আমার বন্ধু হলো মানুষ আর বই


আলমগীর কবির , আপডেট করা হয়েছে : 06-11-2024

আমার বন্ধু হলো মানুষ আর বই

আফসানা মিমি। ১৯৯০ সালে বাংলা টেলিভিশনে কোথাও কেউ নেই নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন। এর পর তিনি অভিনেত্রী ও নির্মাতা হিসাবে খ্যাতি পেয়েছেন। ৯ বছর আগে তিনি গড়ে তুলেছেন শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ইচ্ছেতলা’। সম্প্রতি এ প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘সুকুমার রায় উৎসব’। এ আয়োজন, ইচ্ছেতলা, এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির

প্রশ্ন: অভিনয় দিয়ে শুরু করলেও আফসানা মিমির নামের পাশে এখন অনেক বিশেষন। ব্যক্তিগতভাবে নিজের নামের পাশে কোন বিশেষনটি ভালো লাগে?

আফসানা মিমি: অবশ্যই অভিনেত্রী। এই পরিচয়টির কারণেই আমি আজকে এই জায়গায়। সেই লাইট, ক্যামেরা অ্যাকশন বলা-অভিনয় শুরু করা অবশ্যই মিস করি। তবে পর্দার সামনের চাইতে পর্দার পেছনের দায়িত্ব অনেক। তাই তো আমি পেছনে থেকেই কাজ করছি। আমি যেহেতু অভিনেত্রী তাই অভিনয়টাকে সবসময়ই মিস করি।

প্রশ্ন: অভিনয় থেকে পরিচালনায় যুক্ত হয়েছিলেন কিভাবে?

আফসানা মিমি: প্রায় বারো বছর অভিনয় করার পর ২০০১ সালের দিকে ‘মাছরাঙা‘’ নামের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেওয়ার পর অভিনয়ে আমার অংশগ্রহণ কমতে শুরু করে। আপনার প্রশ্নটি ছিল পরিচালনায় যুক্ত হওয়ার নেপথ্যের বিষয়টি। আমি যাকে বিয়ে করেছিলাম। তিনি ছিলেন একজন পরিচালক। তার সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক থাকায় পরিচালনার বিষয়গুলো আমার কাছে কঠিন কিছু মনে হয়নি। এটাকে আমার মনে হয়েছে নিজেকে আবিস্কারের সুযোগ। 

প্রশ্ন: বর্তমান এবং আগের নাটকের মধ্যে একজন পরিচালক হিসাবে কি পার্থক্য দেখেন?

আফসানা মিমি: বর্তমানে নাটকের যে বাজেট এবং নাটক নির্মাণ যে সিস্টেমে এসে ঠেকেছে তা একজন নির্মাতার জন্য সত্যিই কষ্টদায়ক। মনে আছে, আমি যখন ‘বন্ধন’ বানিয়েছিলাম তখন প্রতি-পর্ব নাটকের জন্য ৯০ হাজার টাকা পেতাম। এখনো ধারাবাহিক বানানোর জন্য সেই নব্বই হাজার কিংবা তারচেয়েও কম বাজেটে কাজ করতে হয়- যা সত্যিই কষ্টসাধ্য। সব জিনিসের দাম বেড়েছে। আর্টিস্ট থেকে শুরু করে সবার রেমুনারেশন বেড়েছে। শুধু পরিচালক ও নাটকের দামটা বাড়েনি। তাই নাটক নির্মাণ সত্যিই অনেক কষ্টের কাজ এখন। আরো রয়েছে চ্যানেলের মার্কেটিং থেকে শুরু করে এজেন্সির আলাদা একটা দৌরাত্ম্য। সব মিলিয়ে আমরা যারা সত্যিকারের শিল্পের মানুষ এবং এই জায়গাটাকে বছরের পর বছর ধরে লালন করে আসছি তারা এখান থেকে সরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এখন বোধকরি অন্য মানুষের সময়। আমাদের না। আমি সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি- কোনো চ্যানেলেই সত্যিকারের নাটকের মানুষকে উপদেষ্টা কিংবা নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে রাখা হয়না। কেনো সেটা জানি না। দু’একটি চ্যানেল বাদে আর সবগুলোতে অন্য জগতের মানুষ কর্তৃত্ব করছে। যারা যুগের পর যুগ শিল্পচর্চা-নাট্যচর্চা কিংবা জায়গাটাকে লালন করে এসেছে তারা কিন্তু কেউ নেই নীতি নির্ধারক পর্যায়ে। এটা সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের নাটকের যে অতীত-ঐতিহ্য- তা কিছু ফরম্যাটের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে। জানি না এর শেষ কোথায়?

প্রশ্ন: ইচ্ছেতলার সুকুমার উৎসব সম্পর্কে বলুন?

আফসানা মিমি: প্রখ্যাত ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার সুকুমার রায়ের জন্মদিন ছিল গত ৩০ অক্টোবর। এ সময়ের শিশুদের সঙ্গে সুকুমার রায়ের ছড়া, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এ আয়োজন করা হয়েছে। ‘আবোল তাবোল’ শিরোনামের এ আয়োজনে অংশ নিয়েছে প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ জন শিশু ও কিশোর। ইচ্ছেতলার শিশু-কিশোররা সুকুমার রায়ের ছড়া, কবিতা, তাঁর সাহিত্য পড়ার পাশাপাশি তাঁর লেখা ‘অবাক জলপান’ নাটকটির মঞ্চায়ন করে। 

প্রশ্ন: ইচ্ছেতলায় কি সারা বছরই এমন আয়োজন থাকে?

আফসানা মিমি: হ্যাঁ। সারা বছরেই আমাদের বিভিন্ন ধরনের আয়োজন থাকে। এই যেমন শ্রাবণে আমরা গাছ লাগিয়েছি। আমরা চৈত্রসংক্রান্তি করি, মঙ্গল শোভাযাত্রা করি। প্রবারণা পূণির্মাতে ফানুস উড়িয়েছি, ক্রিসমাসও করেছি। 

প্রশ্ন: ইচ্ছেতলা ঠিক কী ধরনের স্কুল?

আফসানা মিমি: ইচ্ছেতলাকে আমরা ঠিক স্কুল বলব না, কারণ স্কুলের কনসেপ্টটা এমন যে, স্কুলে কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হয়, আবার তা পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ দিতে হয়। ইচ্ছেতলাকে আমরা বলতে পারি একটা কেন্দ্র। শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র। আমরা চাই, ছেলেমেয়েরা এখানে আসুক। ওদের কিছু সুন্দর সময় কাটুক। প্রতি শুক্র ও শনিবার বিকেলে ঘণ্টা তিনেক সময়ের জন্য বাচ্চারা ইচ্ছেতলায় আসে। ওদের জন্য সব ধরনের বিষয় মিলিয়ে একটা সিলেবাস আমরা তৈরি করে রেখেছি। বাংলা চর্চা ক্লাসে ওরা হয়তো গল্প লেখে বা গল্প শোনে বা ছড়া-কবিতা পড়ে, কিছু ক্রিয়েটিভ রাইটিং করে। গানের ক্লাসটাও একই রকম। ওরা হয়তো সারগাম শিখছে, টুকটাক তাল শিখছে। তার মানে এই না যে, ওরা সংগীতশিল্পী হওয়ার জন্যই গান শিখছে; গান ভালো লাগার জন্যই ওরা গানটা শিখছে।

প্রশ্ন: ইচ্ছেতলা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী...

আফসানা মিমি: আমি এইচএসসি পাস করে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হই। আমি মনে করি সেটিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বলেই একটার পর একটা দরজা আমার জন্য খুলে গেছে। এজন্যই আমরা বলছি, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার চর্চাগুলো আসুক এবং দরজা-জানালাগুলো খুলে যাক। ধুলা-বালি-বৃষ্টি-আলো সব আসুক; তবুও দরজা-জানালাগুলো খোলা থাক। আমরা চাইছি, বাচ্চারা প্রকৃতি আর মানুষকে ভালোবাসুক, দেশটিকে জানুক; সবকিছুর প্রতি তাদের ভালোবাসা তৈরি হোক। সবকিছু তারা আনন্দ নিয়ে করুক। ‘ভালোবাসা’ এবং ‘আনন্দ’ শব্দ দুটো খুব জরুরি জীবনের জন্য। বই তার বন্ধু হোক, গান তার বন্ধু হোক, গল্প তার বন্ধু হোক, প্রকৃতি তার বন্ধু হোক, মানুষ তার বন্ধু হোক।

প্রশ্ন: চলমান পরিস্থিতিতে আপনি কি আশাবাদী?

আফসানা মিমি: আমি খুবই আশাবাদী। নৈরাশ্য আমার অভিধানের শেষ শব্দ।

প্রশ্ন: চারদিকে এত এত নেতিবাচক বিষয় ঘটে চলছে। এগুলো এড়িয়ে চলেন কীভাবে?

আফসানা মিমি: যখন দেখি কোনো মিথ্যা, অপ বা নেতিবাচক কিছু তখন খুব দ্রুত সেখান থেকে সরে যাই। কখনও নেগেটিভিটি দ্বারা আক্রান্ত হলে আমার ভেতরের আমি আমাকে শাসন করে। মনকে আলোকিত করতে হবে। আর মনের আলো হচ্ছে জ্ঞান। আমার জীবনের বন্ধু হলো মানুষ আর বই। কখনও এমন হয় কোনো মানুষের থেকে দূরে সরে যেতে হয়, কিন্তু বইয়ের ক্ষেত্রে এ সমস্যাটা নেই। বই সবসময়ের বন্ধু। মনে অন্ধকার নিয়ে কখনও শুদ্ধতার চর্চা করা যায় না।

প্রশ্ন: আরেকবার সুযোগ পেলে কী হতে চাইতেন?

আফসানা মিমি: এখন যা আছি সেটিই আবার হতে চাইতাম। কিছু কিছু জায়গায় হয়তো সামান্য পরিবর্তন চাইতাম। তবে সব মিলিয়ে যা আছি সেটিই হতে চাইতাম।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)