হাসিনার পতনে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি বদলে যাবে


মঈনুদ্দীন নাসের , আপডেট করা হয়েছে : 25-09-2024

হাসিনার পতনে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি বদলে যাবে

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জনগণের সংগ্রামী চেতনার বিজয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকটি দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভারতে অভ্যন্তরঢু সংকটকে প্রকট করে তুলতে পারে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার সমন্বিত আন্দোলন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত ও দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনাকে প্রাথমিকভাবে দেশছাড়া করেছেন। বাংলাদেশে উন্নয়নের জোয়ার বিশ্বজোড়া স্বীকৃত হলেও সে উন্নয়ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে পারেনি। কারণ উন্নয়নের ভারে ঋণে জর্জরিত বাংলাদেশের মানুষকে চলতে হয় অর্ধাহারে-অনাহারে, মাছ-মাংস ব্যতিরেকে। উন্নয়নের ডেলিভারি কাজেই গদি রক্ষার হাতিয়ার হতে পারে না।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি মূলত ভারতের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্কের রাজনীতি। বাংলাদেশ ছাড়া হাসিনা পূর্ব-ভারতের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের সদ্ভাব ছিল না। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও চলছে ভারতবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের সফলতা আজ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মানুষের আকাক্সক্ষাকে ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মতো অনুপ্রাণিত করে। সে সময়ও এ অঞ্চলের মানুষ বাংলাদেশ থেকে প্রেরণা পেয়েছিল স্বাধীনতার। আজও তারা প্রেরণা লাভ করেছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তার দায়িত্ব নেওয়ার প্রাক্কালে ভারতের উদ্দেশে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যদি অস্থিতিশীল হয়, তাহলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমারও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। অবশ্য ভারত হয়তো তা অনুধাবন করে বাংলাদেশের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি। বরং পদ্মার তীর ভেঙে ভারতের দিকে জেগে ওঠা ২০০ একর ভূমি, এরপর বাংলাদেশকে ফেরত দিয়ে সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে চীন বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। এরপর দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। একসময় শেখ সাহেবের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে উসকানি দিতো চীন। অস্ত্র দিতো চাকমাদের চীন। সন্তু লারমার আগে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল চীনের। পড়ে যখন চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তখন সে গন্ডগোল বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভারত প্রীতিকুমার চাকমার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। কিন্তু এক সময় প্রীতি চাকমার পতন হয়। সেখানে সন্তোষ কুমার চাকমা আওয়ামী লীগের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়নের পর বড় ধরনের কোনো খুনোখুনি না হলেও খ- তৎপরতা চলতে থাকে। এখন চাকমারা কার কাছ থেকে মদদ পাচ্ছে, তা জানা যায়নি। তবে জেনেশুনে ভারত নিজ এলাকায় জঙ্গিদের সঙ্গে নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংযোগ ঘটাবে কি না, সন্দেহ। এ প্রতিবেদক ১৯৯২ সালে ত্রিপুরায় সফর করে দেখেছিলেন, কীভাবে সেখানে চাকমা শরণার্থীরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। তারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছিল সফররত মন্ত্রী অলি আহমদের সম্মুখে। কিন্তু সে পরিস্থিতি এখন নেই। তবে কেন নতুন করে পাহাড়ে চলছে উপজাতির হামলা। চীন প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বহিষ্কারকে সমর্থন করেনি। তারা আমেরিকাকে হাসিনা সরকারের পতনের জন্য দায়ী করে। অবশ্য আমেরিকার কূটনীতিকরা ভারতে বসে বলেছে যে, আমেরিকার গণতন্ত্র রক্ষার কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন করা হয়েছে। 

এদিকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা শ্রীসেনা বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও ভারতের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি আসবে। তিনি পরামর্শ দেন বাংলাদেশ সরকারকে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের চেয়ে নিজ দেশে স্থিতিশীলতা গড়তে অধিক যত্নবান হতে হবে। অবশ্য শ্রীলঙ্কার এখন আবার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। নির্বাচনে পরাজিত হয়েও প্রধানমন্ত্রী গদি ছাড়ছে না। কিন্তু সেখানে চলছে আন্দোলনের প্রস্তুতি। বামপন্থীরা আন্দোলন গড়ে তুলে পরাজিত শক্তিকে ক্ষমতচ্যুত করতে চায়।

বাংলাদেশে পটপরিবর্তনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও অকাতরে জীবনদান, স্বৈরাচারকে যেভাবে হটিয়েছে, তা আমেরিকা প্রভাবিত হোক বা জাতিসংঘ প্রভাবিত হোক, আঞ্চলিক কূটনীতি ও রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবেই। যেসব বিষয়ে প্রভাব ফেলতে পারে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে। নিম্নোল্লিখিত ক্ষেত্রে তা কীরূপ প্রভাব ফেলবে। ১. ভারতের সার্ক-বহির্ভূত দ্বিপক্ষীয় নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্যমূলক কূটনীতির উন্মেষ ঘটিয়েছে এবং পাকিস্তানে ২০১৫ সালে সার্কের শীর্ষ বৈঠকে যোগ না দিয়ে ভারত যে সার্ককে অকার্যকর করেছে, তা নিয়ে ভারত পুনরায় বিবেচনায় বসতে পারে। ২. ভারতে সব প্রতিবেশীর মধ্যে এ ধারণার উন্মেষ ঘটতে পারে যে, ভারতপন্থী হয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঐক্যবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়। ৩. শ্রীলঙ্কার নির্বাচনে ভারতপন্থীদের বিদায়ের সূচনা ঘটেছে। ৪. পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নতুন করে গাঁটছড়া বাঁধার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত। ৫. মালদ্বীপ নতুন করে ভারতবিরোধী মনোভাবকে ধারণ করছে। ৬. আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ভারত থেকে মদদ নিতে অনীহা দেখাচ্ছে। ৭. ভারতের জন্য সবচেয়ে দুরূহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরায়, অরুণাচল, আসাম ও মিজোরামে। উলফা গেরিলারা পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে। এছাড়াও ৮. সবচেয়ে বড় সমস্যা ভারতের জন্য দেখা দিয়েছে মিয়ানমারকে নিয়ে। কীভাবে তারা কারবার করবে। এতোদিন ভারত একতরফাভাবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে মদদ দিয়ে আসছে। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের ১৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। দীর্ঘ এ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের বিতাড়িত মানুষগুলো এখন ভারতে ঢুকছে অবিরামভাবে। ভারত একতরফা সামরিক জান্তাকে সাহায্য করলেও বিদ্রোহী রোহিঙ্গারা রাখাইন, কচিন ও অন্যান্য উপজাতিদের কোনোরূপ সাহায্য করতে চায়নি। ভারত সব দেশে যে কূটনীতি চালিয়েছে, তাহলো একতরফা। আর এই একতরফা কূটনীতির খেসারত দেওয়ার সময় এসেছে ভারতের। পাকিস্তানে ভারত ও আমেরিকাবিরোধী ইমরান সরকারকে মদদ দিয়ে আসছিল। তার প্রতিপক্ষকে তেমন তারা আমলে নেয়নি। শ্রীলঙ্কাও একতরফা ভারতপন্থীদের মদদ দিয়েছে, মালদ্বীপেও তাই, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সব ডিমের আধার বানিয়েছে শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনাবিরোধী কাউকেই ভারত তেমন আমলে নেয়নি। বরং হাসিনার ফ্যাসিবাদী কুমতলবকে প্রশ্রয় দিয়েছে। বলেছে, বাংলদেশে জঙ্গিবাদ হচ্ছে ভারতের উদ্বেগের কারণ। গণতন্ত্রহীনতাকে তারা তেমন আমলে নেয়নি। এ কথা ভারতের অনেকেই প্রকাশ্যে বলেছে। এক্ষেত্রে ভারত ও চীন বাংলাদেশের জন্য একই বার্তা বহন করে। মিয়ানমারেও তারা স্থিতিশীলতা দেখে সামরিক জান্তাদের মদদ দেওয়ার মধ্যে। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সামুদ্রিক সীমানাও রয়েছে। আন্দামান সাগর ও কো কো চ্যানেল দিয়ে। কাজেই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা দিয়ে আমেরিকা কিংবা চীনর নৌবহর চলাচলের এক সামুদ্রিক স্ট্র্যাটেজির অনেকটা বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করে। প্রফেসর ইউনূসের বিষয়টি ভালোভাবে জানা আছে বলেই ভারতকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্থিতিশীলতা ছড়ানো থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেভাবে আওয়ামী লীগ প্রীতির ওপর ভরসা রেখে মোদি ও মনমোহন সিং সরকার কূটনীতি রচনা করেছেন, তা থেকে রাহুল গান্ধীও বাদ যায়নি। কিন্তু তা আজ ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন রয়েছে ভারতের। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতন যেসব বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে তাহলো- (ক) মোদির ‘প্রতিবেশীসুলভ আচরণ সর্বাগ্রে’ নীতি দেওয়ালে ঠেকে গেছে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের কঠোরহস্তের কূটনীতি দূরে ঠেলে দিয়েছে। তা এখন চীনকে সহজে সেখানে আস্তানা গড়ার সুযোগ দিয়েছে। (খ) শেখ হাসিনার শাসনের নশ্বরতা ভারতের নিবর্তনমূলক কূটনীতির সীমাবদ্ধতাকে প্রকাশ করেছে। আর একই সঙ্গে ভারত পাকিস্তানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে ছোট করে দেখেছে। (গ) এছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন দক্ষিণের ভারত এখন অভ্যন্তরঢু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তাতে চীনের সঙ্গে বাড়ছে গ্যাপ আর এখানে যদি দক্ষিণ এশিয়ায় সম্পর্কে বিশ্বাস, স্বচ্ছতা ও সত্যিকার সহযোগিতায় সেতুবন্ধন রচনা করা না যায়, তাহলে তা ভারতের জন্য শুভ হবে না। এখন ভারতে মোদির হাত বেকসুর শিথিল হয়ে পড়েছে। গত নির্বাচনে মোদি তার সমর্থন হারিয়েছে অনেক। আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। নিজের সরকারের অবস্থা এখন টলটলায়মান। দক্ষিণ এশিয়া এখন অভ্যন্তরঢু সহযোগিতার জন্য উপযুক্ত স্থান। কিন্তু ভারতের নির্জলা কূটনীতির কারণে এ স্থান আজ রুক্ষ হয়ে পড়েছে। ভারতের কথায় বাংলাদেশের চিড়ে আর ভিজবে না। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে বোঝায় ভারতের নিগ্রহ থেকে মুক্তি। মালদ্বীপ ও নেপালের রয়েছে মোদির সঙ্গে বিতর্ক করার মতো মাথা। কলম্বোর সুজন সমাজ ভারতের অর্থনৈতিক বল আউট নিয়ে শঙ্কিত। কিন্তু তাতে তেমন প্রতিক্রিয়া সহজে সম্ভব না-ও হতে পারে। এমনকি ভুটানেও মোদি চীনের বিরুদ্ধে কোনো সদ্ভাব দেখতে পায়নি। যদিও তিনি সে মাসে ভুটান সফর করেছেন। 

আফগানিস্তান যদিও মোর্চার বাইরে, তারপরও ভারত সেখানে নেই। ভারতের কাছে পাকিস্তান এখনো প্রধান শত্রু। এজন্য তাদের খরচায় ঘাটতি নেই। অথচ কাশ্মীরে সাম্প্রতিক নির্বানে দিল্লিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সংবিধানের ৩৭০ ধারার পুনর্বহালের সুর তুলেছে।

বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনকে ভারতবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করে ভারতের পুতুল হাসিনাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এজন্য বলা যায়, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান গোটা দক্ষিণ এশিয়ার এক নতুন ভাবনা ও প্রভাবের জন্ম দিয়েছে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)