ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে সময় কাটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের বিপুল দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলো না। সরকার গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল বিগত সরকারের ১৫ বছরে সম্পাদিত জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন কাজে আনুমানিক ১০ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে। একই প্রতিবেদনে বিস্তারিত অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ ছিল। জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের উপদেষ্টা অসহায়ভাবে স্বীকারোক্তি দিলেন আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কেউ দুর্নীতির অবসান চায় না। তাই অন্যান্য সব সেক্টরের মতো জ্বালানি সেক্টরের ব্যাপক দুর্নীতির কোনো অনুসন্ধান হলো না।
ধরি মাছ না ছুঁই পানি করেই সময় কাটিয়ে দিলো অন্তর্বর্তী সরকার। পূর্ববর্তী সরকারের মতোই জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে আমলাদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকায় দুর্নীতিবাজরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল। পেট্রোবাংলা, বিপিডিবি, বিপিসি, তিতাস গ্যাস, বাপেক্সের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অশুভ মাফিয়া সিন্ডিকেটগুলোর দাপট অব্যাহত থাকায় জ্বালানি সংকট গভীর থেকে গভীর হয়ে এখন মহামারিতে রূপ নিয়েছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আবহাওয়া অনুকূল থাকায় বিদ্যুৎ সংকট ততটা তীব্রভাবে অনুভূত হয়নি। কিন্তু জ্বালানি বিদ্যুৎ মহাসংকটে বন্ধ হয়ে গাছে অনেক ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। অনেক রফতানিমুখী বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধুঁকছে। বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে পড়েছে।
বিগত সরকারের আমলে দ্রুত জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইনের ২০১৪ আওতায় বিপুল দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা হয়েছে। কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়াই দুর্নীতি করে মাফিয়া গোষ্ঠীকে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত করে আর্থিকভাবে লাভবান করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ আর্থিক গচ্চা দিতে হয়েছে বিপিসি, পেট্রোবাংলা এবং বিপিডিবির কোম্পানিগুলোকে। আর্থিক দায় দেনায় প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছে সরকারি মালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারকে দিতে হয়েছে বিপুল পরিমাণ সাবসিডি। অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য হল প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুল দায় দেনার অধিকাংশ পরিশোধ করা। এর বাইরে সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গতিময় করার কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। দেশের জ্বালানি সম্পদ আহরণ, উন্নয়ন, বিপণন ব্যবহারে ব্যাপক দুর্নীতির অবসানে কোনো কার্যকরি ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। কিছু কিছু কোম্পানিতে বর্তমান আমলাদের সরিয়ে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের পরিচালনা পরিষদে দায়িত্ব দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর ব্যবস্থাপনায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসা ভবিষ্যৎ সরকারকে জ্বালানি সেক্টর নিয়ে ঘোরতর সমস্যায় পড়তে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা, করপোরেশন ও বিভাগের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। বিশেষ করে গত দেড় দশকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় বড় ধরনের দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) দফতরের নিরীক্ষায় বিভিন্ন সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি ঋণের নামে লুট করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরে বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক খাতের অলিগার্কসহ বেসরকারি খাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত ও নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, করপোরেশন ও বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখার কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। এখানে শুধু জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর নিয়েই আলোচনা করবো।
এখন প্রশ্ন আসে সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইন বাতিল করলো, কিন্তু এর আওতায় সম্পাদিত বহুল আলোচিত কিছু বিতর্কিত প্রকল্প নিয়ে কেন নিরপেক্ষ তদন্ত করলো না? কেন দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হলো না? অনেকের ধারণা থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়বে বিধায় সুচতুর আমলারা সরকারকে প্রভাবিত করেছে। অথচ সরকার কোনো বাছ বিচার না করেই বিগত আমলে সম্পাদিত কিছু সত্যিকারের জরুরি প্রকল্প বাতিল করে জ্বালানি সংকট ঘনীভূত করেছে। নিজেরাও গত একবছরে নতুন করে জ্বালানি অনুসন্ধান এবং উন্নয়নে কোনো নতুন কিছু করতে পারেনি। মূল্যবান কয়লা সম্পদ নিচে পড়ে আছে, গ্যাস তেলের অনুসন্ধান চলছে গতানুগতিক ধারায়। সাগরে বা স্থলভাগে নতুন করে বিডিং রাউন্ড ঘোষণা থেকে সরে এসেছে সরকার। এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাধা পড়ে আছে। ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনার উদ্যোগ যদিও বেড়াজালে বন্দি। নতুন তেল শোধনাগার স্থাপন অথবা একমাত্র তেল শোধনাগার সংস্কারকাজ ঝুলে আছে, বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও জ্বালানি সংকট এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা, নীতির ধারাবাহিকতার অভাবে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে দেশি-বিদেশি পুঁজির দুর্ভিক্ষ চলছে।
বর্তমান অবস্থা বিদ্যমান থাকলে ২০৩০ নাগাদ দেশের প্রমাণিত গ্যাসসম্পদ শূন্যের কাছাকাছি হয়ে যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে এ সময়ের মধ্যে এলএনজি আমদানির অবকাঠামো স্থাপন করে আমদানির ব্যবস্থা করাও সহজ হবে না। সবকিছু নির্ভর করবে নতুন সরকার কীভাবে নিজেদের জ্বালানি দ্রুত অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন করে।
মনে রাখতে হবে বিগত সময়ের মহাদুর্নীতির সঠিক তদন্ত করে জ্বালানি সেক্টরে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি সৃষ্টি না করতে পারলে বাংলাদেশ কখনো দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করতে পারবে না। আর সে অবস্থায় আর্থিক উন্নয়ন এবং অগ্রগতি দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। বিপিসি, পেট্রোবাংলা এবং বিজিবির বর্তমান অসহায় অবস্থার জন্য কারা দায়ী অনেকেই জানে। মিডিয়ায় অনেক দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে। কেন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পসমূহে বিপুল অর্থ অপচয় করা হয়েছে, কেন নিজেদের জ্বালানিসম্পদ উন্নয়ন উপেক্ষা করে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া করা হয়েছে সবাই জানে। আরো জানে কারা জ্বালানি বিদ্যুৎ অপচয়, লসের নামে চুরিতে জড়িত। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ না থাকা সত্ত্বেও কেন ব্যবস্থা নিলো না, সেটি শুধু দুঃখজনক নয় রহস্যজনক।