ড. ইউনূসের নির্বাচনের ঘোষণা বিভাজন না অন্য কিছু


সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ , আপডেট করা হয়েছে : 11-06-2025

ড. ইউনূসের নির্বাচনের ঘোষণা বিভাজন না অন্য কিছু

সারাদেশে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। কি হচ্ছে দেশে, কি হতে যাচ্ছে, সামনেই বা কি আছে? সর্বত্রই একই আলোচনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সহজে দিচ্ছেন না। কারো কারো কাছে একটা উদাহরণ তৈরি হয় বা সামনে চলে আছে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের বিষয়টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের আসনে বসার বিষয়টি নিয়ে যেভাবে ইশরাক হোসেন রাজপথেই আছেন তা বিএনপি’র নেতাকর্মীদের চোখে একটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে উতাল-পাতাল করে দেয়ার নানান হুঙ্কারেও ডিসেম্বরের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছেন না কেনো? এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের আওয়াজে রাজনৈতিক অঙ্গন একপ্রকার থমকে যায়। ধরেই নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়তোবা বিএনপি’সহ বিভিন্ন সংগঠনের একের পর এক নানান দাবিতে অস্বস্তিতে পড়েছেন। আর একারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছেন বা দিতে যাচ্ছেন। যদিও এমন নাটকের পেছনে যে কতো কিছু কাজ করেছে- তা হয়তো সময়ে সময়ে প্রকাশ পাবে। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে চারিদিকে একটা কথাই আলোচিত হচ্ছে- তা হলো বিএনপি বেশি বাড়াবাড়ি করলে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্য খেলায় মেতে উঠবেন পশ্চিমাদের সহায়তায়। তিনি হয়তোবা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ সহসা ঘোষণা করবেন না।

চারিদিকে যখন এমন সন্দেহ অবিশ্বাস দানা বেধে উঠছে, তখনই শোনা গেলো যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন। বিষয়টি সবাইকে এতোই অবাক করে। তবে ধারণা ছিল তিনি হয়তোবা ঈদ শুভেচ্ছাতেই শান্ত থাকবেন। ঈদের আগে কারো মধ্যে এমন ধারণাই আসেনি যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি সময় নির্ধারণ করবেন। কিন্তু অবশেষে জাতীয় উদ্দেশে দেয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে চলে এলো যে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন। 

অস্থিরতা থেমে নেই

কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে মাধ্যমে এমন ঘোষণাতে রাজনীতিতে অস্থিরতা থেমে যায়নি। জল্পনা-কল্পনা আরও ডানা মেলে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল যারা আগামী ক্ষমতায় বসেই যাবেন এমন স্বপ্নে বিভোর তারা হয়তবা বিষয়টির আচ করতে পেরেছে। আর একারণে দলটির একেক নেতা একেকভাবে জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন লং জার্নিতে মোটেই সায় দেয়নি। এখনো তারা দাবি করছে ডিসেম্বরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর পাশাপাশি এপ্রিলে নির্বাচনকে টেনে নিয়ে যাওয়াকে রহস্যজনক বলে ধারণা করছেন। 

এখন দেখা যা কে কি বললেন

নির্বাচনের সময় নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণার পর বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এতে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করেছে বিএনপি। 

এদিকে থাইল্যান্ডে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন করা সম্ভব, সেটাই জাতির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হবে।

অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ একটু ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা বিবেচনায় জাতীয় নির্বাচনের জন্য এপ্রিল মাস উপযুক্ত নয়। কারণ, এই মাসে পাবলিক পরীক্ষা, আবহাওয়া, রমজান। সব মিলিয়ে ওই সময়ে নির্বাচন করলে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি হবে না।’ তিনি বলেন, বিএনপি চায়, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন ডিসেম্বরের আগেই অনুষ্ঠিত হোক। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘কাদের জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কাদের জন্য এ সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে? এতে লাভবান কারা হচ্ছে? তাহলে আগামী নির্বাচনও কি যারা আছে, তারা প্রভাবিত করে তাদের দিকে নিয়ে যাবে বা তাদের মতো করে নির্বাচন করবে? প্রশ্নগুলো উঠে আসছে।’

বিএনপি ছাড়া বাকিরা যা বললো

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের সাত নেতারা যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। উল্টো এতে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার অভিলাষ ফুটে উঠেছে।’ অন্যদিকে নির্বাচনের তারিখ পুনর্বিবেচনা করে ডিসেম্বর ২০২৫ এর মধ্যেই ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। দলটি বলেছে, অধিকাংশ দলের মতামত উপেক্ষা করে একটি দলকে সন্তুষ্ট করতে এপ্রিলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

অন্যদিকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের প্রতিফলন ছিল বলে মনে করে গণসংহতি আন্দোলন। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে দলটি। 

এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আর এ ঘোষণার ফলে ‘একটা বড় টেনশন দূর হলো’ বলে মনে করছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।

আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)’র চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক ব‍্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এক বিবৃতিতে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বিচার, সংস্কার, নির্বাচন এবং সরকারের গৃহীত কার্যক্রম নিয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন তা আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনেছি। বেশ কিছুদিন ধরে আমরা সরকারের কাছে এ সকল বিষয়ে সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রদানের আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। আজ তার প্রতিফলন ঘটায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন‍্যবাদ জানাই।

নির্বাচনের সময় ঘোষণা করায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। প্রধান উপদেষ্টা আজকে এপ্রিল, ২৬’র প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করে সেই অস্থিরতা প্রশমিত করায় তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। 

২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। 

জামায়াতের সন্তুষ্টি ও এনসিপির শর্ত

এদিকে আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন জাতীয় নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান গণমাধ্যমে এক বিবৃতি পাঠিয়ে এই সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে নির্বাচনের দামামা বেজে না উঠার আগেই বলে বসেছেন, ‘আমরা খুব ভালো একটা নির্বাচন চাই। আমরা আশা করব, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা কেউ করবেন না।

এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র পক্ষ থেকে বলা হয় যে, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষে এ কথা বলেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। গত মাসে আন্দোলনের মুখে সরকার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার কথা বলেছিল। এই সময়সীমা শেষ হবে ৩০ জুন। এখন সরকারের সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দিকে নজর রাখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ঈদুল আজহার ছুটির পরে এনসিপির রাজনীতিতে জুলাই ঘোষণাপত্র অন্যতম বড় এজেন্ডা হিসেবে থাকবে বলে দলটির নেতারা জানিয়েছেন। সরকার যাতে ঘোষিত সময়ে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে, সে জন্য চাপ তৈরির চেষ্টা করবে এনসিপি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কারের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের দাবিও এনসিপির নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রাধান্য পাবে।

এখন প্রশ্ন অস্থিরতা কমানো না বিভাজন

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটা সময় দিয়েছেন। এনিয়ে পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিএনপিসহ তার সাথে চলা যুগপৎ আন্দোলনের শরিক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দলগুলি মোটামুটি একপথেই আছে। ধরে নেয়া যায় এই অংশের নেতারা মনে করেন যে ডিসেম্বরের পরে নির্বাচনকে নিয়ে যাওয়ার পেছেনে কোনো একটা কিছু আছে। অন্যদিকে দীর্ঘ সতের বছর ধরে প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানো যে-ই আওয়ামী লীগকে ছাত্ররা পদত্যাগে বাধ্য কওে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে তারা কিন্তু এপ্রিলের নির্বাচনের তারিখে শর্ত সাপেক্ষে হলেও সন্তুষ্টি জানিয়েছে। আর এদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিএনপি’র নামের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দলটির একসময়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামী’র। আর এখানেই বিশ্লেষকরা মনে করে সামনে আছে আরও নতুন খেলা..। একারণে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষণায় একটা বিষয় স্পষ্ট উঠেছে। তা হলো রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা সুস্পষ্ট বিভাজন। কেননা রাজনৈতিক অঙ্গনে বিষয়গুলি অনেকের কাছে প্রশ্ন ঠেকেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছেন তা কি সত্যিই না এর পেছনে আরও অন্য খেলা আছে? এটা কি রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও বড়ো বিভাজন সৃষ্টির আলামত? এমন প্রশ্নের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও অনেক সন্দেহের সৃষ্টি করে, যখন রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে (৭ জুন) সকালে ঈদুল আজহার নামাজ শেষে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার আপনাকে ৫ বছর চাই।’


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)