বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মাত্র কয়েকদিন আগে বলেছেন, পলাতক অবস্থা থেকেও এখনো শেখ হাসিনা হিংস্র মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করছেন। আর রাষ্ট্রপতি সেই পলাতক শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করছেন। আর এর কয়েকদিন পরই সেই রুহুল কবির রিজভী এখন বলছেন, রাষ্ট্রপতি ‘ফ্যাসিবাদের প্রোডাক্ট’ হলেও সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করা যাবে না। ব্যাখা করে এই রিজভী আরো বললেন, কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা যাতে সৃষ্টি না হয়, এ জন্য অনেক চিন্তা করে আমাদের কাজ করতে হবে। অল্প শূণ্যতা হলে সেই শূন্যতা ভরাট করা যায়। কিন্তু বড়ো শূন্যতা হলে সেটা ভরাট করা মুশকিল হয়। রিজভীর পাশাপাশি বিএনপি’র প্রভাবশালী বিশেষ করে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কঠোরভাবেই সর্তক করে দিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারকে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পরামর্শ দিয়ে তিনি আরো বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের ফসলকে ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবকে যদি সংহত করতে হয়, তাহলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।’ অন্যদিকে দেশে অনেক রকমের সাংবিধানিক সংকট তৈরি করার পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ। সাংবিধানিক সংকট সামনে রেখে পতিত ফ্যাসিবাদের দোসররা যাতে কোনো সুযোগ না নিতে পারে, সেই বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতেও বলেছেন তিনি।
কিসের সঙ্কট-যড়যন্ত্র?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি’র সাথে আন্দোলন করা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলি নিয়ে গড়া জোটের শরিকরা মনে করছেন, রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ইস্যুটি তোলা হয়েছে মূলত নির্বাচন ছাড়াই একটি জাতীয় সরকারের আদলে অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠায়। এবিষয়টির নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি’র একজন প্রবীন নেতা দেশ প্রতিনিধিকে বিস্তারিত বলেছেন। তিনি বলেন, বিএনপি বারবার জোর দিয়ে দাবি জানাচ্ছে দ্রুত সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু মাঠের দীর্ঘদিনের মিত্র বলে পরিচিত দলটি তাদেরই সমমনা বলে তৈরি হওয়া নব্য সহযোগী দলটি মিলে যড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে। তাদের হিসাব হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দলটি আরো কয়েকটি সমমনাদের নিয়ে জোট করলেও বিএনপি’র বিজয়কে ঠেকাতে পারবে না। ভোটের হিসাবে তারা বুঝেছে ক্ষমতায় যেতে দেশের মানুষের ভোট যেমন পাবে না তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও সমর্থন পাবে না। অন্যদিকে এত কম সময়ে নির্বাচন হয়ে গেলে তারা রাজনৈতিক মাঠ প্রশাসনকেও কব্জা করতে পারবে না। এসব চিন্তা করে বিএনপি’র দীর্ঘদিনের সহযাত্রী বলে পরিচিত ওই দলটি তাদের সাথে সম্প্রতি গড়ে উঠা কিছু নব্য মিত্রদের নিয়ে জাতীয় সরকারের আদলে কিছু একটা করার প্লান করেছে। শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পরও এই ধরনের একটা প্রচেষ্টা তারা করেন।
কিন্তু বিএনপি একটি সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতা হস্তান্তরের মত দেয়। ফলে সেই সময় ওই প্লান বাস্তবায়ন করতে না পারে এবার আবার তারা অন্যভাবে নিজের আয়ত্বে পরিস্থিতি নিতে চায়। তারা এখন মনে করেন, রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করলে সামনে যে সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দেবে সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা একটি বিপ্লবী সরকারের ব্যানারে জাতীয় সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। এই ধরনের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীরা মনে করে এতে করে বিএনপি’র পক্ষ থেকে যে দ্রুত নির্বাচনের দাবি করা হচ্ছে তা ভেস্তে যাবে। অন্যদিকে বিপ্লবী সরকারের ব্যানারে জাতীয় সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ইমেজকে কাজে ব্যবহার করবে তারা। এর পাশাপাশি সেই জাতীয় সরকারের তারা স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বাগিয়ে নিয়ে দল ও সংগঠনের সাংগঠনিক ভিত মজবুত করতে লম্বা সময় বাগিয়ে নিয়ে নিজেদের জন্য নির্বাচনী মাঠ তৈরি করে ফেলবেন। এছাড়াও তাদের আরো হিসাব হচ্ছে, এধরনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বিএনপি’র নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। নিমজ্জিত হবে মারাত্মক হতাশায়। আর সেই হতাশা কাজে লাগাবে সেই পরিকল্পনাকারী চক্রটি।
আরো বড় যড়যন্ত্রের গন্ধ
রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করে অন্য ধরনের আরেকটি প্রেক্ষাপট তৈরিতে মাঠের খেলোয়াড়রাও খেলে যাচ্ছে বলে বিএনপি’র বেশ কয়েকজন নেতার অভিমত। এব্যাপারে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেশ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তারা মনে করে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করে একটি মহল মূলত কোনো বাহিনীকে ক্ষমতা নেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরিতে চেষ্টা করছে। যারা সব সময় দেশপ্রেমিক জনতার মহাবিপদে পাশে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে দেশের মানুষের মন জয় করেছেন, তাদেরকেই সুকৌশলে চক্রটি ব্যবহার করতে চায় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইঙ্গিত করেছেন এই প্রতিনিধিকে। তাদের মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী’র পদত্যাগের পরপরই এমন পরিস্থিতি হতে পারে তাদের ধারণাতেই ছিল। এমন মত পোষণকারী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা ছিল শিরীন শারমিন চৌধুরী’র পদত্যাগের পরপরই রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করা বা এধরনের একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হবেই, এবং সেটা হয়েছেই।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ২৭ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। ২ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করা হলে আন্তর্জাাতিক অঙ্গনেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হতো। শোনা যায়, এবছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যোগদান করা ও সেখানে গিয়ে যেনো ভাষণ দিতে না পারেন সে-ব্যাপারে একটি মারাত্মক যড়যন্ত্রের ফাদ পাতা হয়েছিল, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপে ভেস্তে যায়।
যড়যন্ত্র ঠৈকিয়ে দিল বিএনপি
আর এবার বাংলাদেশের মাটিতে এমন ধরনের আরো একটি ভয়াবহ যড়যন্ত্র ঠৈকিয়ে দিলো বিএনপি’র হাই কমান্ড। দলটি হাই কমান্ড রাষ্ট্রপতি ‘ফ্যাসিবাদের প্রোডাক্ট’ জেনেও শুধু সাংবিধানিক শূন্যতা নয় দেশের আরো একটি ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। কেননা বিএনপি’র হাই কমান্ড সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মত নিয়েই জেনেছেন, বাংলাদেশে এখন যে সাংবিধানিক কাঠামো, তাতে ঠিক এমন সময়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা তাকে অভিসংশনের কোনো সুযোগ নেই। কেননা এখন দেশে সংসদ নেই। অন্যদিকে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে। আর এতে করে এখন এমনিতেই সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে। যদিও বিএনপি’র সাথে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করা রাজনৈতিক দলের অনেকে প্রথমে সায় দেয়নি। কিন্তু এখন বিএনপি’র সাথে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল, মতসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের ইস্যুকে মোকাবেলা করতে দলটির (বিএনপি) পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে সর্বশেষ খোজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের ইস্যুকে এখনো শক্ত হাতে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করে যাচ্ছে। কেননা একটি মহল রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরানোর দাবির পক্ষে ঐকমত্য তৈরিতে বিএনপি’কে রাজি করাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোমলমতি ছাত্রনেতাদের ইমেজকে ব্যবহার করতে চাইছে। তবে এসব ব্যাপারে বিএনপি বেশ সর্তকই রয়েছে বলে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। কেননা এর আগে কিছু রাজনৈতিক দল প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অন্যদিকে বিএনপিকে নিয়ে সুপরিকল্পিত চক্রান্তের অভিযোগ তুলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মাত্র কয়েক দিন আগেই বলেছেন, এক এগারোর মতো এবারও বিএনপিকে লক্ষ্য করে ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশের একটি গণমাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনার লিখিত পদত্যাগপত্র পাননি বলেন জানান। তবে এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ করে ফেলেন। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সংগঠন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে শহীদ মিনারে সমাবেশ ও বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে। এমনকি তারা রাষ্ট্রপতিকে পদ ছাড়তে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। পাশাপাশি হুঁশিয়ারি দেয়া হয় যে এর মধ্যে পদত্যাগ না করলে তারা বঙ্গভবন ঘেরাওসহ আন্দোলন গড়ে তুলবে।