কারাগারের চার দেওয়ালের মাঝে ধর্মীয় স্বাধীনতা চর্চা করা অনেকের জন্য কঠিন হলেও মিশিগানের জেনেসি কাউন্টি জেল বন্দি মুসলিমদের রমজান পালনের সুযোগ করে দিচ্ছে। এখানকার মুসলিম বন্দিরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখছেন, নামাজ আদায় করছেন এবং ইসলামিক শিক্ষা গ্রহণ করছেন। জেলের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, বন্দিদের জন্য সাহরি ও ইফতারের বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে তারা তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি যথাযথভাবে পালন করতে পারেন। ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ, জুমার নামাজ এবং বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে বন্দিরা মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করছেন।
মিশিগানের জেনেসি কাউন্টি জেলে রমজান পালন শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি বন্দি মুসলিমদের জন্য এক গভীর আধ্যাত্মিক ও মানবিক অভিজ্ঞতা। সাধারণত কারাগারের পরিবেশ হতাশা, ক্লান্তি ও একঘেয়েমিতে পূর্ণ হলেও রমজানের সময় এই জেলে একটি ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা যায়। মানবাধিকার সংগঠন ইনমেট গ্রোথ ন্যাচারালি এন্ড ইন্টেনশনালি থ্রু এডুকেশন ও কিডনি বিশেষজ্ঞ ড. ইয়াসিন হাশিশ এর উদ্যোগে মুসলিম বন্দিরা মিশিগান জেলে মুসলিম বন্দিরা রমজান পালন করছেন। এখানে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী এবং দীর্ঘদিনের মুসলিম বন্দিরা একত্রিত হয়ে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করেন, উপবাস পালন করেন এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের জীবনের নতুন দিক উন্মোচন করেন। ধর্মীয় স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জেনেসি কাউন্টি জেল মুসলিম বন্দিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এখানে বন্দিরা সঠিক সময়ে সাহরি ও ইফতারের জন্য গরম খাবার পান, নামাজ আদায়ের জন্য স্থান বরাদ্দ করা হয়, এবং ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগও থাকে।
প্রথম ডিগ্রি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত শাহান্না থর্নস কারাগারে ইসলাম গ্রহণ করে কখনো ভাবেননি যে, কারাগারে বন্দি অবস্থায় তিনি ধর্মের পথে চলতে পারবেন। তিনি গত ১০ মাস ধরে মিশিগানের ফ্লিন্ট শহরের জেনেসি কাউন্টি জেলে বন্দি রয়েছেন। কিন্তু এই জেলেই, যেখানে সাধারণত হতাশা এবং ক্লেশ দেখা যায়, তিনি ইসলাম ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হন। এখন থর্নস তার প্রথম রমজান পালন করছেন এবং সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস থাকার শৃঙ্খলা এবং নিবেদন গ্রহণ করেছেন। শাহান্না থর্নস বলেন, এখানে ইসলামি শিক্ষকরা অসাধারণ। তাদের শিক্ষা এবং আমার ভেতরে কিছু আধ্যাত্মিক কিছু ছিল, যা আমাকে ধর্মান্তরিত হতে সাহায্য করেছে। রমজান, ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র মাস, একটি সময় যখন মুসলিমরা উপবাস, প্রার্থনা এবং আত্ম-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট আরও কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন। দিনভর খাবার, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক প্রয়োজন থেকে বিরত থাকেন মুসলিমরা এবং সূর্যাস্তের পর ইফতার নামক খাবারের মাধ্যমে উপবাস ভাঙেন। সকালের প্রাক-উপবাস খাবারটিকে বলা হয় সাহরি। এটি আত্মশৃঙ্খলা, আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং নিবেদনের সময়।
বন্দি মুসলিমদের জন্য রমজান পালন করা অনেক চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। যেমনÑ উপযুক্ত ধর্মীয় খাবারের অভাব এবং প্রার্থনার জন্য যথেষ্ট জায়গা না থাকা অন্যতম সাধারণ সমস্যা। তবে জেনেসি কাউন্টি জেল একটি ব্যতিক্রম। এখানে বন্দি মুসলিমদের জন্য রমজান পালন করার সুযোগ এবং সুবিধা প্রদান করা হয়। জেলটি সপ্তাহে তিনদিন ইসলামি ক্লাস আয়োজন করে, যাতে বন্দিরা ধর্মীয় দিকনির্দেশনা এবং কমিউনিটির অনুভূতি লাভ করতে পারে।
ফাস্টিংয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লেগেছে, তবে প্রথম ডিগ্রি হত্যা এবং অপরাধে অস্ত্র ব্যবহার মামলায় অভিযুক্ত থর্নস দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বলেন, এটা মন ও শরীরের ব্যাপার, আমি নিজেকে বলি, আমি এটা পারবো।
শাহান্না থর্নস সহ ১০০-এর বেশি বন্দি এই বছর জেনেসি কাউন্টি জেলে রমজান পালন করছেন, যেখানে মুসলিম বন্দিদের জন্য সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইফতার এবং সাহরির জন্য গরম খাবার সরবরাহ করা হয়, যা সাধারণত অন্যান্য কারাগারে পাওয়া যায় না। বন্দিদের প্রার্থনার জন্য জায়গা দেওয়া হয় এবং প্রতিটি শুক্রবার ধর্মীয় সেবা প্রদান করা হয়।
ক্যাটিনা ইয়ংব্লাড, যিনি তিন বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় আছেন, তিনি কারাগারে ইসলাম গ্রহণ করে রমজান পালন করছেন। এটা আমার প্রথমবার, এবং এটি ভালো অভিজ্ঞতা। ধর্মীয় স্বাধীনতা অনেক কিছু মানে।
শেরিফ ক্রিস সোয়ানসন জানিয়েছেন, তিনি মুসলিম বন্দিদের সেবা দিতে ইসলাম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন। কারাগারে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আশার সূচনা। আমরা রমজানের শুরুতে খুব মনোযোগী থাকি, যাতে তাদের খাবার প্রস্তুত থাকে এবং প্রার্থনার জন্য সময় পাওয়া যায়। অনেক বন্দির জন্য, ধর্ম পালন করা তাদের কারাগারের অভিজ্ঞতায় সান্ত্বনা দেয়।
কিডনি বিশেষজ্ঞ ড. ইয়াসিন হাশিশ, প্রায় ২০ বছর ধরে জেলে ইসলামি সেবা প্রদান করছেন। তিনি বলেন, আমি তাদের আশার আলো দিতে চাই এবং চাপ কমাতে চাই।আমরা ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক বিষয়গুলো আলোচনা করি এবং মুসলিমদের কীভাবে অন্যদের সঙ্গে আচরণ করা উচিত তা শিখাই।
জনেল অ্যালেন-বি, একজন দীর্ঘদিনের বন্দি অধিকার কর্মী এবং ইনমেট গ্রোথ ন্যাচারালি এন্ড ইন্টেনশনালি থ্রু এডুকেশন প্রোগ্রামের কো-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রমজান পালন করছেন এবং জেলকে বন্দিদের সমর্থন করার জন্য সহায়তা প্রদান করছেন। অ্যালেন-বি বলেন, রমজান আমাদের পুনঃসূচনা করার সময়। আমি বিশ্বাস করি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমি করি তাহলো আশার আলো প্রদান করা।
জেনেসি কাউন্টি জেলের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের ধর্মীয় সুবিধাগুলো শুধু সাংবিধানিক অধিকার পূরণের জন্য নয়, বরং মানবিকতার জন্য। এটা সাংবিধানিকভাবে গরম খাবার দেওয়া প্রয়োজন কি না? না, কিন্তু সঠিক কাজ কী? শেরিফ অফিসের ক্যাপ্টেন ডেভিড কেনামার বলেন। এটি হলো পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া এবং এটিকে সমর্থন করা। অন্য অনেক কারাগারে এই ধরনের সুবিধা না থাকলেও জেনেসি কাউন্টি জেল তার বন্দি মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে।
ফ্লিন্টের ১ম ওয়ার্ড কাউন্সিলম্যান লিওন এল-আলামিন, যিনি মিশিগান কারাগারে সাত বছর ছিলেন, তার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ‘ইসলাম আমাকে শান্তি দিয়েছে’, এল-আলামিন বলেন। কিন্তু যখন মুসলিম বন্দিদের সংখ্যা বাড়ল, তখন সুযোগগুলো কমে গেল। এল-আলামিন জানিয়েছেন, তিনি এখন স্বাধীন মানুষ হিসেবে রমজান পালন করছেন এবং তার পরিবারও তার ইসলাম গ্রহণ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে। ‘এটা এখন আমার জন্য অনেক কিছু’, তিনি বলেন।
রমজান শুধু উপবাসের সময় নয়, এটি আত্মবিশ্লেষণ, শৃঙ্খলা এবং আত্মিক উন্নতির সময়। এল-আলামিন বলেন, মুসলিমরা রমজানকে শাস্তি হিসেবে দেখেন না, এটা আত্মবিশ্লেষণ, নবায়ন এবং নতুন করে শুরু করার একটি সুন্দর সময়।
মিশিগানের জেনেসি কাউন্টি জেলে রমজান পালন শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটি বন্দিদের জন্য মানসিক ও আধ্যাত্মিক পুনর্গঠনের এক অনন্য সুযোগ। ধর্মীয় স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এখানে মুসলিম বন্দিদের জন্য সাহরি ও ইফতারের বিশেষ ব্যবস্থা, নামাজের স্থান এবং ইসলামিক শিক্ষার সুযোগ রাখা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা শুধু বন্দিদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয় না, বরং তাদের আত্মশুদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। ইসলাম গ্রহণকারী শাহান্না থর্নসের মতো অনেকেই এই পবিত্র মাসকে জীবনের নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখছেন, যেখানে আত্মসংযম, ধৈর্য ও মানসিক শক্তি অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়।
এটি শুধু বন্দিদের জন্য নয়, বরং সমাজের জন্যও ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা বহন করে। সংশোধনাগারের এমন উদ্যোগ দেখায় যে, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব, এমনকি কঠোর কারাগারের পরিবেশেও। এই উদ্যোগ অপরাধীদের শুধু শাস্তি দেওয়ার বদলে তাদের পুনর্বাসনের পথ তৈরি করে, যা সমাজে পুনরায় সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। রমজান এখানে শুধু উপবাসের সময় নয়, বরং এটি আত্মবিশ্লেষণ, আত্মগঠন এবং নতুন করে শুরু করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে, যা সত্যিকারের ন্যায়বিচারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।