বৈষম্যমূলক বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) ড্যাপ বাস্তবায়ন স্থগিত করে সংস্কারের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন স্থপতিরা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ড্যাপ স্থগিতকরণের দাবি জানিয়ে জনস্বার্থে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তারা। অভিযোগ করেছেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) বেআইনি প্রক্রিয়ায় প্রণীত হয়েছে। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়া নগর পরিকল্পনা সংক্রান্ত দেশের প্রচলিত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক।
গত ২ সেপ্টেম্বর সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি জানান। বাস্থই সাধারণ সম্পাদক স্থপতি নবী নেওয়াজ খানের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে কি নোট পাঠ করেন সংগঠনের সহ-সভাপতি (জাতীয় বিষয়াদি) স্থপতি মো. আলী নকী। পরে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বাস্থই সভাপতি স্থপতি প্রফেসর ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ।
অনুষ্ঠানে উপস্থি ছিলেন সহ-সভাপতি (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) স্থপতি খান মো. মাহফুজুল হক জগলুল, সম্পাদক (পেশা) স্থপতি মো. নাজমুল হক বুলবুল, সম্পাদক (সেমিনার ও কনভেনশন) স্থপতি সাবরিনা আফতাব, সম্পাদক (পরিবেশ ও নগরায়ন) স্থপতি সুজাউল ইসলাম খান এবং বাস্থই ড্যাপ কমিটি সদস্য স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) ড্যাপ বাস্তবায়ন স্থগিত করে এর আইনি এবং অন্যান্য অসঙ্গতি দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে সংস্কারের জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার দাবি জানান তাদের।
বাস্থইসহ অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠন এই পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়া নগর পরিকল্পনা সংক্রান্ত দেশের প্রচলিত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে আসছেন। ইতিপূর্বে ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রথম পর্যায়ে প্রস্তাবিত নগর অঞ্চলের ‘কাঠামো পরিকল্পনা’ গ্যাজেটের মাধ্যমে অনুমোদন করার পর নগরের বিভিন্ন এলাকার জন্য ‘আর্বান এরিয়া প্ল্যান’ এবং পরিশেষে ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’ গ্যাজেটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হয়। ড্যাপ (২০২২-৩৫) প্রণয়নের পূর্বে ‘ঢাকা কাঠামো পরিকল্পনা’ ২০১৬ সালে প্রণয়ন করা হলেও তা গ্যাজেটভুক্ত না করে আইনি ব্যত্যয় ঘটিয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করে ২০২২ সালে এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) গ্যাজেট করা হয়। কাজেই কী প্রক্রিয়ায় বা কিসের ওপর ভিত্তি করে নগরীর ‘উন্নয়ন প্রাবল্য-তীব্রতা’ ও ‘জনঘনত্ব’ নির্ধারণ করা হয়েছে তা জানতে চেয়ে বাস্থই এই পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ব্যবহৃত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ-উপাত্ত এবং ওয়ার্কিং পেপারসমূহ জনসাধারণ এবং অংশীজনদের কাছে উন্মুক্ত করার জন্য বহুবার আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে বাস্থই মনে করছে যে এই পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ।
এই পরিকল্পনায় শহরের পরিকল্পিত এবং অপরিকল্পিত এলাকার জন্য পৃথকভাবে ভবন নির্মাণের সীমা নির্ধারণের সূচক বা এফএআর, নির্ধারণ করা হয়েছে যা স্পষ্টত বৈষম্যমূলক। নির্দিষ্ট কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ও ব্যক্তির স্বার্থরক্ষায় এবং অন্যায্য সুবিধা প্রদানের অভিপ্রায়ে নগরের এলাকাভিত্তিক এফএআর প্রণয়নে বৈষম্য ও অনিয়ম করা হয়েছে।
বন্যা প্রবাহ অঞ্চলের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে এবং কৃষি জমিতে অবাধ নগরায়নের সুযোগ দিয়ে এই পরিকল্পনা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এই বক্তব্য কেবল বাস্থই এর নয়, বরং পরিবেশবিদ, আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশাজীবী ও বিশিষ্টজনদের।
উল্লেখ্য যে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার এলাকাধীন বিদ্যমান ৭২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পৌর এলাকাসমূহে ২০৩৫ সালে প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা ২ কোটি ৩৫ লক্ষ। এই এলাকায় কর্মসংস্থান, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামো বিদ্যমান। ২০৩৫ সালে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার সম্পূর্ণ এলাকায় অর্থাৎ ১৫২৮ বর্গ কিলোমিটারের প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা ২ কোটি ৬০ লক্ষ। অর্থাৎ বিদ্যমান পৌর এলাকার বাইরে ৮০৬ বর্গকিলোমিটার এলাকায় যেখানে কর্মসংস্থান, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামো নেই বললেই চলে, সেখানে মাত্র (২.৬০-২.৩৫)=০.২৫ কোটি বা ২৫ লক্ষ মানুষ থাকবেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে কেন্দ্রীয় ঢাকার সংলগ্ন বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল, জলাশয়, কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় বয়ে আনবে বলে বাস্থই মনে করছে। পৌর এলাকাগুলোতে জনঘনত্ব বৃদ্ধি করে আবাসন সংকট মোকাবিলা করে এই অনন্য মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৃষিভূমি রক্ষা করেও এই জনসংখ্যাকে অনায়সে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব।
প্রায় এক বছর ধরে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলমান। কিন্তু ড্যাপে বিদ্যমান বৈষম্য ও ক্ষেত্রবিশেষে অস্পষ্টতার কারণে বাস্থই-এর সদস্যরা নতুন ভবনের নকশার অনুমোদন প্রক্রিয়া চলাকালে রাজউকের অসাধুচক্রের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে সময়ক্ষেপণ, বিভ্রান্তি, দুর্নীতি এবং সর্বোপরি ভূমি মালিক তথা জনসাধারণের অযাচিত হয়রানি। এছাড়াও এই ড্যাপ প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমলে নেয়া হয় নাই। একটি নগরের যথাযথ স্থানিক বিন্যাস নিশ্চিত করতে নগরবিষয়ক নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে আরবান ডিজাইনারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্স্টিটিউট-এর সদস্যরা দাবি করছেন যে, এই বৈষম্যমূলক বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) এর বাস্তবায়ন স্থগিত করে এর আইনি এবং অন্যান্য অসঙ্গতিসমূহ দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অবিলম্বে সংস্কারের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক।