অনেকেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিজের অবদান নিয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। জুলাই আন্দোলনে আহত ও প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া মানুষেরা সরকারের যথাযথ মনোযোগ পায়নি। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় আইন ভাঙা হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর এবং সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিত আরো খারাপের দিকে যাবে। পুলিশের দায়িত্বশীলতার অভাব, দুর্নীতি ও বিদেশি ঋণের অপব্যবহার প্রমাণ করে যে দেশে এখনো ফ্যাসিবাদের প্রভাব গভীর।
অনেকের বক্তৃতায় এসব বক্তব্য উঠে আসে বিআইপির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : বৈষম্যহীন ও পরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক জুলাই সংলাপে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এর সভাপতিত্বে সংলাপ শুরু হয়। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী এবং নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের আঁতাতের কারণেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়নি। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন, নাগরিক সুবিধাদি, দেশের বিভিন্ন এলাকার সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাসহ (ড্যাপ) বিভিন্ন নীতি পরিকল্পনা প্রণয়নে আগের মতোই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় রাষ্ট্রকে তৎপর দেখা যাচ্ছে। এর বিপরীতে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত, শোষণহীন, জবাবদিহিমূলক এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পিত ও টেকসই বাংলাদেশ পুনর্গঠনকে প্রাধিকার দিতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এ জনআকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে গোষ্ঠীস্বার্থের বিপরীতে জনস্বার্থ এবং টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জুনায়েদ ইসলাম জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি জানান, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠনের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও হামলার শিকার হয়েছিলেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ, নিজের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং একটি নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তা বাস্তবায়নে সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করবেন। পরিকল্পনাবিদ সাব্বির আহমেদ লিয়ন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যিনি জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাবরণ করেন। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তাকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ সংগ্রামে শামিল হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি আশা প্রকাশ করেন, তার মতোই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, সেই সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে সবাই অব্যাহতভাবে কাজ করবেন। জুলাই আন্দোলনে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়ের মা ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক শামসি আরা জামান জানান, ১৯ জুলাই শহিদ প্রিয়র মৃত্যুর পরদিন থেকেই পরিবারকে মিথ্যা মামলা, হুমকি ও বাসায় হামলার মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়। পরবর্তী সময়ে এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে পরিবার ঢাকার নিউমার্কেট থানা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতিতে শহীদ পরিবারগুলো গভীরভাবে হতাশ। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ন্যায্যতা, দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত, জবাবদিহি এবং জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে একটি টেকসই বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রামে বিআইপি ভবিষ্যতে সক্রিয়ভাবে পাশে থাকবে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-এর সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম বলেন, পেশাজীবীদের ফ্যাসিবাদ এখনো কাটেনি, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি ড্যাপ সংস্কার উদ্যোগে। সেখানে মূলত ভবনের উচ্চতার দিকেই জোর দেওয়া হচ্ছে, অথচ শহরের বাসযোগ্যতা, সবার জন্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধাদি নিশ্চিত করার জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের ওপর গণহত্যা বন্ধ করতে তিনি একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন। সে সময় গবেষণার মাধ্যমে তিনি দেখেন, যেসব শিক্ষার্থীর জন্য আন্দোলন করেছিলেন পরে বিভিন্নভাবে তাদের অনেকেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিজের অবদান নিয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। তিনি আরো বলেন, জুলাই আন্দোলনে আহত ও প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া মানুষরা সরকারের যথাযথ মনোযোগ পায়নি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রীয় আইন ভাঙা হলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর এবং সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিত আরো খারাপের দিকে যাবে। তিনি আরো বলেন, পুলিশের দায়িত্বশীলতার অভাব, দুর্নীতি ও বিদেশি ঋণের অপব্যবহার প্রমাণ করে যে দেশে এখনো ফ্যাসিবাদের প্রভাব গভীর। স্থপতি ফারহান শারমিন বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর সরকারি হাসপাতালের ৮০-৯০ ভাগ আহত ব্যক্তি ছিলেন, যারা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সস্তান, কিন্তু পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন ও চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আহতদের তালিকাভুক্তিতেও দেখা গিয়েছে দীর্ঘসূত্রতা, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। পিআইবি মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, এ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা শুধু সংস্কার চাইনি, চেয়েছিলাম ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন। এ সরকার তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে সেভাবে সফল হয়নি, যার মূল কারণ প্রতিদিন বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিপ্লব। বিপ্লব ঠেকানোর দায়ভার সরকারের পাশাপাশি আমাদের নিজেদের নিতে হবে। বুয়েটের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, মানুষের মনস্তত্ত্ব ও জমিন বিগত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তার ফলশ্রুতিতেই জুলাই আন্দোলন হয়েছে। তিনি জানান, আমাদের দেশে অনেক গণঅভ্যুত্থান হয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থান হয়নি। ফলে দেশে অনার্জিত আয়ের ফলে সৃষ্ট বৈষম্য উচ্ছেদ করা যায়নি। লিখন শিকদার, তার বক্তব্যের মাধ্যমে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাইয়ের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, আমরা আন্দোলন করেছি বৈষম্যকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য। কিন্ত বছর ঘুরে আমরা যখন আবার দেখি নতুন করে বৈষম্যের বীজ বপন চলছে তা আমাদের ব্যথিত করে। বিআইপির সহ-সভাপতি সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে যা হয়েছে, তা পুরো জাতির বিবেক নাড়া দিয়ে গেছে। আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যাবস্থা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। সরকারি নানা দফতরে এখনো স্যার না বলার অপরাধে তুলকালাম কাণ্ড বেধে যায়। নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস লেখা খুব কঠিন একটা কাজ, কেননা লেখকের ব্যক্তিগত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস বিভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। আমরা যদি ইতিহাস ও ঘটনা প্রবাহকে নৈমিত্তিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি, সেটাই হবে আমাদের প্রাপ্তি, সেটাই হবে আমাদের অর্জন।