দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পাটাতন বদলে যাচ্ছে


মঈনুদ্দীন নাসের , আপডেট করা হয়েছে : 20-08-2025

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পাটাতন বদলে যাচ্ছে

দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক পাটাতনে নতুন করে গুটি সাজানো হচ্ছে। গত সপ্তাহে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে তকমা দিয়েছে আমেরিকা। সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানের সাফল্যকে প্রশংসা করে আমেরিকা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পন্ন করেছে এক যৌথ বিবৃতি। গত ১২ আগস্ট ফের এক যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র ৬ পাকিস্তান ইসলামাবাদে সর্বশেষ সন্ত্রাসবিরোধী আলোচনা শেষে যে কোন ধরনের সন্ত্রাস দমনে তাদের যৌথ প্রতিশ্রুতির বিষয়টি নতুন করে নিশ্চিত করা হয়েছে। এ যৌথ প্রতিশ্রুতিতে সাক্ষী রয়েছে। বলা যায় বলতে গেলে জাতিসংঘ ও আমেরিকা উভয়েরই উপস্থিতি ও সঞ্চালনায় এ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের বিশেষ সেক্রেটারি নাবিল মুনীর ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সন্ত্রাস দমনের ভারপ্রাপ্ত কো-অর্ডিনেটর গ্রেগরি ডি লোগার্ফো আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন যৌথভাবে। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের উভয় ডেলিগেশন সন্ত্রাসী হুমকি কার্যকরভাবে নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে গুরুত্বারোপ করেন। আলোচনায় পাকিস্তানে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ), আইসিসে-খোরাসান ও তেহেরিকি-তালেবান পাকিস্তান (টিপিপি)-এর সন্ত্রাসী হুমকিকে দমনের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি বলে বর্ণনা করা হয়।

আমেরিকা সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানের অবিরাম সাফল্যের বিষয়টিকে প্রশংসা করে বলা হয় এ সন্ত্রাস এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছে, যা বিশ্বসন্ত্রাসেও লিপ্ত। একই সঙ্গে আমেরিকা পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ সদস্য, যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে নিহত হয়েছেন, যেমন-জাফায় এক্সপ্রেসে হামলার সন্ত্রাসী কার্যকলাপে নিহতদের এবং খুজদারে স্কুল বাসে বোমা হামলয় নিহতদের প্রতি সান্ত¦না জ্ঞাপন করেন। 

উভয় প্রতিনিধিদল প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করে নিরাপত্তা বিঘ্নকারী সন্ত্রাসী হামলা দমনে সন্ত্রাসের উদ্দেশ্যে উন্নত টেকনোলজির ব্যবহারকে কাউন্টার করার যে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ রয়েছে তার মোকাবলা সামর্থ্য অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। উভয়পক্ষ বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করে। দীর্ঘদিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে যে বোঝাপড়া রয়েছে তা আরো টেকসই করার জন্য সমঝোতা স্মারকে অঙ্গীকার করা হয়।

পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতায় আমেরিকার প্রশংসা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারত যখন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য দায়ী করেছে এমন এক সময পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাস দমনে আমেরিকা ও জাতিসংঘের বোঝাপড়া ভারতের বিশেষ গাত্রদাহের সৃষ্টি করেছে। যখন ভারত পেহেলগাম কাণ্ডের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে তখন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের একযোগে পাকিস্তানের প্রশংসাকরণ বলতে গেলে দক্ষিণ এশিয়াকে আমেরিকার নতুন করে বিবেচনায় নিয়ে ঢেলে সাজানোর মতো। 

এ সমঝোতার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে দিয়েছে ভারতের সঙ্গে ট্যারিফ যুদ্ধ। ভারতের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে ৫০ শতাংশ ট্যারিফ। এতে ভারতের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে ভারত হন্যে হয়ে ঘুরছে। রাশিয়া থেকে ভারত তেল কিনছে অবিরাম আর তাতে রাশিয়া যেমন একদিকে লাভবান হচ্ছে, অন্যদিকে ভারত আমেরিকা থেকে দূরে সরে আসছে। আমেরিকা ভারতকে রাশিয়ার সঙ্গে তেল বাণিজ্যে কোনো বাধা দিচ্ছে না, বরং বিষয়টিকে আমেরিকা একদিকে ভারতকে অবাধ্য রাষ্ট্র হিসেবে যেমন চিহ্নিত করতে পারছে, তেমনি অন্যদিকে রাশিয়াকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে। ট্রাম্প এক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধু বন্ধু খেলার সুযোগ পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমেরিকা ভারতকে চাপে রেখে রাশিয়ার সঙ্গে যাতে ভিড়ে যায় সে ব্যবস্থা করছে। 

এদিকে ভারত কাউন্টার ব্যবস্থা হিসেবে চীনের সঙ্গেও সম্পর্কে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ চীনের সঙ্গে ট্যারিফ সমস্যা আমেরিকা গুটিয়ে নিয়েছে। আর বেইজিংও তা দ্রুত নিষ্পন্ন করেছে। শুধু তাই নয়, চীন এ সময়ে পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছে উন্নতমানের যুদ্ধ বিমান। ভারত চীনের সঙ্গে গিয়েও পাকিস্তানের কাছে পড়েছে গ্যাঁড়াকলে।

এখানে চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কারোর কাছেই মোদির ভারত পাকিস্তানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক বলয় পুনর্গঠনে অত্যন্ত জরুরিভাবে বিবেচ্য। আমেরিকা এদিকে মায়ানমারের সঙ্গেও নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। আর তাতে আমেরিকা যতই না মায়ানমারের কাছাকাছি হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি সে অঞ্চলে তার উপস্থিতির বিষয়টি অন্যদের প্রভাবিত করার জন্য আমেরিকার কাছে প্রয়োজনীয়। এজন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে আমেরিকা চায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, আর চীনের সঙ্গে অহিংস নীতি। 

ভারত যেখানে বলছে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদীরা ঘাঁটি করছে, সেখানে আমেরিকা বলছে পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের দমন করছে। এক্ষেত্রে ভারতের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা আমেরিকার কাছে নেই। একসময় ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে মোদি আমেরিকার শিকাগোতে হিন্দুদের ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। মোদি ছিল তখন ট্রাম্পের বন্ধু আর আজ মোদি ট্রাম্পের বন্ধু নয়, যেন ট্রাম্পের কাছে ধরা এক রাষ্ট্রনায়ক। 

আসলে বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে ভারতের ইন্ধনে সংগঠিত বলে পাকিস্তান মনে করে। আর এখন পাকিস্তানের সমর্থনে আমেরিকায় বয়ান বিষয়টিকে আরো স্পর্শ করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের কারোরই সঙ্গে ভারতের কোনো সুসম্পর্ক নেই। ভারত বস্তুত আমেরিকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বিরোধে। ট্রাম্প দাবি করে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ বন্দের পেছনে তার দূতিয়ালি। কিন্তু ভারত তা মানে না। মোদি মনে করে বিষয়টি ঠিক নয়। অন্যদিকে পাকিস্তান বলে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। পাকিস্তান ট্রাম্পের জন্য নোবেল পুরস্কারের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। আমেরিকা বেলুচি লিবারেশন আর্মিকে বিদেশি জঙ্গি সংগঠন যেমন মনে করে, তেমনি মনে করে তা ভারতের মদতপুষ্ট। এছাড়া বিএলএর সহযোগী মজিদ ব্রিগেডকেও জঙ্গিগোষ্ঠী হিেেসব তালিকাভুক্ত করেছে মার্কিন প্রশাসন। এ পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রশাসন সরাসরি পাকিস্তানের সুরক্ষার হস্তক্ষেপ করছে।

ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে বরাবর ‘ইন্দো-মার্কিন এক্সিস’ এবং ‘ইন্দো-রাশিয়া এক্সিস’ এই দুই অক্ষপথের উপস্থিতি রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আর এখন ইন্দো-মার্কিন এক্সিস ভারতের হয়ে যত না সক্রিয়, তার চেয়ে বেশি সক্রিয় আমেরিকার হয়ে। এ কারণে চলছে নতুন সমীকরণ।

বাংলাদেশ ফ্যাক্টর

দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিতে বাংলাদেশ নতুন করে ভারতের জন্য ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চলছে সংকট। তবে এ সংকট ভারতের জন্য কোনোভাবেই শান্তির নয়। এ সংকট আসলে বাংলাদেশের ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার থেকেই সৃষ্ট। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ বুঝতে পেরেছে ভারত থেকে মুক্তি জরুরি। হাসিনার পতন যেন মোদির কাছে ইলিশ মাছের ঘ্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো। কাজেই মোদি বলছে বিদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। আসলে কি তাই। বস্তুত বিষয়টি হচ্ছে, যেখানে ভারতের লোক বাংলাদেশে অবাধে চাকরি পেতো। আজ তা চলে গেছে। এজন্য বিষয়টিকে বিপরীতভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের আগামী সরকার একে বিবেচনায় নিয়ে গঠিত না হলে তা বাংলাদেশের জন্য বুমেরাং হবে। 


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)