ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি ‘গণহত্যার’ প্রতিবাদে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে লাখো মানুষের ঢল নামে। বিপুলসংখ্যক মানুষের সামনে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এতে গাজাবাসীর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিসহ বেশ কিছু ঘোষণা এসেছে। ঘোষণাপত্রে ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের চুক্তি বাতিল ও সম্পর্ক ছিন্নের আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি চারটি স্তরে আলাদা দাবি ও অঙ্গীকার তুলে ধরা হয়।
‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম ঘোষিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, ওইদিন বিকালের প্রোগ্রামে সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হতে থাকে মানুষ। ঢাকার বিভিন্নপ্রান্ত থেকে মিছিলে আসতে থাকেন মানুষ। যেখানে ছিল না রাজনৈতিক কোনো ভেদাভেদ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনে যেভাবে মানুষ সবাই মিশে একাকার। ঠিক এদিনেও মুহূর্তে সব ভুলে ভ্রাতৃপ্রতিম গাজার মানুষদের পাশে দাঁড়াতে এক হয়ে যান। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয় ওই এলাকা। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
ফিলিস্তিনের পতাকা ও গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে নানা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে অনেককেই এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়। এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুনে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি ‘গণহত্যা’ বন্ধ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কট, আমেরিকা ও ভারতকে বয়কটেরও আহ্বান জানাতে দেখা যায় অনেককে।
কর্মসূচি মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, হেফাজতে ইসলামের নেতাসহ কয়েকজন ইসলামি বক্তা এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব। কর্মসূচিতে অংশ নেয়া স্বতঃস্ফুর্ত মানুষ জানাচ্ছিলেন যে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবি এবং মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতেই এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন তারা। এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা। ইসরায়েলবিরোধী স্লোগান দিতে ও প্রতিবাদী নানা ধরনের ফেস্টুন বহন করতেও দেখা যায় অসংখ্য মানুষকে।
ঘোষণাপত্রের দাবি ও অঙ্গীকার
ঘোষণায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশ্বের মুসলিম নেতা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আলাদা আলাদা দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে ইসরায়েলি পণ্য বয়কটসহ বেশ কিছু অঙ্গীকার করা হয়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ইসরায়েলি ‘গণহত্যার’ বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করা, হত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ, ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করা, পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া এবং ফিলিস্তিনদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্তের দাবি জানানো হয়।
মুসলিম নেতাদের প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করা, বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা; গাজার জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা করা; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে একঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করার আহ্বান জানানো হয়। ভারতে মুসলিমদের ‘অধিকার হরণ’, বিশেষ করে ওয়াকফ আইনে হস্তক্ষেপের মতো বিষয়ে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নেয়ার দাবি জানানো হয় ঘোষণাপত্রে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘একসেপ্ট ইসরায়েল’ শর্ত পুনর্বহাল, ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরো সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা, ইসরায়েলি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে তা বাতিল করা, রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া, সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে ‘জায়নবাদী কোম্পানির’ পণ্য বর্জনের নির্দেশনা প্রদান, পাঠ্যবই ও শিক্ষা নীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন ও মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়। পরে দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় মার্চ ফর গাজা কর্মসূচি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মার্চ ফর গাজার খবর
এদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির খবর দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। এসব প্রতিবেদনে বিক্ষোভ কর্মসূচির বিভিন্ন দিক গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। গাজায় প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিশ্বের দেশে দেশে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে রাজপথে নামছেন ইয়েমেন, পাকিস্তান, লিবিয়ার বাসিন্দারা।
ঢাকার এই ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি নিয়ে দেশের গণমাধ্যমের পাশাপাশি প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি), ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য ইনডিপেনডেন্ট ও আরব নিউজের মতো বেশ কিছু বিদেশি সংবাদমাধ্যমও।
এপি
বার্তা সংস্থা এপির ‘বাংলাদেশের রাজধানীতে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে প্রায় এক লাখ মানুষ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানাতে বাংলাদেশের রাজধানীতে বিক্ষোভ র্যালি করেছেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় ১ লাখ বিক্ষোভকারী জড়ো হয়। শত শত ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে তারা ‘ফ্রি ফ্রি ফিলিস্তিন’ সেøাগান দেন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিক্ষোভকারীদের অনেকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পাশাপাশি ইসরায়েলকে সহায়তার অভিযোগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবিতে আঘাত করে।
র্যালিতে তারা প্রতীকী কফিন এবং হতাহত বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের প্রতীকী লাশ নিয়ে আসেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং ইসলামপন্থী দলগুলো এই সমাবেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বলেও উল্লেখ করা হয়।
আরব নিউজ
আরব নিউজের খবরে দাবি করা হয়েছে, ঢাকার সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। এটাকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ফিলিস্তিনের পক্ষে সবচেয়ে বড় সংহতি সমাবেশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলেছে, সমাবেশে প্রায় এক লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন। এতে বিএনপিসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর সমর্থনের কথা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট
মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজধানীতে লাখো মানুষ ইসরায়েলবিরোধী সমাবেশে অংশ নিয়েছে এবং গাজায় ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
কানাডার সিটিভি নিউজেও একই কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের ফিলিস্তিনপন্থী সমাবেশের খবর প্রকাশ হয়েছে টাইমস অব ইসরায়েলেও।
টাইমস অব ইসরায়েল
সেখানে লেখা হয়, ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদার ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ‘মার্চ ফর গাজা’ শিরোনামে এক বিশাল কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার আয়োজিত এই কর্মসূচিতে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে। ‘এপি’র বরাত দিয়ে ইহুদিবাদী সংবাদমাধ্যমটি তাদের প্রতিবেদনে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ছবিতে পেটানোর বিষয়টি মূল শিরোনামে উল্লেখ করেছে। যদিও এপির শিরোনামে এই বিষয়টি রাখা হয়নি। এপি শিরোনাম করেছে, ‘বাংলাদেশের রাজধানীতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রায় এক লাখ মানুষের র্যালি।’ অন্যদিকে টাইমস অব ইসরায়েল একই খবরের শিরোনামে লিখেছে, ‘বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষের গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, পিটিয়েছে নেতানিয়াহু ও মিত্রদের ছবি।’
প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, গাজায় হামলার নিন্দা জানাতে বাংলাদেশের রাজধানীতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী র্যালি করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সোহরাওয়ার্দী পার্কে প্রায় এক লাখ বিক্ষোভকারী জড়ো হয়েছিল। তাদের সঙ্গে ছিল শত শত ফিলিস্তিনি পতাকা। সেখানে তারা ‘ফ্রি ফ্রি ফিলিস্তিন’ ইত্যাদি বিভিন্ন স্লোগান দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের অনেকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবিতে পিটিয়েছেন। র্যালিতে তারা প্রতীকী কফিন এবং হতাহত বেসামরিক মানুষের প্রতীকী কুশপুত্তলিকা নিয়ে এসেছিলেন। প্রতিবেদনের শেষের দিকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের একটি মুসলিম প্রধান দেশ। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ সরকারিভাবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থন করে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আলজাজিরা
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরায় ঢাকার ‘মার্চ ফর গাজা’র তিনটি ছবি শেয়ার করা হয়েছে। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ফিলিস্তিনপন্থী লাখো জনতা বাংলাদেশে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।
এতে আরো বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের র্যালিতে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে নানা সেøাগান দিয়েছেন। গাজায় চলমান গণহত্যার নিন্দা ও ফিলিস্তিনবাসীর প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন তারা। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির খবর দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। এসব প্রতিবেদনে বিক্ষোভ কর্মসূচির বিভিন্ন দিক গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়াও বিবিসি যথারীতি বাংলাদেশের অন্যন্য খবরাখবরের সঙ্গে এ ইস্যুও গুরুত্ব দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রচার করে।