ডিজিটাল ড্রাইভারস লাইসেন্সের মাধ্যমে ভয়ংকর নজরদারির ব্যবস্থা


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 11-06-2025

ডিজিটাল ড্রাইভারস লাইসেন্সের মাধ্যমে ভয়ংকর নজরদারির ব্যবস্থা

যুক্তরাষ্ট্রে ডিজিটাল ড্রাইভারস লাইসেন্স চালুর মাধ্যমে ফেডারেল গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে নাগরিকদের নজরদারির একটি ভয়ংকর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগ নাগরিকদের চলাফেরা, কেনাকাটা এবং অনলাইন কার্যক্রম পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনতে পারে। এতে করে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং নাগরিক অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বহু স্টেটে স্মার্টফোনে সংরক্ষিত ডিজিটাল ড্রাইভারস লাইসেন্স চালুর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অনেকেই একে আধুনিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে দেখলেও এ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ)।

যুক্তরাষ্ট্রে ডিজিটাল ড্রাইভারস লাইসেন্স চালুর মাধ্যমে একটি জাতীয় ডিজিটাল পরিচয়পত্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা নাগরিকদের গোপনীয়তা, অধিকার ও স্বাধীনতার ওপর গভীর হুমকি তৈরি করছে; বিশেষ করে ‘ফোন হোম’ ফিচারের মাধ্যমে এই প্রযুক্তি রাষ্ট্রকে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের একটি অস্বচ্ছ ও অপব্যবহারযোগ্য কাঠামো দিচ্ছে, যা প্রতিরোধে এখনই নীতিগত ও প্রযুক্তিগতভাবে সুরক্ষিত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

গত ৫ জুন ডিজিটাল আইডি ব্যবস্থায় যুক্ত ‘ফোন হোম’ ফিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ৮০টিরও বেশি সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাদের মতে, এই ফিচারের মাধ্যমে নাগরিকরা যখনই তাদের ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স বা অন্যান্য ডিজিটাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করবেন, সে তথ্য সঙ্গে সঙ্গেই সরকারের কাছে পৌঁছে যাবে। এর ফলে ব্যক্তিগত জীবন কার্যত নজরদারির আওতায় চলে যাবে। তারা এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ডিজিটাল আইডির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো এর ‘ফোন হোম’ ক্ষমতা, অর্থাৎ প্রতিবার ব্যবহার হলেই তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থায়। এর ফলে কে, কখন, কোথায় এবং কাকে পরিচয় দিচ্ছেন তা সরকারের পক্ষে রেকর্ড রাখা সম্ভব হবে। অনলাইনে এই প্রযুক্তির বিস্তৃতি ঘটলে নাগরিকদের ব্রাউজিং ইতিহাসও নজরদারির আওতায় চলে আসবে।

এসিএলইউর সিনিয়র পলিসি অ্যানালিস্ট জে স্ট্যানলি বলেন, যখনই কেউ তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করবেন, সরকার যেন সঙ্গে সঙ্গে তা জানতে পারে। এটা এক ভয়ংকর অরওয়েলীয় দুঃস্বপ্ন। তিনি আরো বলেন, ডিজিটাল আইডি প্রযুক্তিতে কাজ করা সবাই একমত যে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। এটি কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক ইস্যু নয়, বরং নাগরিক স্বাধীনতার মৌলিক প্রশ্ন। এখনই সময় রাজ্যগুলোর জেগে ওঠার। এসিএলইউর মতে, এই ডিজিটাল পরিচয়পত্র ব্যবস্থা গোপনীয়তা ও অ্যাক্সেসিবিলিটিতে বড় ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে। ইতোমধ্যে ১৩টি স্টেট ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু করেছে এবং আরো ২১টি স্টেটে আইন পাস হয়েছে বা গবেষণা চলছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ‘ফোন হোম’ সুবিধাসম্পন্ন ডিজিটাল আইডি ব্যবস্থায় সরকার শুধু নাগরিকদের ট্র‍্যাক করতে পারবে না, বরং কারো প্রতি অসন্তোষ থাকলে তাদের আইডি ব্যবহারে বাধাও সৃষ্টি করতে পারবে।

বিশেষজ্ঞরা তাদের বিবৃতিতে বলেন, আমরা কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাই এমন কোনো ডিজিটাল পরিচয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করার, যার মধ্যে ‘ফোন হোম’ ক্ষমতা রয়েছে। গোপনীয়তা ও নিরাপত্তাকে সব সময় অগ্রাধিকার দিতে হবে ইন্টারঅপারেবিলিটি বা সহজ বাস্তবায়নের চেয়ে। এই উদ্বেগজনক প্রবণতার বিরুদ্ধে যারা স্বাক্ষর করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন এসিএলইউ, একাধিক গোপনীয়তা ও নাগরিক অধিকার সংস্থা, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, রাজ্য আইনপ্রণেতা, ডিজিটাল আইডি কোম্পানির সিইও, ক্রিপ্টোগ্রাফি বিশেষজ্ঞসহ অনেকেই। এসিএলইউ বলছে, পরিচয়পত্র কোনো সাধারণ ব্যক্তিগত কার্ড নয়; এটি সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত একটি বাধ্যতামূলক দলিল। ডিজিটাল রূপে পরিচয়পত্র চালু হলে গোপনীয়তা সুরক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকলে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের ও প্রযুক্তি সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে সমাজে বৈষম্য আরো বাড়তে পারে।

এসিএলইউআরও সতর্ক করে বলেছে, ফেস রিকগনিশন এবং ডেটা ব্রোকারদের সঙ্গে সরকারের অংশীদারত্ব ব্যক্তি গোপনীয়তার জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে এদের অংশীদারত্বে নাগরিকদের অজান্তে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যা অব্যাহত থাকলে তা একটি বিপজ্জনক নজরদারি ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে। তবে এসিএলইউ ডিজিটাল আইডির প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি অস্বীকার না করে বলছে, গোপনীয়তা সুরক্ষাকারী প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটিকে নিরাপদ রাখা সম্ভব। এনক্রিপশন, এনোনিমাস ভেরিফিকেশন ও সিংগাল ইউজ আইডি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল আইডি ডিজাইন করলে ব্যবহারকারীর অবস্থান ও কার্যক্রম ট্র‍্যাক করা যাবে না।

এছাড়া এসিএলইউ স্টেট আইনসভাগুলোর জন্য একটি আইনি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে, যেখানে অন্তত ১২টি মূল বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো ডিজিটাল আইডি ব্যবস্থাকে ন্যূনতমভাবে গোপনীয়তা সুরক্ষিত ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে গড়ে তোলা সম্ভব করবে। এর মধ্যে রয়েছে- আইডি ব্যবহারে ট্র‍্যাকিং নিষিদ্ধ করা, ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, ডিজিটাল আইডিকে বাধ্যতামূলক না করা, আইডি দেখানোর অনুরোধ যেন যুক্তিসংগত হয় এবং ফিজিক্যাল আইডির সমান স্বীকৃতি নিশ্চিত করা। গাইডলাইনে আরো বলা হয়েছে, যারা স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহারে সক্ষম নন, তাদের যেন বাদ না দেওয়া হয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এখনো প্রতি ১০ জনে একজন স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না এবং প্রায় ২৪ মিলিয়ন মানুষ উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

এসিএলইউর মতে, ডিজিটাল আইডি শুধুই প্রযুক্তিগত কোনো বিষয় নয়, এটি ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের কাঠামো। তাই এই ব্যবস্থার ডিজাইন ও বাস্তবায়নে সব স্তরের সরকারের উচিত মানবাধিকার, গোপনীয়তা ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে সাবধানতার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া।

সবকিছু বিবেচনায়, ডিজিটাল ড্রাইভারস লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর যতই আধুনিকতার প্রতীক হোক না কেন, এর গঠন ও ব্যবহার যদি গোপনীয়তা রক্ষা ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়া হয়, তবে তা একটি বিপজ্জনক নজরদারি ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে। ‘ফোন হোম’ ফিচারের মতো প্রযুক্তি রাষ্ট্রকে নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে নজরদারি চালানোর সুযোগ তৈরি করে, যা গণতন্ত্র ও মৌলিক স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাই ডিজিটাল আইডি ব্যবস্থার নীতিমালা নির্ধারণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সর্বোপরি, নাগরিক গোপনীয়তা ও ন্যায্যতার প্রশ্নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এখন সময়ের দাবি। প্রযুক্তি যেন স্বাধীনতা হরণ না করে, বরং তাকে সুরক্ষিত করে- এটাই হতে হবে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মূল দৃষ্টিভঙ্গি।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)