পোশাক শিল্প তৈরির এলাকা সাভার-আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ শুরু হয়েছে অস্থিরতা। পোশাক শ্রমিকরা গাজীপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের মতো ব্যস্ততম সড়ক অবরোধ করে চাকরি স্থায়ীকরণ, বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। গত ২২ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল থেকে চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগরা, নাওজোর, কোনাবাড়ী, বোর্ডবাজার ও টঙ্গীর বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কয়েকটি স্থানে থেমে থেমে এবং কয়েকটি স্থানে দীর্ঘ সময় যান চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় ভোগান্তিতে পড়ে ওই মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী ও পথচারীরা। অবস্থা বেগতিক দেখে ৩০টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পুরুষদের গার্মেন্টেসে চাকুরিতে নেয়ার যারা দাবি করছেন, তাদের হাতে লাঠি। এগুলো আন্দোলনের কোন স্তরের নমুনা সেটা গার্মেন্টস মালিকরা বুঝতে পারছেন না। ফ্যাক্টরিতে কাজে গতিহীন, শিপমেন্ট ফেল নানা দুশ্চিন্তায় তারা। এসব কর্মকাণ্ড হঠাৎ শুরু গত সোমবার থেকে। চলছে। এদের নিয়ন্ত্রণে বরাবর যে পুলিশ বাহিনী কাজ করেন, তাদের অনেকেই নেই। নতুন পুরাতন মিলে যারা এসেছেন, তাদের ধাতস্থ হতে সময় নিচ্ছে। তবে আন্দলোন নিয়ন্ত্রণে এ ব্যাপারে যৌথ অভিযান শুরু। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু। যেখানে পুলিশের সঙ্গে বিজিবি, সেনাবাহিনী রয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ বেগতিক দেখলে পুলিশের সঙ্গে মোতায়েন করা হতো বিজিবি। এখন সেনাবাহিনীও।
ক’দিন আগে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ছিল আনসারদের। সেখানে পুলিশ ছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে টিএসসিতে ত্রাণ গ্রহণ বন্ধ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা ছুটে যান। সাথে সেনাবাহিনী। গণঅভ্যুত্থানের পর ডাকাতকাণ্ডের কথা দ্রুত ভুলে যাবার নয়।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সম্মুখে যেয়ে রাস্তায় বসে পড়া বা প্রেসক্লাবে বিভিন্নদাবী দাওয়া নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করা নিয়ে অস্বস্তি কম যায়নি পুলিশ সঙ্কটে। পরিশেষে ডিএমপি এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করেছে। রাজধানীসহ সারা দেশেই পুলিশের ক্রাইসিসে ত্রাহি অবস্থা পোহাতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
ছাত্র জনতার আন্দোলন ঘিরে পুলিশের যে ভুমিকা এবং সে সূত্র ধরে দেশের বিভিন্নস্থানে থানা পুড়িয়ে দেয়ার যে ঘটনা এবং নির্বিচারে গুলিতে সহস্ত্রাধিক ছাত্র-জনতার মৃত্যুর পর গণঅভ্যুত্থান। পুলিশ এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না। ভয়, জড়তা ব্যাপকভাবে পেয়ে বসেছে। কারষ ওই আন্দোলনে পুলিশও নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। সব মিলিয়ে পুলিশ সেক্টরে এক ভীতিকর অবস্থা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই যেসকল কাজ করবেন বলে ঠিক করেছেন তার অনেক স্থানেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে প্রয়োজন।
দীর্ঘ ১৬ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতায় গণঅভ্যুত্থানে শিকার হয়ে ক্ষমতা ছেড়েছে। এতে সহস্ত্রাধিক ছাত্র জনতা নিহত ও হাজার হাজার আহত ও পঙ্গুত্ববরণের পথে। এসব মানবাধিকার অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মামলা হচ্ছে। কিন্তু এই মামলা অনুসারে কাজ শুরু করতে দায়িত্বশীল আইনশৃখলাবাহিনীর সদস্যের প্রয়োজন। এ সেক্টরে দীর্ঘ ১৬ বছরে যাদের পদায়ন ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও জেলাতে যেসকল দায়িত্বশীল নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে পতিত সরকারের সুবিধাভোগীও অনেকে। ফলে তাদের উপর অন্তর্বর্তী সরকার আর আস্থা রাখতে চাচ্ছে না।
ফলে পুলিশে ব্যাপক রদবদল চলছে। পদায়ন হচ্ছে। বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে অতি উৎসাহী পুলিশের যারা হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার সন্দেহ বা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দান বা মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে অনেককেই সরিয়ে দেয়া হচ্ছে তার কর্মস্থল থেকে। অনেকে নিজ থেকেই অনুপুস্থিত। ভীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে বেশকিছু ছুটি নিয়ে আড়ালে থাকার চেষ্টাও করেছেন। অনেক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা নির্দিষ্ট সময় বেধে দেয়ার পরও (১২ আগস্ট) কাজে যোগদান না করায় তাদের প্রতি কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সেটাও একটা বিষয়।
দেশের আইনশৃংখলার উন্নতিতে পুলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। এ সেক্টরে শৃংখলা ও মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরাতে প্রতিনিয়ত চলছে এ রদবদল। ৩ সেপ্টেম্বরও ২৬ জেলায় নতুন পুলিশ সুপার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এভাবেই বেশকিছুদিন থেকে চলছে পুলিশ সেটআপের কার্যক্রম।
অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করে সচিবালয় দিয়ে। সেখানেও প্রতিটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সচিব, সহকারী সচিব উপসচিব পর্যন্ত বিগত সরকারের অনুগতদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বলে খবর বেড়িয়েছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর হুট করে সব পরিবর্তন করা সম্ভবপর না হওয়ায় টার্গেটকৃত স্থানে যথার্থদের নিয়োগ দিতে কোথাও কোথাও পদন্নতির প্রয়োজন হয়েছে। সেটা তারা দিয়েছেনও তাৎক্ষণিক। পুলিশের মত সচিবালয়েও রদবদল, বাধ্যতামূলক অবসর, চুক্তিভিত্তিক কর্মরত যারা ছিলেন তাদের চুক্তি বাতিল সব বেশ পরিবর্তন পরিমার্জন চলেছে। ওই প্রক্রিয়া এখনও বিদ্যমান।
ফলে পুলিশ ও সচিবালয়ের মত স্থান ছাড়া আর কোথাও এতটা জটিলতায় পড়তে হয়নি অন্তর্বর্তী সরকারকে। তবে ধীরে ধীরে এ দুই সেক্টর গুছিয়ে আনছেন তারা। এতে করে একবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও পরিবর্তন করতে হয়েছে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসকে। তবে খুব শীগ্রই এ সেক্টরে আস্থাভাজনদের যথাস্থানে বসানোর কাজ সম্পাদিত হয়ে যাবে বলে জানা গেছে।
ওয়ান ইলেভেনে সেনাসমার্থিত সরকারের পক্ষে যেসকল উদ্যোগ দ্রুত ও ব্যাপকহারে নেয়া সম্ভবপর হয়েছিল এবার গণঅভ্যুত্থানের পর সেটা সম্ভব না হওয়ার কারণ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এবার অন্তর্বর্তীকে সেনা সমার্থিত সরকার বলার সুযোগ নেই। সেনাবাহিনী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চাহিদা অনুসারে মাঠে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এবং যথাসময়ে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবেন বলেও সেনাপ্রধান জানিয়েছেন।
গত ১২ আগস্ট খুলনায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘পুলিশ সুন্দরভাবে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করলে ব্যারাকে ফেরত যাবে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সবার সহযোগিতায় আমরা দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই। তবে যারা অপকর্ম করেছে, আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি আরো বলেন, পুলিশকে আরও সংগঠিত করতে হবে। তাহলে নিশ্চিতভাবে আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাব। আমরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি, আমাদের সেনাবাহিনী সব বিভাগে আছে। ইনশাআল্লাহ খুব শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ সেনাপ্রধানের এ কথা ১২ আগষ্টের। সে থেকে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি এখন।
যেহেতু আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে পুলিশের কর্মবিরতি ও বেশ কিছু পুলিশ অফিসার ও সদস্যদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ঘটেছে এবং এর ফলে গোটা পুলিশ সদস্যগণ একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরেছেন, সে থেকে তাদের মানসিক অবস্থার উন্নতি ও তাদের উপর যেভাবে হামলা হয়েছে ও তাদের উপর একটা অনাস্থা এসেছে ছাত্র-জনতার, এ জন্য সে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পরিবর্তন হওয়া পুলিশের শীর্ষ কমর্কতাগণ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টাসহ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলছেন।
গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপক হত্যাকান্ডে প্রচুর মামলা হচ্ছে। যার পরিমাণ একশ ছাড়িয়ে গেছে। এখনও হচ্ছে মামলা। এসব মামলা অনুসারে অভিযুক্তদের আটক করতে পুলিশের অভিযান প্রয়োজন। সূচনায় বিগত সরকারের একজন উপদেষ্টা, প্রভাবশালী মন্ত্রীদের মধ্যে কয়েকজনকে আটক করা হলেও বাকিদের ধরতে তেমন উদ্ধার অভিযান চলমান চোখে পড়ছে না। তবে দেশের বর্হিগমণের প্রতিটা চেকপোষ্টে দায়িত্বরত বিজিবি, পুলিশ, বিমানবাহিনীর সদস্যরা সজাগ। ফলে বের হতে পারছেন না কেউই গণঅভ্যুত্থানের ৫ আগষ্টের পর।
এরপরও এরা কেন আটক হচ্ছেনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও প্রশাসন ও পুলিশ তাদের প্রয়োজন অনুসারেই কাজগুলো করে যাচ্ছেন। একেবারে যে ধরা হচ্ছে না তাও না। কিন্তু প্রভাবশালীদের অনেককেই আটক হচ্ছে না প্রশ্ন সেখানেই। তবে পুলিশের যে রদবদল। সেটা একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে না গেলে এ কাজে কিছুটা ধীরগতি হওয়াই স্বাভাবিক।
তবে উপদেষ্টারা ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বলা হচ্ছে, অপরাধীরা ছাড়া পাবেন না সে যেই হোক না কেন। সংগঠিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত, পরোক্ষ, প্রত্যক্ষ মদদদাতা, যোগানদাতা, পরামর্শদাতা, অর্থের যোগানদাতা থেকে শুরু করে পতিত সরকারের দোসর যারা ছিলেন তাদের মধ্যে দীর্ঘ ১৬ বছরে যারা পিলখানায় হত্যাকান্ড, শাপলাচত্বরে হেফাজতের হামলা ও হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙন, ফৌজদারী অপরাধে জড়িত তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় এনে বিচার করতে দৃঢ়তা দেখাচ্ছে অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা পরিষদ।
উল্লেখ্য, সারা দেশে বর্তমানে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৪ জন।