মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে গৃহীত ইমিগ্রেশন নীতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সমন্বয় বিলের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর বাজেট ৩০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান আইসের বাজেট এখন কিছু দেশের সশস্ত্র বাহিনীর বাজেটের কাছাকাছি। হাজার হাজার নতুন আইস এজেন্ট নিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যাদের জন্য ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত সাইনিং বোনাস দেওয়া হচ্ছে এবং নিয়োগে আগের বয়সসীমাও তুলে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে এক ভয়াবহ, দমনমূলক এবং বিশাল আকারের ইমিগ্রেশন যন্ত্র তৈরি হচ্ছে, যা ব্যক্তিস্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বর্তমানে প্রতি মাসে আধুনিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রায় ৬০ হাজার অভিবাসীকে আটক করা হচ্ছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক অভিযোগ নেই এবং অনেকেরই বৈধ কাগজপত্র বা যুক্তরাষ্ট্রে থাকার আইনি ভিত্তি রয়েছে। তা সত্ত্বেও তাদের আটক করা হচ্ছে শুধু কঠোরতা প্রদর্শনের জন্য তা যেন আইনের শাসন নয়, বরং ভয় ছড়ানোই প্রশাসনের লক্ষ্য। এসব কার্যক্রম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি সরকারের একটি পরিকল্পিত রূপান্তরের অংশ, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটি নির্বাসন এবং নজরদারি কেন্দ্রে পরিণত করা হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এ নীতিমালায় মার্কিন সংবিধানের বহু মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রথম সংশোধনীর অধীনে থাকা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক মতের কারণে বহু শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে। চতুর্থ সংশোধনীর অধীনে থাকা নিরাপত্তা অধিকার লঙ্ঘন করে গোপনে এবং কখনো কখনো প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পঞ্চম সংশোধনী অনুযায়ী ন্যায়বিচারের অধিকার থাকা সত্ত্বেও শত শত ভেনেজুয়েলান অভিবাসীকে এল সালভাদরের দুর্নাম-কামানো সেকট কারাগারে পাঠানো হয়েছে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে।
অভিযোগ উঠেছে যে প্রশাসন কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই বাজেট ব্যয় করছে, যেমন-শরণার্থী পুনর্বাসন, শিশুদের আইনি সহায়তা ও স্থানীয় সরকারগুলোকে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় না করা। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নরের অনুমতি ছাড়াই জাতীয় গার্ড মোতায়েন করে ফেডারেলিজমের নীতিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এমনকি বিচারপতি, কংগ্রেস সদস্য ও ইমিগ্রেশন অধিকারকর্মীদের লক্ষ্য করে আইনগত হয়রানিও চালানো হয়েছে। বিচার বিভাগ কোনো সীমা আরোপ করলে প্রশাসন তা অস্বীকার করে আদালতের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। এ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এক বৃহৎ, নিষ্ঠুর এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইনপ্রয়োগ ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। সামরিক ঘাঁটি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন কারাগারগুলোতে অভিবাসীদের গাদাগাদি করে রাখা হচ্ছে, যেখানে চিকিৎসার অপ্রতুলতা, নির্যাতন ও অমানবিক পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত চরম আকার ধারণ করছে। সম্প্রতি দেখা গেছে, অফিসাররা পেনস্কি ভ্যান ব্যবহার করে হঠাৎ হানা দিচ্ছেন এমনকি অভিবাসীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে কিন্ডারগার্টেন বা নাগরিকত্ব ইন্টারভিউর স্থান থেকেও।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, এ নীতির মাধ্যমে আসল অপরাধ বা নিরাপত্তার ঝুঁকিকে গুরুত্ব না দিয়ে, অভিবাসী পরিচয়ধারী নিরীহ মানুষদের ওপর দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ কঠোর অবস্থান জনগণের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করছে না; বরং তা কমিয়ে দিচ্ছে। যেমন টেনেসিতে এক পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন, অভিবাসন-ভীতির কারণে একজন শিশুর জীবনহানি ঘটে, কারণ তার অনাগরিক অভিভাবক ৯১১-এ ফোন করতে সাহস পাননি।
এসব কিছু মিলে এক ভয়ানক বার্তা দিচ্ছে, কোনো অভিবাসী নিরাপদ নন তাদের অবস্থা, অবদান কিংবা বৈধতা যাই হোক না কেন। গণগ্রেফতার ও নির্বাসনের এ দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তাকেও বিপন্ন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই সমস্যায় জর্জরিত ছিল রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রক্রিয়া অতিরিক্ত চাপের মুখে ছিল, ভিসা ও গ্রিনকার্ড পাওয়ার পদ্ধতি ছিল ধীরগতির এবং আদালতের মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতায় আটকে ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সমস্যাগুলো সমাধান না করে আরো খারাপ করেছে এবং তা ইচ্ছাকৃতভাবেই।
এখন সময় এসেছে একটি নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার। একটি কার্যকর, মানবিক ও সংবিধানসম্মত ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব-যা প্রকৃত হুমকিকে গুরুত্ব দেবে, দ্রুত ও ন্যায্য আশ্রয় প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে এবং দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অভিবাসীদের জন্য আইনি পথ খুলে দেবে। এটি কম খরচে আরো কার্যকরভাবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মূল মূল্যবোধকে সম্মান জানিয়ে অভিবাসন পরিচালনা করতে পারবে।
সবশেষে এটি শুধু অভিবাসীদের জীবন-মরণ প্রশ্ন নয়, বরং মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত্তি সংবিধান, আইনের শাসন ও ক্ষমতার ভারসাম্যের রক্ষাকবচ এখন ঝুঁকির মুখে। নির্বাহী শাখার সীমাহীন ক্ষমতা এবং আইনি প্রক্রিয়ার অবমূল্যায়ন যদি চলতেই থাকে, তাহলে সেটি পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপরই আঘাত হানবে। আইন দ্বারা পরিচালিত একটি জাতি কখনোই এ ধরনের আইনবহির্ভূত নিষ্ঠুরতাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না।