ট্রাম্পের পরিকল্পনা : বছরে ১ মিলিয়ন অভিবাসীকে ডিপোর্ট করা হবে


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 09-10-2024

ট্রাম্পের পরিকল্পনা : বছরে ১ মিলিয়ন অভিবাসীকে ডিপোর্ট করা হবে

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের গণনির্বাসনের দাবি পুনরায় জোরালোভাবে তুলছেন। শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছেন। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীসহ অনেক ইমিগ্র্যান্টবিরোধী রাজনীতিবিদ যদিও অতীতে এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা বাস্তবাছিু করতে পারেননি। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি ‘ডিপোর্টেশন ফোর্স’ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ডিপোর্টেশন ফোর্সের মাধ্যমে অনথিভুক্ত অভিবাসীদের গ্রেফতার ও নির্বাসিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের সামরিক বাহিনী দ্বারা গণনির্বাসনের পরিকল্পনার কথা বলেছেন। রিপাবলিকানদের গণনির্বাসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং অনেক আমেরিকানদের পরিবারের ওপর ভয়ংকর প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খামারগুলো শ্রমিকের অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে।

বর্তমানে অভিবাসনবিরোধী নেতারা গণনির্বাসনকে তাদের বক্তৃতায় গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইসিই) প্রাক্তন পরিচালক টম হোম্যান বলেছেন, একটি কঠোর প্রশাসন ক্ষমতায় এলে ‘একটি ঐতিহাসিক নির্বাসন অভিযান’ পরিচালনা করা হবে। কিছু পরিকল্পনায় এককালীন বড় ধরনের অভিযান চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনথিভুক্ত অভিবাসীদের গ্রেফতার ও নির্বাসনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্য পরিকল্পনাগুলোতে প্রতি বছর এক মিলিয়ন অভিবাসীকে নির্বাসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রিপাবলিকান দলীয় রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের কিছু পরিকল্পনায় পুরো অনথিভুক্ত জনসংখ্যাকে একত্রিত করে তাদের আটক করে নির্বাসিত করার এককালীন বিশাল অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। অন্যদিকে কিছু পরিকল্পনা প্রতি বছর ১ মিলিয়ন নির্বাসন করার ভিত্তি থেকে শুরুর কথা চিন্তা করেছে।

রাজনীতিবিদরা যখন দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ অনথিভুক্ত অভিবাসীর ভাগ্য নিয়ে বিতর্ক করছেন তখন একটি নতুন রিপোর্ট গণনির্বাসনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর অর্থনীতির উপর যে প্রভাব পড়বে তা তুলে ধরেছেন। আমেরিকান অভিবাসন অ্যাডভোকেসি সংস্থার গত ১ অক্টোবরের রিপোর্ট অনুসারে, প্রতি বছর এক মিলিয়ন অনথিভুক্ত অভিবাসীকে গ্রেফতার, আটক, প্রক্রিয়াকরণ এবং অপসারণের প্রচেষ্টা মার্কিন সরকারকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৮৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। অর্থনৈতিক খরচের বাইরেও, প্রকাশিত রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে কর্মশক্তির চার ভাগ নির্বাসিত হলে মার্কিন অর্থনীতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে মার্কিন মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ৪.২ ভাগ থেকে ৬.৮ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পাবে। তুলনামূলকভাবে, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মহামন্দার সময় মার্কিন জিডিপি ৪.৩ শতাংশ ছিল।

যদিও কিছু ইমিগ্র্যান্টবিরোধী রাজনীতিবিদ গণনির্বাসনকে একটি সহজ প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রকাশিত রিপোর্টটি এই প্রক্রিয়াটির প্রতিটি দিক ব্যাখ্যা করে এবং দেখায় যে গ্রেফতার থেকে শুরু করে আটক, প্রক্রিয়া এবং অপসারণের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশাল পরিমাণ সম্পদ এবং জনবল প্রয়োজন হবে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এক বছরের জন্য এক মিলিয়ন নির্বাসন করার প্রচেষ্টার খরচ হবে প্রায় দ্বিগুণের বেশি। যা জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যান্সার গবেষণায় পুরো বিশ্ব যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তার চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। ১৩.৩ মিলিয়নেরও বেশি অনথিভুক্ত অভিবাসীকে খুঁজে বের করা এবং গ্রেফতার করার জন্য সরকারকে ২ লাখ ১২ হাজার থেকে ৪ লাখ ৯ হাজার নতুন সরকারি কর্মচারী এবং আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তাকে নিয়োগ করতে হবে। প্রতি বছর এক মিলিয়ন গ্রেফতার পরিচালনা করার জন্যও ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টকে (আইসিই) কমপক্ষে ৩১ হাজার নতুন কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে। এ নতুন কর্মচারী নিয়োগ করতে বার্ষিক খরচ কমপক্ষে ৬.২ বিলিয়ন ডলার যা আইসিইর বর্তমান বাজেটের প্রায় সমান। এ হিসাবগুলো সম্ভবত রক্ষণশীল, কারণ এতে অতিরিক্ত মানবসম্পদ ব্যয়, প্রযুক্তি ব্যয়, আইনি ব্যয় এবং গণগ্রেফতারের কৌশল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য গৌণ খরচ অন্তর্ভুক্ত নয়।

গণনির্বাসনের প্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় খরচ হবে নতুন আটক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বিল্ডিং নির্মাণ। যেখানে লাখ লাখ মানুষকে আটক করে রাখা হবে যতক্ষণ না তাদের মামলা নিষ্পত্তি হয়। প্রকাশিত রিপোর্টটি অনুমান করে যে বছরে এক মিলিয়ন অভিবাসীকে আটক করার ক্ষমতা দ্রুত বাড়ানোর জন্য ৬৬ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। এ খরচের হিসাবও রক্ষণশীল, কারণ এর স্কেলটি বিশাল (তুলনা করতে গেলে, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ, পুরো যুক্তরাষ্ট্রে মোট ১.৯ মিলিয়ন মানুষ ফেডারেল, রাজ্য বা স্থানীয় অপরাধমূলক হেফাজতে ছিল)। ইউ এস গভর্নমেন্টকে বিদ্যমান ইমিগ্রেশন আদালতের বিচারব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করতে হবে। কারণ কাউকে অপসারণ আদেশ ছাড়া নির্বাসিত করা সম্ভব নয়। বর্তমানে, ৮০০-এরও কম ইমিগ্রেশন বিচারক রয়েছে, যারা ইতিমধ্যে ৩.৭ মিলিয়ন মামলার একটি ডকেট নিয়ে কাজ করছেন। প্রতিটি বিচারক একটি অ্যাটর্নি এবং ক্লার্ক টিমের সহায়তায় কাজ করেন এবং প্রতিটি মামলায় আইসিইর একজন সরকারি প্রসিকিউটরের উপস্থিতি প্রয়োজন হয়। প্রতি বছর গড়ে এক মিলিয়ন লোকের প্রক্রিয়াকরণ পরিচালনার জন্য প্রায় ২ হাজার নতুন বিচারক এবং ১ হাজার ১০০ নতুন আদালত কক্ষ তৈরি করা প্রয়োজন হবে। মোট খরচ হবে প্রতি বছর প্রায় ১২.৬ বিলিয়ন ডলার।

এটি সম্ভব হলেও অপসারণের খরচ আরও বাড়বে। রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর ১ মিলিয়ন অপসারণ আদেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে, কারণ অনেক অনথিভুক্ত অভিবাসী মেক্সিকো এবং কানাডা ছাড়া অন্য দেশ থেকে আসেন, যাদের ক্ষেত্রে বিমানের প্রয়োজন হবে। প্রতি ফ্লাইট ঘণ্টায় খরচ হবে ১৭ হাজার ডলার। এ খরচগুলো শুধু একটি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা। কারণ অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে নির্বাসন ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয় না, যেমন ভেনেজুয়েলা এবং চীন, যা বর্তমান সময়ে অনেক অনথিভুক্ত ব্যক্তিকে অপসারণের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তোলে। গণনির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের মধ্যে থাকবে জিডিপিতে ১.১ ট্রিলিয়ন থেকে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার হ্রাস। সরকারগুলো ট্যাক্স আয় কমে যেতে দেখবে, কারণ তারা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের দ্বারা প্রদত্ত ৪৬.৮ বিলিয়ন ডলার ফেডারেল ট্যাক্স এবং ২৯.৩ বিলিয়ন ডলার রাজ্য ও স্থানীয় ট্যাক্স হারাবে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যগুলো হবে ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস এবং ফ্লোরিডা, যদিও প্রতিটি রাজ্য জনসংখ্যার ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কিছু শিল্প বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যেমন নির্মাণ, কৃষি এবং আতিথেয়তা, যা সম্মিলিতভাবে ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি শ্রমিক হারাবে। উদাহরণস্বরূপ, দেশের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি প্লাস্টারার এবং ম্যাসন, ড্রাইওয়াল ইনস্টলার এবং ছাদ নির্মাণকারী অনথিভুক্ত। এই শ্রমশক্তি যদি অল্প সময়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়, নির্মাণ খরচ সম্ভবত আকাশচুম্বী হবে এবং নতুন বাড়ি তৈরি করতে অনেক বেশি সময় লাগবে, যা আবাসন বাজারকে ধীর করে দেবে।

স্থানীয় অর্থনীতিগুলোও বিপর্যস্ত হবে, কারণ অনেক অনথিভুক্ত অভিবাসী ব্যবসা পরিচালনা করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে অনথিভুক্ত উদ্যোক্তারা ব্যবসায় ২৭.১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন। প্রস্তাবিত গণনির্বাসনের কারণে তাদের ব্যবসা বন্ধ হলে হারিয়ে যেতে পারে। শ্রমিকের ক্ষতি, ব্যবসার বন্ধ হওয়া এবং অর্থনৈতিক মন্দার ফলে, গবেষণায় দেখা যায় যে প্রতি মিলিয়ন অনথিভুক্ত অভিবাসী নির্বাসিত হলে প্রায় ৮৮ হাজার আমেরিকান তাদের চাকরি হারাতে পারেন। অর্থনৈতিক এবং আর্থিক খরচের বাইরেও রিপোর্টে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবারের ওপর সারাত্মক প্রভাব উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক মিশ্র অবস্থানযুক্ত পরিবারে বাস করে। গণনির্বাসনের ফলে সেই পরিবারগুলোর গড়ে অর্ধেকেরও বেশি আয় হারিয়ে যাবে, কারণ তাদের রুটিরুজি উপার্জনকারীদের নির্বাসিত করা হবে। নীতিনির্ধারকদের এ প্রস্তাবগুলোর দ্বারা কেবল অভিবাসীরা নয়, সমগ্র দেশের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে তা সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। গণনির্বাসন দ্বারা পরিবারগুলোতে যে যন্ত্রণা তৈরি হবে তার পরিমাণ নির্ধারণ করার কোনো উপায় নেই, তবে রিপোর্টটি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে লক্ষ লক্ষ লোককে একত্রিত করে অপসারণের যে কোনো প্রচেষ্টা আমেরিকান জনগণের জন্য গভীর সমস্যা এবং ব্যয়বহুল হবে। নীতিনির্ধারকদের উচিত কঠোর প্রয়োগের জন্য অর্থনীতি অস্থিতিশীল না করে, দীর্ঘদিন ধরে এখানে থাকা অভিবাসীদের জন্য স্থায়ী অবস্থানের পথ অনুসরণ করার সময় আমাদের প্রয়োগ এবং বিচারব্যবস্থার জন্য সম্পদ বাড়ানো।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)