ছাত্ররা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে কেন


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 05-03-2025

ছাত্ররা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে কেন

ছাত্ররা আবার রাজনৈতিক দল করবে কেন? এটা বাংলাদেশে এখন একটা কমন প্রশ্ন। কিন্তু বিষয়টি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেই ক্লিয়ার, ছাত্ররা কেন দল করছে? বাংলাদেশের প্রয়োজনে। জনগণের প্রয়োজনে, দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রয়োজনে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল করার উপযুক্ত সময় এক্ষুনি। বরং ছাত্রদের সাধুবাদ দেওয়া উচিত তারা নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে জাতির ক্রান্তিলগ্নে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তা করেছে। কারণ মেধাবী এ ছাত্ররা এখন চাইলেই বিদেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে অনায়াসে উন্নত লাইফ বেছে নিতে পারে। বাংলাদেশেও সরকারি চাকরি না নিলেও বড় হাউজে করপোরেট জব নিয়ে একান্তে সুখ-শান্তিতে বাস করতে পারেন। এরপরও তারা রাজনীতির মতো বিশেষ করে বাংলাদেশের এমন প্রেক্ষাপটে যেখানে ক্ষমতাধর ও দীর্ঘ ১৬ বছর দেশ শাসন করা একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলকে দুমড়ে মুচড়ে পিষ্ট করে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াচ্ছে। 

ছাত্রদের মধ্যে অফুরন্ত দেশপ্রেম 

দীর্ঘ ১৬ বছর গণতন্ত্রহীনতা, স্বৈরাচারী, অনেকটাই একদলীয় এক শাসনব্যবস্থা দেখেছে মানুষ। নির্বাচন হয়, কিন্তু সেটা ওই সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। দিনের ভোট রাতে। ব্যালট পেপার ভর্তি করে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, কেন্দ্রে কাউকে না যেতে দেওয়া। চাকরি মানেই সরকারদলীয় সমর্থকদের বা সুপারিশ ভিন্ন নয়, নিজ দলের লোকদের ডামি বিরোধীদলের প্রার্থী বানিয়ে নির্বাচন করানো, হত্যা, গুম, খুন, ব্যাংক ডাকাতি, অর্থ পাচার থেকে শুরু করে হেন কাজ না ছিল করেনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এসবের বিরুদ্ধে যে যখন মুখ খুলেছে তার ঠিকানা গুম বা কারাগার। হেনস্তা করা হয়েছে। বিরোধীদলকে দমনপীড়নে পিষ্ট করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা তৈরিকরণ। 

এসব দেখে কোমলমতি ছাত্ররা সজাগ হয়েছেন। আজ যারা ছাত্রদের দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, উদ্যোক্তা, তারাও একসময় আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগেরই ছিলেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যে যে মানুষত্ববোধ, দেশপ্রেম সেটাতে তারা সেগুলো মেনে নিতে পারেনি, যেটা তাদের দল করেছে। এতেই তারা ভিন্নমত প্রকাশে প্ল্যাটফর্ম খুঁজেছে। না! বিএনপি বা অন্য কোনো দলে যায়নি। নিজেরাই রাজনৈতিক কালার এড়িয়ে নতুন প্ল্যাটফর্মে সব ছাত্রকে এক করে ছাত্র-জনতা একীভূত হয়ে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারকে বিদায় করেছে। 

তাহলে নতুন দল কেন? 

ছাত্ররা যেহেতু নির্দলীয় ব্যানারে আন্দোলন করে রক্ত দিয়ে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে। ফলে তারা আর রাজনৈতিক কোনো ব্যাজ ধারণ করতে চায় না। তাই তারা যে অসাধ্য সাধন করেছে, যে লক্ষ্যে তার পূরণে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া অ্যাভিউনিউতে ঘোষণার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। নাম যা-ই হোক না কেন ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের প্রতি দেশের একটা বড় অংশের সাপোর্ট ইতিমধ্যে লক্ষ করা গেছে। তরুণ, ছাত্রসমাজই পারে দেশটাকে একটা সুন্দও প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করতে। যেখানে আসবে না আর কোনো স্বৈরাচার, লুটপাটকারী, গুম, খুন করা প্রশাসন, যদি তারা নীতিভ্রষ্ট না হন। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাও এখানেই। ছাত্র আন্দোলনে যেসব কোমলমতি তরুণ ছাত্রদের আটকে রাখতে পারেনি তাদের বাবা-মা। বাধ্য হয়ে ছাত্রদের নিয়ে তাদের নাশতা, পানি নিয়ে বাবা-মা পেছনে পেছনে নেমে পড়েন তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে, তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে, ঠেলে দিয়েছেন গুলির বিপক্ষে দাঁড়াতে। সেসব মা-বাবা ছেলের মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে দেশের মানুষের মুক্তিটাকে সন্তানের কোরবানি দেওয়াটা শ্রেয় মনে করে এ সফলতা ছিনিয়ে এনেছেন। তাদের সন্তানরা যদি রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের মুক্তির জন্য লড়াইয়ে নামে- তাদের বাধা দেবেন? তাই তো অগণিত সাপোর্ট ছাত্রদের প্রতি। 

রাজনীতির মাঠেও প্রয়োজন নতুন দল 

যোগ্য সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ছাত্রদের। এশিয়ার প্রাচীনতম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্ণধার শেখ হাসিনা দীর্ঘ ১৬ বছর এক টানা শাসন করে গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শুধু একাই নন। সদলবলে পালিয়ে গেছেন তিনি। অবশিষ্ট যে নেতা রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-তরুণ হত্যার শত শত অভিযোগ পাশাপাশি অনেকে কারাগারে। যারা অবশিষ্ট, তারা আর রাজনীতির মাঠে নেই। মোটকথা, শেখ হাসিনার অবর্তমানে দলটির হাল ধরবে কে? এটা বড় প্রশ্ন। কার ওপর আস্থা রাখবে কোটি কোটি আওয়ামী লীগের তৃণমূলের মানুষ এ দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুই শতাধিক হত্যা মামলাসহ আরো অভিযোগ। ফলে তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার অর্থ তাকেও কারাগারে সাজা ভোগ করতে হবে। বড় কথা তার বয়স। এ বয়সে আবারও যদি কারাগারে অন্তত ১০ বছরও থাকতে হয়, এরপর তার শারীরিক যে অবস্থা হবে, সেটা আর রাজনীতি করার মতো থাকবে না। এটাই এখন বড় দুশ্চিন্তা। তার চেয়ে দেশে না ফেরাই তার উত্তম কাজ, এটা সিম্পল বিশ্লেষণ। অন্য হিসেবে না হয় নাই যাওয়া হলো।

শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনীতির সুযোগ পেলেও সেটা কয়েকটা দলে বিভক্ত হওয়ারই চান্স ৯০ শতাংশ। শেখ পরিবারের এমন কেউ এ মুহূর্তে নেই যিনি দলের হাল ধরবেন। সজীব ওয়াজেদ জয় বা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলেরও এ মুহূর্তে দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই। এমনি মুহূর্তে ঢাল তলোয়ার সব থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ অনেকটাই শূন্যস্থানে। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন বিএনপি ফ্রন্টলাইনে, সঙ্গে জামায়াত। জাতীয় পার্টি স্বৈরাচারের দোসর খ্যাতি পেয়ে তারাও আওয়ামী লীগের মতো অবস্থানে। এমতাবস্থায় বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া অন্য কোনো দল নেই ফ্রন্টলাইনে। বিএনপির বিকল্প চিন্তা করলে জামায়াত। কিন্তু জামায়াতের সমস্যা ১৯৭১ সনের ভূমিকা। এখনো দলটি সে সময়ে নিজেদের অবস্থা তুলে ধরে ক্ষমা চায়নি বা ক্ষমা চাওয়া না চাওয়ার ব্যাখ্যাও দেয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহির্বিশ্বের একটা প্রভাব চিরকালই রয়ে গেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেখানে বহির্বিশ্বের প্রেক্ষাপট কখনই একটা ইসলামনির্ভর বা ইসলামি দলকে সাপোর্ট করে না বা অতীতে করেনি। ভবিষ্যতে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে পশ্চিমা বিশ্ব। প্রশ্ন আসতে পারে তারা কেন নাক গলাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। এর সিম্পল উত্তর- বাংলাদেশকে এখনো চলতে হচ্ছে-এসব পশ্চিমা দেশের সহায়তায়। বিভিন্নভাবে যে সাহায্য সহযোগিতা তারা করছে, সেটা বাংলাদেশের চলার পাথেয়। এজন্যই তাদের একটা প্রভাব এ দেশে থাকবেই, যতদিন না চীন, দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানের মতো অর্থনীতি শক্তিশালী না হবে। 

ফলে ওইসব পশ্চিমা দেশ কখনই ইসলামকে সমর্থন করে না। ইসলামি দলের উত্থান তাদের পছন্দ নয়। এখানেই পিছিয়ে জামায়াত। অন্য আরো ইক্যুয়েশন থাকলেও সে বিশ্লেষণ বড়। ফলে জামায়াতের উত্থান বা অন্তত বিরোধীদল হওয়ার ইচ্ছাটাও সাপোর্ট করবে না তারা। তাহলে বিএনপির বিকল্প কে? বিএনপি যে আরেকটা স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে না তার গ্যারান্টি কী। যদিও দলটির সেরকম কোনে ইতিহাসই নেই। তবু কথ্য যে কথা- এমন প্রেক্ষাপটেই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির অবর্তমানে ছাত্রদের এ তরুণ দল। যারা দেশের সম্ভাব্য বিরোধীদল। যারা ভবিষ্যতে বিএনপির বিকল্প। যারাই সংসদ থেকে শুরু করে দেশে বিরোধীদলের ভূমিকায় থেকে বিএনপিকে স্বৈরাচারী হওয়া থেকে পদে পদে বাধা দেবে এবং যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে হাজার হাজার ছাত্রদের প্রাণ বিসর্জন ও রক্তদান সে লক্ষ্য পূরণ।

সর্বশেষ 

ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে অনেকেই মাথা ঘামাচ্ছেন, এজন্যই যে হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে-ফেঁপে উঠবেন। আনুকূল্য পাবেন আগামী রাজনীতিতে, ভোটের রাজনীতিতে ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। বাংলাদেশের মানুষ এমনিতেই যে যা বলুক, ব্যালট পেপার হাতে পেলে হয় ধান নতুবা নৌকার বাইরে চিন্তাও করতে পারে না। ফলে ছাত্ররা চাইলেই যে ভোট পেয়ে ক্ষমতায় চলে যাবে এটা ভাবা ভুল। যদি কারো সঙ্গে সমঝোতা না হয়, ছাত্রদের সিট পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। ফলে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে ছাত্রদের রাজনৈতিক মাঠে থাকা প্রয়োজন। আর ভোট যদি সব দলকে নিয়েও হয়, তবুও ছাত্রদের প্রয়োজন। কারণ ভবিষ্যতের বাংলাদেশে অন্য কেউ একতরফা প্রাধান্য বিস্তার করুক- এটা সাধারণ মানুষও চায় না। আবার আওয়ামী লীগ ফিরুক, সেটাও পছন্দ না। তাহলে বিএনপির জন্য হলেও ছাত্রদের দলের প্রয়োজন এবং তা এক্ষুণি।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)