বিশ্ব এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতির স্পর্শকাতর সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস হতাশ হয়ে পদত্যাগের কথা ভাবছেন। বিষয়টি এখন বাংলাদেশ মিডিয়ার সবচেয়ে গরম খবর। বিরোধীদল এবং নানা গোষ্ঠীর পরস্পরমুখী সংঘাতমূলক অবস্থানের কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উষ্ণ। গোষ্ঠীস্বার্থের দ্বন্দ্বে জুলাই আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রধান স্টেক হোলডারদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সংঘাত। বিশেষত শেখ হাসিনা সরকার পতনের প্রধানতম চালিকা শক্তি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোরতর মতবিরোধ এখন তুঙ্গে।
এমন অবস্থায় সত্যি যদি প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগে করেন তাহলে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হবে দেশের শাসনব্যবস্থা। সবাই জানে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া কোনো উপদেষ্টার জনগণের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। আন্তর্জাতিক মহলেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী নয়। বর্তমান অবস্থা থেকে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি অনেক দুরূহ হবে। দেশে বিদ্যমান অস্থির পরিবেশে দেশবিরোধী শক্তির অবাধ বিচরণ স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে নাজুক করে ফেলবে। পরিণতি কারো জন্য শুভ হবে না।
জুলাই আগস্ট ২০২৪ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে এখন অনেক কিছুই অগোছালো। শান্তি শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিপর্যস্ত। জুলাই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত দায়ী, দোষী পক্ষ এবং নেপথ্যে গোষ্ঠীদের আইনের আওতায় এনে নিরপেক্ষ বিচার অনুষ্ঠানের যোগ্যতা নেই বর্তমান সরকারের। একই সঙ্গে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মব জাস্টিস, ধ্বংসযজ্ঞ, স্বৈরাচারী পন্থায় বিরোধী মতামত দমন বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। সেনাবাহিনী দীর্ঘসময়ে রাজপথে থেকেও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। সরকারের প্রধান দায়িত্ব সর্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচন।
সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারায় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের পথ নকশা ঘোষণার দাবিতে রাজপথে। মব জাস্টিস প্রথায় পরিণত হওয়ায় প্রতিদিন রাজপথে ঘেরাও আন্দোলন জনজীবন বিপন্ন করে তুলছে। শিক্ষাঙ্গন অস্থির, লেখাপড়ার পরিবেশ নেই। সরকারি কর্মকান্ড চলছে ভীতিপ্রদ অনিশ্চয়তায়। কোথায় সংস্কার? কোথায় পরিবর্তন?
সাজানো মব জাস্টিস করে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করা হলো। শুরু থেকেই চিহ্নিত সন্ত্রাসী মহলের কর্মকাণ্ড বিষয়ে সরকার নিস্পৃহ থাকায় পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সরকারের মতবিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। সরকার থেকে সেনাবাহানী এবং বিএনপি সমর্থন প্রত্যাহার করলে সরকার কিছুতেই টিকবে না। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কিছু বিতর্কিত উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি উঠছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের অশুভ প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান।
সরকার নিজেদের ক্ষমতা এবং দায়িত্বের অতিরিক্ত নানা কাজের উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের বিতর্কিত করে ফেলেছে। সংবিধান পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা, দেশের ভেতর দিয়ে ভিন্ন দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থাকে করিডোর দেওয়া বা দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানি নিয়োগ কোনোভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে আসে না। অভিযোগ উঠেছে অনেক উপদেষ্টার দৈত নাগরিকত্ব নিয়ে। সংবিধান অনুযায়ী, একটি আইনি মতামতের ভিত্তিতে ক্ষমতায় থাকা সরকার শুধু রুটিন কাজ করার কথা। কিন্তু সরকার অনেক কাজ করেছে যা তাদের রুটিন কাজের আওতায় পরে না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই বলেছেন তিনি রাজনীতি বোঝেন না। এবার সরকারপ্রধান হয়ে নিশ্চয় উপলব্ধি করছেন বাংলাদেশের মতো সমস্যাসংকুল দেশকে সামাল দেওয়া অরাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য প্রায় অসম্ভব। তবে দেশ এখন যে পরিস্থিতিতে সেখানে প্রধান উপদেষ্টার উচিত হবে সব দল এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনায় বসে দ্রুত নির্বাচনের পরিস্থিতি সৃষ্টি। মনে রাখতে হবে বৈষম্যবিরোধী সেøাগান দিয়ে ক্ষমতায় এসে নিজেদের কর্মকাণ্ডে বৈষম্য উসকে দিয়ে সমাজ জীবনে বিভেদ সৃষ্টি করে সরকার-ঘনিষ্ঠ মহল নিরাপদ পরিত্রাণ পাবে না।
আমি সব রাজনৈতিক দল, সুধীজনদের অনুরোধ করবো দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একতাবদ্ধ হয়ে দেশে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারকে সহায়তা করা। সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একটি পেশাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের দীর্ঘ সময় ব্যারাকের বাইরে রেখে বিতর্কিত করা সমীচীন নয়। সেনাবাহিনীর উচিত রাজনীতি থেকে দূরে থাকা। আমি নোবেল লোরিয়েটকে অনুরোধ করছি দেশকে সংকটে রেখে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত না নেওয়ার।