপ্রেশার স্টেশন প্রকল্পের একটি অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মার্কিন কোম্পানি শেভরনকে প্রদান। শেভরন পেট্রোবাংলার মধ্যে সম্পাদিত উৎপাদন বণ্টন চুক্তির আওতায় কোনোভাবেই গ্যাস সাপ্লাই চেইন মিড স্ট্রিমে উৎপাদন কোম্পানির কোনো স্থাপনা নির্মাণ বা পরিচালনার অধিকার নেই। এখানেই শেষ নয়। তিন তিনটি কমপ্রেশার স্টেশন বাস্তবায়ন থাকা অবস্থায় সরকার শেভরনকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার স্বার্থে বিবিয়ানা-ধনুয়া পাইপলাইন নির্মাণ করে জিটিসিএলকে আর্থিক চাপে ফেলে। কোনো ধরনের টেন্ডার না করে বাজার দর থেকে অনেক উঁচু দরে ভারতীয় একটি কোম্পানি থেকে লাইন পাইপ কেনা হয়। এই ধরনের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের পরিণতিতে কখনো এলেঙ্গা কমপ্রেশার চালু হয়নি। গ্যাস সংকটে এবং পরিচালনায় জিটিসিএলের কারিগরি দক্ষতা না থাকায় আশুগঞ্জ কমপ্রেশার বন্ধ আছে, বিবিয়ানা-ধানুয়া পাইপলাইন ক্ষমতা অনুযায়ী চলছে না। 

সরকারের চাপে এবং ব্যবসায়ী মহলকে তুষ্ট করার তাগিদে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চয়তা না থাকা সত্ত্বেও জিটিসিএল একটার পর একটা ব্যয়বহুল গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণ করেছে। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ সমান্তরাল সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এখন আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ দুটি পাইপলাইনে কোনো গ্যাস সরবরাহ নেই। ১০ বছরের অধিক সময় আগে নির্মিত ঈশ্বরদী থেকে কুষ্টিয়া-যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত নির্মিত পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়নি। দেশে গ্যাস সংকট থাকা সত্ত্বেও বগুড়া দিনাজপুর হয়ে রংপুর পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। লক্ষ-কোটি টাকা খরচ করে একশ্রেণির মাফিয়া সিন্ডিকেটকে লাভবান করা হলেও আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়েছে জিটিসিএল। বিশেষত বিপুল বিনিয়োগের বিপরীতে জিটিসিএলকে যথাযথ হুইলিং চার্জ প্রদান করা হয়নি।

গ্যাস সিস্টেম লস নামের অপচয় দুর্নীতি

গ্যাসখাতে সবচেয়ে আত্মঘাতী কাজ মূলত গ্যাস বিতরণ সিস্টেমে ব্যাপক গ্যাস চুরি, অদক্ষ ব্যবহার ও অপচয়। এগুলোকে সম্মিলিতভাবে সিস্টেম লস বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। আধুনিক সময়ে উন্নত মিটারিং ব্যবস্থার করিগরি লস ১ থেকে ২ শতাংশ সীমিত রাখা সম্ভব হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তিতাস গ্যাস, কর্ণফুলী, বাখরাবাদ গ্যাসের বিতরণ এলাকায় এই পরিমাণ অত্যাধিক। সবাই স্বীকার করে খোদ তিতাস সিস্টেমে লক্ষ লক্ষ অবৈধ সুযোগ শুধু নয়, অবৈধ গ্যাসলাইন আছে। বিতরণ কোম্পানিসমূহের গ্যাস সিস্টেম লস নামের চুরি কম দেখানোর চেষ্টায় পেট্রোবাংলা অযাচিতভাবে জিটিসিএলের ওপর সিস্টেম লসের দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছে। উচ্চচাপে চালু থাকা জিটিসিএল সিস্টেমে আধুনিক মিটারিং ব্যবস্থা আছে। সর্বোচ্চ কারিগরি লস হতে পারে ১%-১.৫%। গ্যাস সাপ্লাই চেইনে সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। বিশেষত বিতরণ কোম্পানিগুলোর অপারেশন দক্ষতা বহুগুণ বৃদ্ধি জরুরি। গ্যাস সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট অনেক দুর্নীতি আছে। আমলানির্ভর কোম্পানি বোর্ডগুলো অনভিজ্ঞতা এবং অদক্ষতার কারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গ্যাস সিস্টেমে বিশেষত গ্যাস সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সংস্কার না আনতে পারলে গ্যাস সেক্টর অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)