নতুন বছরে ট্রাম্পের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 01-01-2025

নতুন বছরে ট্রাম্পের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ

নতুন বছরে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার ওপর ভোটাররা যে আস্থা প্রকাশ করেছেন, তা অর্জন করতে হলে তাকে পাড়ি দিতে হবে চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারণার সময় অন্যতম ইস্যু ছিল অর্থনীতি। মার্কিন ভোটাররা যে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছেন তা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রোসারিগুলোতে মূল্যস্ফীতি অনেক এবং পণ্যের মূল্য অনেক বেশি। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছে। এ উপলক্ষে নিউইয়র্ক সিটিতে ১২ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মার্কিনিরা খুব শিগগিরই গ্রোসারিতে কেনাকাটায় সক্ষম হবেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের অর্থনীতি বিভাগের এনার্জি বিষয়ক ফেলো এড হিরস বলেন, তিনি যতটা বলেছেন অতটা সহজ হবে না। অন্তত সঙ্গে সঙ্গে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। ওদিকে মেক্সিকো, কানাডাসহ শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদারদের কাছ থেকে পণ্য আমদানিতে ট্রাম্প শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। এড হিরস বলেন, যদি তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমদানি কর বাড়িয়ে দেন, তাতে পণ্যমূল্য বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, যদি মেক্সিকোর পণ্যের ওপর শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনকারীর সেই ২৫ ভাগ মূল্য বাড়ানোর সক্ষমতা থাকতে হবে, ঘটবে এটাই। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং কানাডা মিলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ করে থাকে বছরে প্রায় ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। ট্রাম্প যদি শুল্ক হার বৃদ্ধি করেন, তাহলে উৎপাদিত পণ্যের খুচরা দাম অনেক বেড়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, কানাডা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কানাডার কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪০ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ওপর শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হলে পুরো দেশে প্রতিজন ভোক্তার ওপর তার ফল পড়বে। তাদের তেলের দাম বেড়ে গেলে তখন অভ্যন্তরঢু উৎপাদনকারীরাও তাদের পণ্যের সমান মূল্য বাড়িয়ে দেবেন। ট্রাম্প মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তাই তিনি এ সংক্রান্ত আইন ঢেলে সাজাবেন। তবে শুরু করবেন গণহারে অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলেই তাকে নাগরিকত্ব দেওয়ার যে বিধান আছে, তা-ও বাতিল করে দিতে চেয়েছেন। কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। একটি নতুন আইন করার কথাও তুলেছেন তারা। এড হিরস বলেন, গণহারে লাখ লাখ ডকুমেন্টবিহীন অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দিলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেই সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। শ্রমিকদের করা কাজ বা গড়পড়তার কাজের ক্ষেত্রে জনশক্তির সংকট দেখা দেবে। এসব এমন কাজ, যা মার্কিনিরা করতে চান না। এর মধ্যে আছে বাড়ির লন দেখাশোনা করা, হাঁড়ি-পাতিল পরিষ্কার করা, রেস্তোরাঁর টেবিল পরিষ্কার করা। তিনি টেক্সাসের পশ্চিমে পারমিয়ান বেসিনে তেলক্ষেত্রগুলোর কাজের দিকে ইঙ্গিত করেন। বলেন, এসব স্থানের তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪৮.৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। এতো কড়া তাপমাত্রায় কাজ করার জন্য কর্মী পাওয়া কঠিন হবে। গ্রীষ্মের কড়া গরমে তেলক্ষেত্রগুলোতে কাজ করতে হয়। ফলে এসব অভিবাসী শ্রমিককে ফেরত পাঠানো হলে তার আগে ওই কাজ করবে এমন মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে খুঁজে বের করতে হবে। 

ওদিকে চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক মোটেও ভালো নয়। তিনি নিজে সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে ২০২০ সালে তিনি প্রথম মেয়াদে ওভাল অফিসের দায়িত্বে থাকার সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল উত্তেজনার। ফ্লোরিডার মার-এ-লাগো অবকাশযাপন কেন্দ্রে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোভিডের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। তিনি শি জিনপিংকে একজন বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট একজন বিস্ময়কর মানুষ। ট্রাম্প আরো বলেন, কোভিড সম্পর্ককে শেষ করে দেয়নি। কিন্তু সেই সম্পর্ক আমার থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক যুদ্ধের আবির্ভাব হয়। এর ফলে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে এলোমেলো করে দেয়। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। কারণ চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুদ্রাস্ফীতি আকাশচুম্বী হয়। কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক যেখানে রেখে এসেছিলেন সেখান থেকে শুরু করতে চান। চীন থেকে পণ্য আমদানি করলে শতকরা ৬০ থেকে ১০০ ভাগ শুল্ক আরোপ করতে পারেন। তা যদি করেন, তাহলে সেটা হবে আরেকটি বাণিজ্যিক যুদ্ধ। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আবারো বিঘ্নিত হবে। আরো ক্ষতির শিকার হবে যুক্তরাষ্ট্র। এড হিরস বলেন, ট্রাম্প যদি মেক্সিকো, কানাডার পণ্যের ওপর শতকরা ২৫ ভাগ শুল্কসহ এ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন, তাহলে দ্রুততার সঙ্গেই মুদ্রাস্ফীতি এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা কখনো দেখা যায়নি। তিনি আরো বলেন, চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প আক্রমণ চালিয়েছিলেন তার প্রথম মেয়াদে-এটা আমরা জানি। জবাবে চীন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপরে উচ্চ শুল্ক আরোপ করেনি। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শস্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিল। 

বিশ্ব ক্রমশ সংঘাতময় হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত যুক্তরাষ্ট্র। এসব যুদ্ধ ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। তিনি যদি এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেন, তাহলে প্রশংসিত হবেন। বিশেষ করে গাজাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। তবে ট্রাম্প যে ইসরায়েলের প্রতি ভীষণভাবে ঝুঁকে আছেন বা থাকবেন তা নতুন করে বলার কিছু নেই। ফলে তিনি ফিলিস্তিনবাসীর স্বার্থকে বড় করে দেখবেন না। ইসরায়েলের সঙ্গে তার সখ্য কোনো গোপন কথা নয়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েল সেখানে বিমান, স্থল হামলা চালিয়ে গণহত্যা চালিয়ে কমপক্ষে ৪৫ হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইসরায়েলকে সামরিকসহ নানাবিধ সহায়তা অব্যাহত রেখেছে, যা দিয়ে তারা নিরীহ গাজাবাসীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। ট্রাম্প কি তার ব্যতিক্রম কিছু করবেন? এ জন্য তার দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক মহল এ যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প কী করেন, সেদিকে তাদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র সেট করে রাখবে। এখানে উল্লেখ করতেই হয় যে, ১৯৬৭ সালে সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমিকে কেড়ে নেয় ইসরায়েল। ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে এই গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণ সরকারি ভাবে পশ্চিমা নেতাদের মধ্যে সবার আগে স্বীকৃতি দেন ট্রাম্প। এখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত। ফলে ইসরায়েল সরকারের কিছু সদস্য আশা করছেন, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে সম্প্রসারিত ইসরায়েলি বসতিকে তিনি স্বীকৃতি দেবেন। পশ্চিম তীর বর্তমানে আইনগতভাবে ফিলিস্তিনিদের। কিন্তু সেখানেও থাবা বসিয়েছে ইসরায়েল। এড হিরস বলেন, কোনো পক্ষ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই যুক্তরাষ্ট্রের। তিনি বলেন, গাজা উপত্যকার ট্র্যাজেডি হলে কয়েক লাখ মানুষ সত্যিকার অর্থে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে। তারা সমুদ্রপাড়ে তাঁবুতে বসবাস করছেন, খাবার নেই। এটা নরহত্যা। এটা যুদ্ধের একটি সবচেয়ে খারাপ দিক। আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসন কি গাজার সমাজ ব্যবস্থাকে গড়ে তোলার জন্য কোনো ভূমিকা নেবেন কি না, জানি না। এখানেই শেষ নয়। ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসবেন, তখনো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকবে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে তিনি কথা বলবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে। তিনি তাদেরকে একটি চুক্তি করার ওপর জোর দেন। এর মধ্যদিয়ে উভয় নেতা যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দেবেন। ট্রাম্প বলেন, এই যুদ্ধ থামাতে হবে। এমন অনেক শহর আছে, যেখানে কোনো ভবন আর দাঁড়িয়ে নেই। এড হিরস বলেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মতোই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। যদিও ট্রাম্প বলেন, তিনি চান দুই দেশ যুদ্ধবিরতি চুক্তি করুক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাতে জড়িত হবে না। তবে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাড়াতে পারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। তারা সতর্কতার সঙ্গে মনে করে ন্যাটোসহ আন্তর্জাতিক বড় বড় জোট থেকে যদি ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন, তাহলে তার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে টেক্কা দেওয়ার জন্য বিশ্বের অন্য সুপার পাওয়ারগুলোর জন্য সুযোগ করে দেওয়া হবে। যদি ট্রাম্প এসব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে না আসেন, তাতে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হবে। এর ফলে শি জিনপিং, ভ্লাদিমির পুতিন অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এগিয়ে আসবে। তাতে বিশ্বনেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা খর্ব হবে। এটা হবে তাদের জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতি। 

আরেকটি বৈশ্বিক স্বার্থে ট্রাম্পকে অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে। তা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ কমিয়ে আনার জন্য একটি আইন করেছে। এর নাম ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (আইআরএ)। গ্রিনহাউজ নির্গমন কমাতে বিনিয়োগ করা হবে কমপক্ষে ৩০০ বিলিয়ন ডলার। ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন ট্রাম্প। তারপর জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে তা পুনর্বহাল করেন। এখন আবার ট্রাম্প কি করবেন, তা সময়ই বলে দেবে। 


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)