পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশ ১৭৭তম


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 25-06-2025

পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশ ১৭৭তম

‘নদী, হাওর, বন, কৃষিজমি ও পাহাড় : পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেন, উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংসকারী সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পগুলোর তালিকা তৈরি করে তা উন্মুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। এএলআরডির উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনারে পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা, আইনি পদক্ষেপ এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন এএলআরডির চেয়ারপারসন ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির। প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন রিভারাইন পিপলের সাধারণ সম্পাদক শেখ রোকন, বিআইআইএসএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. সুফিয়া খানম, বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ এবং বেলার প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বক্তারা পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষায় এবং দখল-দূষণ রোধে গৃহীত কার্যক্রমের মনিটরিংসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

মূল প্রবন্ধে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করে বলা হয়েছিল যে ধলেশ্বরী আর দূষিত হবে না, কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন ধলেশ্বরী আরো ভয়াবহ দূষণের শিকার। এর বিরুদ্ধে সংসদীয় কমিটিতে বারবার প্রস্তাব দেওয়া হলেও সুরক্ষা কার্যক্রম কার্যকর হয়নি। হাওর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাওরের প্রতিবেশগত সংকট নিরসনে প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি।

কৃষিজমির সুরক্ষা নিয়ে তিনি বলেন, কৃষি হচ্ছে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান ভিত্তি, অথচ এই কৃষিজমি অবাধে অধিগ্রহণ করে ইপিজেড, এসইজেড ও তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সঠিকভাবে পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব নিরূপণ করা হয় না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কৃষিজমি দখল করে ইপিজেড, অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং কৃষিজমিতে এসব স্থাপনা বন্ধ করতে হবে।

সুন্দরবনের উপকূলীয় বনাঞ্চল সম্পর্কে তিনি বলেন, সুন্দরবনের আশেপাশে কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে, যা এই প্রাকৃতিক বাফার জোনকে ধ্বংস করছে। তিনি এইসব প্রকল্প বাতিল করে বন রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, নদী, পাহাড়, বন ও হাওরের বিপর্যয় যেন একটি দুষ্টচক্রে পরিণত হয়েছে। একটির ক্ষতি অন্যটির ধ্বংস ডেকে আনে। আমরা বহু বছর ধরে দেখছি যে, নদী কমিশন আছে, আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। নদী কমিশনের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে, এখনই তা নবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়াও, তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন, ব্রহ্মপুত্র নদ রক্ষা, ড্যাম ও ব্যারাজগুলোর যৌক্তিকতা পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি।

বিআইআইএসএসের রিসার্চ ফেলো ড. সুফিয়া খানম বলেন, বাংলাদেশের নদীগুলো ভয়াবহভাবে প্লাস্টিক ও রাসায়নিক দূষণে বিপর্যস্ত। উজানের নদীগুলো প্লাস্টিক বহন করে যা আমাদের ভাটির দেশের অববাহিকা দূষিত করছে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০ নদীর ৮টি এই উপমহাদেশে অবস্থিত বলে উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশের সিমেন্টের কাঁচামাল ফ্লাই অ্যাশ আসে ভারত থেকে। ২০১৯-২০২০ সালে ১৯ কোটি ফ্লাই অ্যাশ ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে নদী পথে। ফ্লাই অ্যাশ বহনকারী জাহাজ সুন্দরবনের পাশ দিয়ে যাতায়াত করে যা ভয়াবহ পরিবেশ ঝুঁকি তৈরি করছে। তিনি ট্রান্সবাউন্ডারি ন্যাচারাল রিসোর্স ব্যবস্থাপনায় ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার ঘাটতি তুলে ধরেন এবং কপ-১৬ ও কপ-২৯ এ জীববৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দাবি করেন।

উল্লেখ করে বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ বলেন, রাষ্ট্রকে উন্নয়ন বনাম পরিবেশ এই বাইনারি থেকে বেরিয়ে এসে ইকো সেন্সিটিভ উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। চা-বাগানে আগাছা নাশকের ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানির বেসরকারি ব্যবহার, ইকোপার্কসহ নানা প্রকল্প পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নদী রক্ষায় আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয় দরকার। বাংলাদেশের জনগণের অনুমোদন ছাড়া পেপসি, কোকাকোলার মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে। এই ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট আইন থাকতে হবে।

বেলার প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম বলেন, আইন ও কমিশন থাকা সত্ত্বেও পরিবেশ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্যে ১৭৭তম। এটা শুধু লজ্জার নয়, ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। আমাদের আইনের অভাব নেই, তবে বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নদী আইন, নদী কমিশন ও পরিবেশ আদালতের ভূমিকা পর্যালোচনার আহ্বান জানান তিনি।

সভাপতির বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস মুনাফালোভী ও অপরিকল্পিত দৃষ্টিভঙ্গির ফল। আমরা যে উন্নয়ন চাই তা যেন ধ্বংস ডেকে না আনে। নদী, হাওর, বন, পাহাড়, কৃষিজমি এগুলোর কোনোটিরই বিকল্প নেই। এগুলোর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, নিরাপত্তা, খাদ্য ও পানির অধিকার জড়িত। তাই পরিবেশ রক্ষায় সব নাগরিককে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হতে হবে এবং প্রকৃতি-নির্ভর সমাধানে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এছাড়াও এ সেমিনারে রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরা জেলা থেকে আগত প্রতিনিধিদের মধ্যে কাশমির রেজা, ড. হালিম দাদ খান, ইবনুল সাঈদ রানা, আফজাল হোসেন, জিয়াউর রহমান, প্রমুখ বক্তব্য রেখেছেন।

অঞ্চলভিত্তিক আলোচনা থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলে অ্যাগ্রো ফার্মিংয়ের ব্যপকতা বৃদ্ধি, টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোটের শব্দদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, চলনবিলের নদীগুলোর উৎসমুখ বন্ধ, ইটভাটার বিস্তার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)