দু’দিন আগেও রাজধানীর রাস্তাজুড়ে প্রচণ্ড যানজট। মানুষ রাস্তায় গাড়ী ঠেলে এগুতেও পারছিল না। কোথাও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। কেউ ইফতার রাস্তায়ই সেরেছেন। গোটা রমজানজুড়েই এমন দৃশ্যে অতিষ্ঠ্য মানুষ। রমজানে পূর্ব নির্ধারিত সাড়ে তিনটায় ছুটি অফিস। তবুও রাস্তায়ই ইফতার সারতে হতো অনেককে। সেই রাস্তায়ই ফিরে এসেছিল অন্যরকম এক ঈদ মিছিল। মুঘল আমলের ঐতিহ্য ধারণ করে ব্যাতিক্রমী এক ঈদ উৎসব। ঈদ মিছিল। যাতে অংশ নিয়েছিল সকল স্তরের নারীপুরুষ। এ যেন অভূতপূর্ণ এক মিলন মেলা। একে অপরকে চেনে না, জানেন না। কিন্তু এমন মিছিলে সবাই যেন ভাই ভাই। এক বাংলাদেশী। ঠিক, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার বিদায় করতে যেভাবে এক কাতারে চলে গিয়েছিল গোটা দেশ।
এ ঈদ ওই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তি ঈদ। একটু ভিন্নতা এ কারণেই। সর্বস্তরে স্বস্তির নিঃশ্বাস। কোথাও কারোর উপরে বাড়তি চাপ নেই। ভেদাভেদ তেমন নেই। নেই প্রভাব খাটানোর কোনো লোকজন। সবাই সমান। আওয়ামী লীগ মুক্ত এক সমাজের ঈদ উৎসব। মুহূর্ত স্বরণীয় করতে রাজধানী ঢাকায় সুলতানী আমলের ন্যায় ঈদ উদযাপনের আয়োজন করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পুরাতন বাণিজ্যমেলা অনুষ্ঠান করার মাঠে। ও সংশ্লিষ্ট রাস্তায়।
এ ছাড়াও জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার জাতীয় ঈদগাহে প্রায় ৩৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেছেন। এতে অংশগ্রহণ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকররমে ঈদের প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (৩১ মার্চ) সকাল ৭টায় প্রথম জামাত শুরু হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদুল ফিতরে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
ঈদ জামাত ঘিরে বায়তুল মোকাররমে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রবেশ গেটগুলোতে বসানো ছিল আর্চওয়ে। দক্ষিণ গেটে বিপুল সংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। এ গেটে দুটি আর্চওয়ে দিয়ে মুসল্লিরা প্রবেশ করেন।
ঐক্যবদ্ধ নতুন বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা প্রধান উপদেষ্টার
জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে নামাজ আদায় শেষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “ঈদ দূরত্ব ঘোচানোর দিন, নৈকট্যের দিন, ভালোবাসার দিন। আজ সেই দিনটা যেন গভীর ভালোবাসার সঙ্গে উদযাপন করতে পারি, সেই বার্তা যেন সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারি। আজ একটা অটুট ঐক্য গড়ে তোলার দিন। আমরা স্থায়ীভাবে এই ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। ঈদের জামাতে এটাই আমাদের কামনা।”
প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘আমাদের এই নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন যেসব বীর সন্তানরা, যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, আমরা তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। যারা আহত হয়েছেন, যারা স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছেন... এ দেশের জন্য নিজেদের স্বাভাবিক জীবন ত্যাগ করতে যারা বাধ্য হয়েছেন, তাদের স্বাভাবিক জীবনের ক্ষমতা দেওয়ার জন্য, রোগমুক্তির জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।”
তিনি আরো বলেন, “আজকের দিনে আমরা প্রার্থনা করি... আমরা যেন একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে সামনে এগিয়ে যেতে পারি। যারা আত্মত্যাগ করেছেন, নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য নিজেদের আত্মাহুতি দিয়েছেন, বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না, তাদের স্মরণে আমরা যেন মোনাজাত করি আল্লাহর কাছে। আমরা অবশ্যই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবই। শত বাধা সত্ত্বেও, যত বাধাই আসুক, আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে এই নতুন বাংলাদেশ গঠন করবই ইনশাল্লাহ।”
আমরা এবার মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছি : মির্জা ফখরুল
জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর প্লাজার অদূরে চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করেছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এবং সহস্রাধিক কর্মী। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এবার আমরা মুক্ত পরিবেশে একটা আনন্দময় পরিবেশে ঈদ উদযাপন করছি।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আজকের এ দিনে আমরা আশা করবো, যে যেই দায়িত্ব নিয়েছেন সেই দায়িত্ব পালনে সবাই সফল হবেন এবং বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের কাছে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করবেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকেও অবশ্যই সেই প্রতিশ্রুতি পালন করবো বলে শপথ নিয়েছি।’
ফখরুল বলেন, ‘একই সঙ্গে বিগত গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে যারা প্রাণ দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন তাদেরও আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছি। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা এ দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, শহিদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছি এবং গণতন্ত্রের জন্য বিগত ১৫ বছর ও জুলাই-আগস্টে যারা শহিদ হয়েছে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছি।’
সুলতানী মুঘল আমলের ঐতিহ্য ধারণ
সুলতানি-মুঘল আমলের ঐতিহ্যকে ধারণ করে রাজধানী ঢাকার রাজপথে অনুষ্ঠিত হলো ঈদ আনন্দ মিছিল। একটু ব্যাতিক্রমধর্মী ঈদ মিছিলে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছে। ছোট শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ, নারীরাও অংশ নেন এতে। এ যেন এক অভূতপূর্ব ঈদ মিলন।
পবিত্র ঈদুল ফিতরকে আরও উৎসবমুখর করতে এই মিছিলের আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি), যেখানে ঢাকার ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এই মিছিল পেয়েছে আরও বর্ণিল রূপ।
ঈদের দিন সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের পুরনো বাণিজ্য মেলার মাঠে ঈদুল ফিতরের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়। যাতে অংশ নেয় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। জামাত শেষে সকাল ৯টায় সেখান থেকেই শুরু হয় বর্ণাঢ্য ঈদ আনন্দ মিছিল।
আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়।
মিছিলে ছিল সুসজ্জিত পাঁচটি শাহী ঘোড়া, ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি, ব্যান্ড পার্টি ও বাদ্যযন্ত্র। এ ছাড়া সুলতানি ও মোগল আমলের ইতিহাসচিত্র সম্বলিত পাপেট শো আয়োজন করা হয়। যা অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বাড়তি আনন্দ যোগ করে। বার্নাঢ্য মিছিল ছিল প্রাণবন্ত। একেকজনের মুখে একেক কথা। কেউ বলেছেন, এ জীবনে এমনটা আর কখনও দেখেনি। খুবই ভাল লাগছে। কেউ বলছে ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশ ও সমাজে মানুষের এমন মিলনমেলায় একাকার। ঈদ খুশির দিন। একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে আপন করে নেয়া মানুষের রীতি। এখানেও সেটা ছিল। এ সময় মিষ্টিমুখ করানো হয়েছে। সেমাই খাওয়ানো হয়েছে। কে কাকে খাওয়াচ্ছেন কেউই চেনেন না, জানেন না। তবে সবাই এক বাংলাদেশের মানুষ। একে অপরের ভাই ভাই। সকল সংকীর্ণতা ভুলে একে অপরের তরে যেন বিলিয়ে দেয়া কিছুক্ষনের জন্য।
মিছিলে অংশ নেওয়া একজনকে বলতে শোনা গেছে, এমন আয়োজনে অংশ নিতে পেরে সত্যিই দারুণ লাগছে। আমাদের পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে এমন আয়োজন বারবার হওয়া উচিত। আব্বুর মুখে এমন ঈদ মিছিলের কথা শুনেছি, কিন্তু নিজে কখনো দেখিনি। আজ নিজে এমন মিছিলে অংশ নিতে পেরে আনন্দিত।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ঢাকার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগুলো ফিরিয়ে আনা। এই ঈদ আনন্দ মিছিল তারই একটি অংশ। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এর আয়োজন করা হবে। এবারে ঢাকা উত্তর সিটির ঈদ আনন্দ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ দুই দিনব্যাপী ঈদ আনন্দমেলা। ঈদের দিন ও এর পরদিন এ মেলা হচ্ছে বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে। মেলায় বিভিন্ন পণ্যের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ২০০টির বেশি স্টল বসেছে। মেলা সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলবে। মেলায় শিশুদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলা থাকবে। খেলাধুলার জন্য রাখা হয়েছে বিভিন্ন খেলার সামগ্রী।