ক্ষোভ বাড়ছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে। কেন্দ্র থেকে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি দেওয়ায় সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ বিরাজ করছে। ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় দলের কর্ণধার শেখ হাসিনা। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাওয়াটা আওয়ামী লীগেরই অনেকে কাপুরুষতা অভিহিত করেছেন। আওয়ামী বিরোধীদের প্রচারণা এ ব্যাপারে তুঙ্গে। ভীষণ চাপে দলের তৃণমূলে নেতাকর্মীরা। ক’দিন যেতে না যেতে লক্ষ করা গেল, শুধু শেখ হাসিনা একা যাননি। গিয়েছেন তার কাছের আত্মীয়স্বজনরা সবাই। এমনকি ৫ আগস্টের আগে এবং ওইদিন রাতে সবাই বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন ফ্যামিলির সব সদস্যকে নিয়ে। ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে যারা অবশিষ্ট ছিলেন, তারাও বিশেষ ব্যবস্থায় পার পেয়ে গেছেন। তাহলে দেশে যে অবশিষ্ট কোটি কোটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী তাদের কী হবে? তাদের কথা তো কেউই ভাবলো না। এরা কী মরে যাবে, না পিষ্ট হবে সে খবর নেওয়ারও কেউই অবশিষ্ট থাকলো না। এ নিয়েই ক্ষোভের শুরু।
এরপর দলটির অভ্যন্তরে প্রায় ছয় মাস কেটেছে এমন ভয়ার্ত অবস্থায়। এ ছয় মাস ভয় তাড়ানোর যেসব উপায় সেগুলো খুঁজে হয়রান হয়েছে তারা। কারণ এলাকায় টিকতে হলে দীর্ঘদিন যাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে হয়েছিল বা করেছিল, এবার তাদের শরণাপন্ন হওয়া ও তাদের বোঝানো ও ক্ষমা চাওয়া, ম্যানেজের মতো কাজগুলো সম্পাদিত করেই তারা সবে কিছুটা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। বিএনপি ও জামায়াতের যারা নির্যাতিত হয়েছে, তারাও ভুলতে বসেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি সব তছনছ করে দিয়েছে।
কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে লিফলেট বিতরণ ও মিছিল, হরতাল ধর্মঘটের এটাতে বিপাকে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। কারণ এ কর্মসূচি করতে যাওয়া মানেই যাদের শরণাপন্ন হয়ে ম্যানেজ করে টিকে থাকার লড়াইটা চালাচ্ছিলেন, তাদের বিরোধিতার মুখে পড়ে যেতে হলো। ফলে অনেকেই এতে শরিক না হলেও অর্থাৎ কর্মসূচি পালন না করলেও সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করেছে বিএনপি ও জামায়াত। এটা দুশ্চিন্তার কারণ।
হঠাৎ এমন কর্মসূচি অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না নেতাকর্মীরা
দীর্ঘ ১৬ বছর টানা ক্ষমতায় থেকে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগ ছয় মাসের মাথায় কেন আবার কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে এ চিন্তা মাথায় আসছে না তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। লিফলেট, মিছিল, দু-একটা হরতাল করেই কী অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলে দেওয়া যাবে? তাছাড়া এসব কর্মসূচি ফ্রন্টলাইনে গিয়ে কে পালন করবেন?
যেখানো ছাত্র-জনতার ক্ষোভ তুঙ্গে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত থাকা যারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত, ছাত্রহত্যায় জড়িত তাদের গ্রেফতারে। অথচ দীর্ঘ ছয় মাস চুপচাপ থাকায় আটক হওয়া অনেক বড় নেতৃবৃন্দও জামিনে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, যা ছিল দলটির জন্য ভীষণ পজিটিভ। এমন এক মুহূর্তে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি এসব রিদম ছারখার হয়ে গেছে। উল্টা এখন ধরপাকড় শুরু। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার অনেকেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের অনেক নেতাকে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিচ্ছে।
অথচ এর কিছুদিন আগেও পুলিশ যদি কোথাও কাউকে আটক করতে গেছে বা আটক করেছেও তাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিলে ছাড়িয়ে রেখেছেন, জোরজবরদস্তি করে ছিনিয়ে নিলেও তাতে কেউ খুব একটা কান দেয়নি। এখন এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কঠোর চাপ। যার নির্দেশনা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যে দিয়েও ফেলেছেন, এ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচির পর। ফলে যে গর্তে ঢুকে লুকিয়েছিল তারা, আবারও সে গর্তে ঢুকে যেতে হচ্ছে, পালাতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে অনেকটা সবারই মুখে মুখে যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা কোটি কোটি নেতাকর্মীকে রেখে কীভাবে পালিয়ে গেলেন ফ্যামিলির সবাইকে নিয়ে। ফ্যামিলি ও আত্মীয়স্বজনের কাউকেই তিনি রেখে যাননি। তাহলে নেতাকর্মীরা তার কী হন? এদের অপরাধ কী? এ ক্ষোভ বিরাজ করছে। কেউ কেউ বলছেন, উনি তো (হাসিনা) দিল্লিতে ভালোই রয়েছেন। ছোট বোন রেহানাও লন্ডনে বেশ হাসিখুশি দারুণ পরিবেশে। ছেলে আমেরিকাতে ভালো অবস্থানে। এককথায় ফ্যামিলির সবাই ভালো অবস্থানে। শুধু তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিপাকে। থাকতে হচ্ছে ধরপাকড়ের মধ্যে, হুমকি-ধমকির মধ্যে। নিজেরাও এ ব্যাপারে অভ্যন্তরে ব্যাপক সমালোচনা। কেন এমন বিপর্যয়? সাংগঠনিক দুর্বলতা কোথায়? অর্থ পাচার, লুটপাট। বাদ যাচ্ছে না বিরোধীদলের ওপর নির্যাতনও। অথচ সব জায়গায় গণতান্ত্রিক আচরণ হলে আজ এমন অবস্থায় পড়তে হতো না কাউকেই।
ডেট লাইন শেখ হাসিনার ভাষণ
শেখ হাসিনার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে দেশে যা ঘটলো সেটা নজিরবিহীন। ৫ আগস্টের পর আরো একটা খারাপ সময় এখন দলটির নেতাকর্মীদের। ঘোষণা দিয়ে বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে ওই রাতেই ৩২ নম্বরের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে এককথায় গুঁড়িয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। এরপর সুধাসদনে আগুন। খুলনা বরিশালে শেখ পরিবারের বিল্ডিংয়ে বুলডোজার চলে। ভেঙে চুরমার করেছে আমির হোসেন আমুর বাড়ি। নোয়াখালীতে ওবায়দুল কাদেরের বাড়ি। কুষ্টিয়ায় মোহাম্মাদ হানিফের বাড়ি। এছাড়াও শাহরিয়ার হোসেন, শামীম ওসমানের দাদার বাড়ি, শেখ সেলিমের গুলশানস্থ বাড়ি
ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এর বাইরেও অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়ি, অফিস, শেখ মুজিবের ম্যুরাল, বিভিন্ন স্থানে নামফলক ভেঙে একাকার। এককথায় দেশজুড়ে শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগের নিশানার ওপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেছে। অবশেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কঠোর নির্দেশনায় এগুলো থেমেছে। তবু গাজীপুরে আ ক ম মোজাম্মেলের বাড়িতে আক্রমণ করতে গিয়ে দুই পক্ষে সংঘর্ষ, গাজীপুরে আওয়ামী সমর্থিত কর্তৃক ছাত্রকে গুলি করাকে কেন্দ্র করে উত্তাপ ছড়ায়। যে সূত্র ধরেই শুরু দেশজুড়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট।
যৌথবাহিনীর এ ডেভিল অভিযানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খুঁজে খুঁজে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলমান। দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত এ অভিযোগে এবং বিভিন্ন হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মামলায় যারা এতদিন নির্ভার ছিলেন, নির্ভয়ে সময় অতিক্রম করছিলেন, তারা পড়লেন তোপের মুখে। একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, নেত্রী, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মী। এক কথায় গর্তে লুকিয়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা তাদের। যাতে যৌথবাহিনীর হাত থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু টার্গেটকৃতরা বেঁচে থাকতে পারছেন না।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, যতদিন ডেভিল পাওয়া না যাবে, ততদিন অভিযান চলবে।
সবশেষ
ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি ও শেখ হাসিনার ঘোষণা দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার কর্মসূচি এড়িয়ে গেলে এমন পরিস্থিতির অবতারণা হতো না বলে বিশ্বাস দলটির নেতাকর্মীর। এ ব্যাপারে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী একই অভিমত দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাদের দাবি ক্ষমতার সুফলভোগী যারা, তারা পালিয়ে গেছেন লুকিয়ে। তারা আগে এসে রাস্তায় নামুক, তারপর আমরা নামবো। তাদের কোনো খবর নেই। ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস পর্যন্ত দিচ্ছে না ভয়ে, তারা রাজপথে এতো বড় কর্মসূচি দিচ্ছে কাদের ওপর ভর করে? আমরা কেন বিপদের মধ্যে নিজেদের সঁপে দেবো, ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন এক মধ্যমসারির নেতা। অথচ ৫ আগস্টের কিছুদিন পর থেকে আমরা ভালোই ছিলাম। আমাদের সে ভালো আর থাকতে দিলো না নেতাদের অদূরদর্শী এবং স্বার্থান্বেষী কর্মসূচি।