ট্রাম্পের শপথ ও আ’লীগের স্বপ্ন দেখা


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 22-01-2025

ট্রাম্পের শপথ ও আ’লীগের স্বপ্ন দেখা

যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ সম্পন্ন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ট্রাম্পের শপথ ঘিরে ভারত ও বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্ছাস দেখা যায়। কথিত আছে, ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠজন। মোদীকে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজে দেখা গেছে। একই সঙ্গে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আস্থাভাজন। একই সূত্রে ট্রাম্পের সঙ্গে তার সখ্যতা কম। যেহেতু ভারত ও নরেন্দ্র মোদীর আস্থাভাজন ট্রাম্প, তাইতো বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর একটা সন্ধিক্ষণ দেখছেন অনেকে। মনে করছেন, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পেছন থেকে সহযোগিতা করা যুক্তরাষ্ট্র বা বাইডেন প্রশাসন ও ড. ইউনূসের প্রভাব এখন অনেকাংশেই কমে যাবে। সেখানে প্রতিষ্ঠা পাবে ভারত ও মোদীর প্রভাব, রাজনীতিতে পূর্ণবাসিত হবে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। সমীকরণটা ঠিক এমন। এতেই বাংলাদেশে এক ধরনের স্বপ্ন দেখা শুরু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ও একধরনের উচ্ছাস। 

যেমনটা নড়েচড়ে বসেছিল তারা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পরপর। গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে সমাবেশ করা ও ট্রাম্পের ছবি অংকিত পোস্টার ব্যানার নিয়ে মিছিল করারও প্রচারণা চালিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ছাত্র জনতার প্রতিরোধে সেখানে ছিটেফোঁটাও উপস্থিতি ঘটেনি। এমনকি ট্রাম্প বিজয়ের পর বেশ ক’দিন অতিবাহিত হলেও তার কোনো প্রভাব বাংলাদেশের প্রশাসনের উপরও পড়তে দেখা যায়নি। 

এরপর শুরু দ্বিতীয় দফার ওই স্বপ্ন। ট্রাম্প শপথ নিয়ে কিছু একটা করে বসবেন। বিশেষ করে এ জাতীয় প্রপাগান্ডা ভারতের কতিপয় রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া সুকৌশলে প্রচার করে গেছে। যার পেছনে বাংলাদেশ ইস্যু যতটুকু নয়, তার চেয়ে বাংলা অধ্যুষিত বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দুদের মন জয় করাই মুখ্য। কারণ সেখানে নির্বাচন আসন্ন। 

ভারত অতীতে যা করেনি ইদানিং সে কাজটাও শুরু করেছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া। একটা দেশ তার সীমান্ত সুরক্ষা রাখতে কঠোর বেষ্টনী দেয়া অপরাধ নয়। কিন্তু সেটা যদি আন্তর্জাতিক সীমারেখা বরাবর হয় এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে কোনোরকম আলাপ আলোচনা ছাড়াই, তখন বিপত্তি ঘটে। এ নিয়ে সীমান্তে কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করছে দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে। যার পেছনে উস্কে দেয়া ঘটেছে সে দেশের রাজনীতি ও কতিপয় বিতর্কিত মিডিয়া। 

এদিকে বেশ ক’দিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহের হওয়ার খবর মিলছে, যার প্রায় ৯৯% ভাগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই। বাস্তবে মাঠেই নেই যেখানে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী এবং পলাতক ও আড়ালে আবডালে। সেখানে প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলার কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর আগে পতিত শেখ হাসিনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছু বক্তব্য প্রদান করে আসছিলেন। যাতে করে কিছু কিছু স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উচ্ছাসিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইউনূস প্রশাসন ভারতীয় কতৃপক্ষকে ডেকে শেখ হাসিনার এ ধরনের বক্তব্য ও দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি না করার জন্য আহ্বান জানানোর পর থেকে সেটা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। 

তবে আওয়ামী লীগ উচ্ছাস প্রকাশ করার কিছু কারণও ইতিমধ্যে ঘটেছে। যেটা সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে রদবদলকে কেন্দ্র করেই। বাংলাদেশে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়া (ও কিছুটা আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে যেয়ে কাজ করা) সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে পদত্যাগের ঘটনাকেও ’ট্রাম্পের খেলা’ উল্লেখ করে পোস্ট দিয়েছেন দলটির অনেক কর্মী ও সমর্থক। এর আগে কথিত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক কাজ করে যাওয়া সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার হাস চাকরি ছেড়ে দেয়াটাও আওয়ামী লীগকে উৎসাহ যুগিয়েছিল। 

ট্রাম্প শপথের পর নতুন করে কোনো প্রতিক্রিয়া আওয়ামী লীগ এখনও দেয়নি। তবে আওয়ামী লীগের ’২০২৪ এর নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়া ও সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যাদের সমর্থন যুগিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন সেটি করবে না বলেই তারা মনে করেন।

অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন ঘটালেও তাদের নেয়া যে পররাষ্ট্র নীতি সেটা মোটেও পরিবর্তনে যান না। প্রেসিডেন্ট চাইলে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারেন। কিন্তু ট্রাম্পের সে সময় ও ইচ্ছা, প্রয়োজনীয়তা আছে কী? ইস্যুটা জমজমাট করে ফেলেছে পতিত আওয়ামী লীগ। দলের নেতাকর্মীদের পুনুরুজ্জীবিত করার একটা কৌশল হতে পারে দলটির শীর্ষপর্যায়ের ইন্ধনে। তাছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনের আগে ভারতীয় মিডিয়ার অব্যাহত উদ্ভট তথ্য সম্বলিত খবর পরিবেশনের জের থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে একটি টুইট করেছিলেন, যা আলোচনার ঝড় তুলেছিলো সেসময়। ওটা থেকেই অনেকে ধারণা করছেন ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের নীতির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইউনূস প্রশাসনের বেলায় কিছুটা পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। 

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীসরকার সবসময় ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে।

এদিকে সম্প্রতি মোহাম্মদ আলী আরাফাত একটি বিদেশী মিডিয়ায় বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সমর্থকদের জন্য যেমন অস্বস্তির কারণ হবে, তেমনি এটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উজ্জীবিত করবে।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্প যাদের পছন্দ করে না- তারা বাংলাদেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবকে বিশেষ পছন্দ করেন। ফলে আমরা মনে করি ইউনুস সাহেব বাইডেন প্রশাসনের যেমন সমর্থন পেয়েছেন সেটি তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে পাবেন না”। 

শেখ হাসিনা তার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচক ছিলেন। বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসনকে তিনি অনেক ধরনের কথা বলতেন প্রকাশ্যে। এ নিয়ে কখনও কখনও স্টেড ডিপার্টমেন্টও বিবৃতি দিয়েছে। ফলে এ দুইয়ে কিছুটা টানাপোড়েন আগ থেকেই। এবং সূচনা ঘটে বাইডেন তার নির্বাচনি অঙ্গীকারে যখন বলেছিলেন তিনি বিশ্বের সব দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন এবং গণতন্ত্র যে সব দেশে পিছিয়ে সেসব দেশে তিনি গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখবেন। 

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ যে তিন টার্ম ক্ষমতায় ছিল তার মধ্যে ২০১৪ ও ২০১৮ ও ২০২৪ সনের নির্বাচন ছিল একতরফা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সাঝানো প্রশানের প্রভাবিত। যার পেছনে শক্তি যোগাতেন বলে অভিযোগ ভারতের কতিপয় রাজনীতিবিদদের। এতেই বাংলাদেশের উপর দৃষ্টি ছিল বাইডেন প্রশাসনের। বারবার আহ্বানও জানিয়ে আসছিল তার প্রশাসন যেন বাংলাদেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হয়, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীন। আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রের এ আহ্বানকে বাঁকাচোখে দেখে উল্টা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র যেন নাক না গলায় সে আহ্বান জানিয়ে আসতেন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ছিল সেখানেই। যেহেতু বাইডেন ছিলেন প্রেসিডেন্ট এবং তিনি তার নির্বাচনি অঙ্গীকার পূরনে স্বচেষ্ট ছিলেন। 

আর ওই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের থাকার সময়ে শেষ কয়েক বছরে নির্বাচন ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসন শেখ হাসিনা সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ তৈরি করে গেছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের সাঝানো প্রশাসন কতৃক গুম খুনের অভিযোগ তুলে বিভিন্ন মানবাধিকার রিপোর্ট এর ভিত্তিতে।

শেখ হাসিনা প্রশাসনের প্রধান অস্র র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিসা নীতি ঘোষণার ঘটনায় বেকায়দায় পড়েছিলো তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার। এছাড়াও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও প্রশাসনের অনেকের বিরুদ্ধে বিশেষ করে যারা শেখ হাসিনার এক তরফা ও পাতানো নির্বাচনে সহযোগিতা করবে তাদের উপরও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেবে এমন ঘোষণায় শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করেছেন। সবশেষ জুলাই অগাস্টের আন্দোলনের পেছনেও ’যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে’ বলে অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক বিশ্বাস করে থাকেন।

ফলে এখন বাইডেন চলে যাওয়ায় সেখানে ট্রাম্প এসে নতুন কোনো ফর্মুলা নিয়ে এগুবেন কি না সেটা কে জানে!


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)