নির্বাচনী জালিয়াতি : দুই বাংলাদেশি-আমেরিকানের কারাদণ্ড


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 25-06-2025

নির্বাচনী জালিয়াতি : দুই বাংলাদেশি-আমেরিকানের কারাদণ্ড

পেনসিলভানিয়ার ছোট্ট শহর মিলবোর্নে ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত একটি সংঘবদ্ধ নির্বাচনী জালিয়াতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বরো কাউন্সিলের দুই প্রভাবশালী বাংলাদেশি-আমেরিকান রাজনীতিক, এমডি নূরুল হাসান (৪৮) ও এমডি রফিকুল ইসলাম (৫২)। নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগে ২০২৫ সালের ১৮ জুন পৃথক শুনানিতে তাদের কারাদণ্ড প্রদান করেন ইউএস ডিস্ট্রিক্ট বিচারক হার্ভি বার্টল। হাসান ও ইসলাম উভয়েই মিলবোর্ন বরো কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন এবং ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে গোপনে ভোটার জালিয়াতির চক্রান্তে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ মামলায় আরেক আসামি, বর্তমান কাউন্সিল সদস্য এমডি মনসুর আলী, ইতোমধ্যে দোষ স্বীকার করেছেন এবং তার সাজা ঘোষণা নির্ধারিত হয়েছে ২৬ জুন। এই মামলায় হাসানকে ৩৬ মাসের কারাদণ্ড, এক বছরের পর্যবেক্ষণমূলক মুক্তি এবং ৩ হাজার ৩০০ ডলার জরিমানা করা হয়েছে। ইসলামকে ১২ মাস একদিনের কারাদণ্ড, এক বছরের পর্যবেক্ষণমূলক মুক্তি ১ হাজার ডলার জরিমানা এবং ৭০০ ডলার স্পেশাল এসেসমেন্ট দিতে হয়েছে।

প্রসিকিউশন থেকে জানানো হয়েছে, ২০২১ সালের নির্বাচনে নূরুল হাসান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক পর্বে পরাজিত হন। পরে তিনি সাধারণ নির্বাচনে রাইট-ইন প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং রফিকুল ইসলাম ও আলী তাকে সমর্থন করেন। এরপর তারা তিনজন মিলে একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত করেন, যার মাধ্যমে বহিরাগতদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে তাদের মিলবোর্নে বাসিন্দা হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এরপর মেইল-ইন ব্যালট চেয়ে নিজেরাই সেই ব্যালট পূরণ করে হাসানের নামে ভোট দেন এবং ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে জমা দেন।

আদালতের নথি অনুযায়ী, নূরুল হাসান এই পুরো পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি নিজের ব্যবসার কম্পিউটার ব্যবহার করে পেনসিলভানিয়ার অনলাইন ভোটার রেজিস্ট্রেশন সাইটে প্রবেশ করেন এবং ব্যক্তিগত ইমেইল ও অন্যান্যদের ইমেইল ব্যবহার করে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করেন। ইসলাম তার ব্যক্তিগত ই-মেইল দুটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে এই প্রতারণায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মনসুর আলী ও নূরুল হাসান বেশ কয়েকজন পরিচিত ও বন্ধুদের বলেছিলেন, তারা যদি অন্য কোনো জায়গায় ভোট না দেন, তবে এই জালিয়াতির কারণে কোনো সমস্যা হবে না।সবমিলিয়ে প্রায় ৩৬ জন অ-মিলবর্ন বাসিন্দাকে মিলবোর্নের ভোটার হিসেবে জালিয়াতির মাধ্যমে নিবন্ধন করে তাদের নাম ব্যবহার করে ভোট দেয়া হয়। এরপরও নূরুল হাসান নির্বাচনে ১৩৮ ভোট পেয়ে হেরে যান, যেখানে বিজয়ী প্রার্থী মাহাবুবুল তৈয়ব পান ১৬৫ ভোট।

সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসা এই ঘটনায় দেখা গেছে, ওই সময়ের মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দুই বাংলাদেশি অভিবাসী মাহবুবুল তায়ুব ও মো. নূরুল হাসান। এর মধ্যে একজন, মোঃ নূরুল হাসান, ভোট চুরি করার জন্য কয়েক ডজন ভুয়া ভোটার নিবন্ধন করে মেইল-ইন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। চট্টগ্রামের বাসিন্দা তায়ুব ও হাসান আমেরিকায় এসে ফিলাডেলফিয়ায় পরিচিত হন এবং পরে মিলবোর্নে বসবাস শুরু করেন। দুজনেই ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে ২০১৫ সালে কাউন্সিলে নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে মেয়রের পদ শূন্য হলে তারা উভয়েই মনোনয়নপত্র জমা দেন। তায়ুব ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে ১৮ ভোটে জয় পান, কিন্তু হাসান রাইট-ইন প্রার্থী হিসেবে সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

হাসান ও তার সহযোগীরা মিলবোর্নের বাইরে বসবাসকারী পরিচিতদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তাঁদের নামে ভুয়া ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করেন। এরপর মেইল-ইন ব্যালট চেয়ে সেই ব্যালটে নিজের নাম লিখে ভোট দেন। এই প্রক্রিয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ব্যবহার করা হয়। আনুমানিক তিন ডজনের বেশি ভুয়া ভোটার এভাবে নিবন্ধিত হয়।

তায়ুব প্রথম এই জালিয়াতির আভাস পান, যখন তিনি ভোটার তালিকায় কিছু অপরিচিত নাম দেখতে পান, যারা মিলবোর্নের বাসিন্দা নন বলে তিনি জানতেন। তিনি তৎকালীন মেয়র টম ক্রেমার ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানান। কিন্তু কয়েক মাস কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না দেখে, তায়ুব ও অন্যরা পরে এফবিআইয়ের সহায়তা চান। অবশেষে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেডারেল অভিযোগ গঠন হয় এবং হাসান আদালতে দোষ স্বীকার করেন।

এই রায় ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি ডেভিড মেটকাফ বলেন, এই অপরাধীরা তাদের নিজ সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে। আমরা নিশ্চিত করব, আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেন অবাধ ও নিরপেক্ষ থাকে। এফবিআই ফিলাডেলফিয়া শাখার স্পেশাল এজেন্ট ইনচার্জ ওয়েইন জ্যাকবস বলেন, নির্বাচনী প্রতারণা শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, এটি জনগণের আস্থার ওপরও আঘাত করে।

এই মামলার তদন্ত করেছে এফবিআই এবং ডেলাওয়্যার কাউন্টি ডিস্ট্রিক্ট ইউএস অ্যাটর্নি অফিস। মামলাটি পরিচালনা করেছেন সহকারী মার্কিন অ্যাটর্নি মার্ক বি. ডুবনফ। এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে, স্থানীয় পর্যায়ে হলেও নির্বাচনী দুর্নীতির চেষ্টা হয়ে থাকে কিন্তু আইন তার পথেই চলে এবং অপরাধীরা বিচারের মুখোমুখি হয়। এই জালিয়াতি যেমন নির্বাচন ব্যবস্থার কার্যকারিতা তুলে ধরে, তেমনি এটি একটি বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বচ্ছতার অভাবের দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে এসেছে। এই ঘটনা ছোট শহরে বাংলাদেশিদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)