জনশ্রুতি পশ্চিমা শক্তি বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র মায়ানমারের সেনাশাসিত সরকারের সঙ্গে যুদ্ধরত আরাকান আর্মিকে আর্থিক এবং সামরিক সহযোগিতার নামে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে সহায়তার কথা বলে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বপ্রান্তে টেকনাফ অঞ্চলে মানবিক করিডোর সৃষ্টি করতে তৎপর। রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের ধুয়া তুলে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে সাথি করে বাংলাদেশকে মানবিক করিডোর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করছে। শুনলাম, বাংলাদেশ নাকে শর্তসাপেক্ষে করিডোর সুবিধা প্রদানে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। সবাই জানে বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং এর সঙ্গে চীন, ভারত, ময়মনমার, বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জড়িত আছে। বিশেষত দুই পরাশক্তির বৈষয়িক দ্বন্দ্বের ক্রীড়াক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কেন শান্তির দেশ বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নেবে?
এই ধরনের আন্তর্জাতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো অধিকার অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। বিষয়টির ন্যায্যতা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বার্থে অবিলম্বে একতাবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ অপরিহার্য মনে করি। বাংলাদেশের মনে রাখতে হবে কোনো কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশটি যেন ভূরাজনীতির ক্রীড়াভূমিতে পরিণত না হয়। চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। মায়ানমারে বিবদমান এবং যুদ্ধরত একটি পক্ষকে সরাসরি সহায়তা করলে বাংলাদেশ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশে বিষফোঁড়ার মতো। কোনো হঠকারি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের এই সমস্যা আরো ঘনীভূত হলে তার মাসুল দিতে হবে। জাতীয় সংকট সৃষ্টি করার কোনো অধিকার অনির্বাচিত সরকারের নেই। ড. ইউনূসের মতো বিজ্ঞ মানুষ নিঃসন্দেহে বিষয়টি অনুধাবন করেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠাতে জাতিসংঘ যে প্রস্তাব দিয়েছে, সরকার তাতে নীতিগতভাবে সম্মত আছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত ২৭ এপ্রিল ঢাকায় সরকারের এ ভাবনার কথা জানান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এটি একটি মানবিক প্যাসেজ হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি আছে।...যদি শর্তাবলি পালিত হয়, তবে অবশ্যই আমরা সহায়তা করব।’ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অবশ্য ‘মানবিক প্যাসেজের’ শর্তাবলি প্রকাশ করেননি। তিনি বলেন, মিয়ানমারের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে যা কিছু করা প্রয়োজন, সেটা করতে হবে।
রাখাইনের অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পুরো সীমান্তে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একটি ‘নন স্টেট অ্যাক্টের নিয়ন্ত্রণে’ রয়েছে পুরো সীমান্ত। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ নিজেদের স্বার্থে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করতে পারছে না। উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ চাইলেও বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে না। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের মুখে দেশটির রাখাইনের মুসলমানপ্রধান রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ১০ লক্ষাধিক মানুষ ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
রাখাইনে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে খাদ্যাভাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার সংকট দেখা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ বাংলাদেশের কাছে ‘মানবিক প্যাসেজ’ চায়। বিশ্ব সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গত মার্চে ঢাকা ও কক্সবাজারে সফরের সময় বাংলাদেশকে এ বিষয়ে অনুরোধ জানান। রাখাইন ও আশপাশের এলাকার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রামরত ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) অস্ত্রধারী শাখা উইং আরাকান আর্মি ওই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে গত বছর (২০২৪) ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। রাজধানী সিটোয়ে ও বন্দরনগরী চকপু ছাড়া রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে প্রায় সমগ্র রাখাইন অঞ্চলে চাষাবাদ বিঘ্নিত হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিদেশি মিশনগুলো ও বিভিন্ন সহায়তা সংস্থা বছরখানেক আগেই রাখাইন থেকে নিজেদের কার্যক্রম খুব সীমিত করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক রেডক্রস ছাড়া অন্যদের তৎপরতা নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় সেখানে খাদ্যাভাব প্রকট আকার ধারণ করছে। অসুস্থ মানুষের জন্য চিকিৎসা সুবিধা খুব সীমিত হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে গত এক বছরে সীমান্তে বাংলাদেশের সতর্কতার মধ্যেও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে।
কূটনীতিকরা বলছেন, রাখাইনে ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশ ও সাহায্য সংস্থাগুলো মনে করছে, রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ায় সেখানে ‘ত্রাণ ও মানবিক কার্যক্রম’ চালানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভারতসংলগ্ন সীমান্ত তুলনামূলকভাবে দুর্গম হওয়ায় রাখাইনে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে স্থল ও নৌপথে বিশেষ ব্যবস্থায় মানবিক সহায়তার পণ্য পৌঁছানো সহজ হতে পারে, এমনটা মনে করছে এসব সংস্থা।