কঠোর অভিবাসন নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রে ১২ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের ঘাটতি


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 03-09-2025

কঠোর অভিবাসন নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রে ১২ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের ঘাটতি

যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি ও অভ্যন্তরীণ নজরদারি অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর এক বিশাল প্রভাব ফেলেছে। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর আগ্রাসী অভিযান, নীতিগত কঠোরতা এবং আতঙ্কের পরিবেশে গত কয়েক মাসে দেশটির বিভিন্ন খাতে লক্ষাধিক অভিবাসী শ্রমিক হারিয়ে গেছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সর্বশেষ বিশ্লেষণ বলছে শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজার থেকে অন্তত ১২ লাখ অভিবাসী শ্রমিক হারিয়ে গেছেন। কৃষি, নির্মাণ এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এই ঘাটতি শুধু উৎপাদনেই নয়, অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবাহেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অভিবাসী নির্ভর শ্রমব্যবস্থা যখন ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠছে যে, এ নীতিকাঠামো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য আদৌ টেকসই কি না। এ শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছেন বৈধ এবং অবৈধ দুই ধরনের অভিবাসীই। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে কর্মরত শ্রমশক্তির প্রায় ২০ শতাংশই অভিবাসী এবং কৃষি, নির্মাণ ও স্বাস্থ্য খাতে তারা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছেন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সিনিয়র গবেষক স্টেফানি ক্রেমার জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি, মৎস্য এবং বন সংরক্ষণ খাতে শ্রমিকদের ৪৫ শতাংশই অভিবাসী। নির্মাণ খাতে এ সংখ্যা ৩০ শতাংশ এবং সেবা খাতে ২৪ শতাংশ। এতো বিশাল সংখ্যক অভিবাসীর হঠাৎ ঘাটতির ফলে দেশজুড়ে শ্রম সংকট স্পষ্টভাবে দেখা দিচ্ছে।

টেক্সাসের ম্যাকঅ্যালেন অঞ্চলে ভুট্টা ও তুলার ক্ষেত প্রস্তুত থাকলেও কাজ শুরু করা যাচ্ছে না পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাবে। ন্যাশনাল ফার্মওয়ার্কার মিনিস্ট্রির ফার্মওয়ার্কার অ্যাডভোকেট এলিজাবেথ রড্রিগেজ জানান, আমাদের তরমুজ ও ক্যান্টালুপ মৌসুমে আইসের অভিযান সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক ফলই নষ্ট হয়ে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ভেনচুরা কাউন্টিতে ৮০০ একরের কৃষিজমি পরিচালনা করেন লিসা টেট। তার মতে, অভিবাসন নীতির কড়াকড়ির কারণে কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা কমেছে এবং ভয় পরিবেশকে আরো খারাপ করেছে। মানুষকে রাস্তা থেকে, লন্ড্রি থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এই পরিস্থিতিতে মানুষ কাজে আসতেই ভয় পাচ্ছে। ম্যাকঅ্যালেন ও আশপাশের এলাকায় নির্মাণকাজ প্রায় পুরোপুরি থেমে গেছে বলে জানান রড্রিগেজ। আমাদের এখানে নির্মাণ শ্রমিকদের একটা বড় অংশই অভিবাসী। আমরা দেখেছি, আইস টার্গেট করছে নির্মাণ সাইট এবং গ্যারেজগুলোকে।

অ্যাসোসিয়েটেড জেনারেল কন্ট্রাকটরস অব আমেরিকার তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকেরও বেশি শহরে নির্মাণ কাজ কমেছে। কেবল রিভারসাইড সান বার্নার্ডিনো অন্টারিও এলাকায় ৭ হাজার ২০০টি নির্মাণ চাকরি হারিয়ে গেছে, লস অ্যাঞ্জেলেস অঞ্চলে হারিয়েছে ৬ হাজার ২০০টি। স্বাস্থ্যসেবাতেও অভিবাসীদের অবদান বিশাল। হোম কেয়ার এইডদের ৪৩ শতাংশই অভিবাসী। ক্যালিফোর্নিয়ার এসইআইইউ ২০১৫ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট আর্নুলফো ডে লা ক্রুজ জানান, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবার অর্ধেকেরও বেশি কর্মী অভিবাসী। তাদের ছাড়া হাসপাতাল ও নার্সিং হোম চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রচারণার সময় বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবৈধ অভিবাসীদের লক্ষ লক্ষ জনকে ফেরত পাঠানো হবে। যদিও তিনি বলেছেন তার লক্ষ্য ‘বিপজ্জনক অপরাধী’ অভিবাসীরা, কিন্তু বাস্তবে আইস যাদের আটক করেছে, তাদের বেশির ভাগেরই কোনো ফৌজদারি অপরাধ নেই। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশের হার কমলেও অভিবাসী শ্রমিক হারানোর ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ডালাস ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ পিয়া অরেনিয়াস বলেন, আমরা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের চাকরি বৃদ্ধির অন্তত ৫০ শতাংশ পেতাম অভিবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে। এখন সেই প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে, যার প্রভাব সুস্পষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমশক্তির এক বিশাল অংশ অভিবাসী নির্ভর। অথচ বর্তমানে কঠোর অভিবাসন নীতির ফলে কৃষিপণ্য নষ্ট হচ্ছে, নির্মাণকাজ থেমে আছে, স্বাস্থ্যসেবা সংকটের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। অভিবাসী শ্রমিক ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কতটা এগোতে পারবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিতে কাঁপছে স্থানীয় অর্থনীতি

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির প্রভাব ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র সাত মাসের মাথায় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় এবং আইনি অনিশ্চয়তার ফলে শ্রমবাজারে বড় ধাক্কা লেগেছে। বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, নেব্রাস্কা এবং ফ্লোরিডার মতো কৃষিনির্ভর ও নির্মাণনির্ভর রাজ্যগুলোতে শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় মে থেকে জুন মাসের মধ্যে সামগ্রিক শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমেছে ৩.১ শতাংশ। অবৈধ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এই হ্রাস ৭.২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু আটক বা বহিষ্কার নয়, বরং অভিবাসী জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ভীতি এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা এ সংকটে ভূমিকা রাখছে। অনেকেই এখন কর্মস্থলে যেতে সাহস পাচ্ছেন না।

শুধু শ্রমবাজার নয়, প্রভাব পড়েছে শিক্ষা খাতেও। ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ভ্যালির বিভিন্ন স্কুলে জুন মাসে উপস্থিতির হার ২২ শতাংশ কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত টহল বাহিনী প্রধান গ্রেগরি বোভিনোর নেতৃত্বে চালানো অভিযানের পর এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নির্মাণ খাতেও একই ধারা। যেখানে অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা বেশি এমন ১০টি রাজ্যে জুন মাসে নির্মাণ খাতে কর্মসংস্থান কমেছে ০.১ শতাংশ, অন্যদিকে অন্যান্য রাজ্যে একই সময়ে এই হার বেড়েছে ১.৯ শতাংশ। আতিথেয়তা খাতেও মন্দা দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের জুনে খাতে শ্রমিক বৃদ্ধির হার মাত্র ০.২ শতাংশ, যেখানে ২০২৪ সালের একই সময়ে তা ছিল ১.৫ শতাংশ।

কৃষি খাতে, ২০২৫ সালের মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার কর্মসংস্থান হারিয়েছে, যেখানে গত বছর একই সময়ে ২.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এরই সঙ্গে গরু ও শুকরের মাংসসহ অনেক কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যা শ্রম সংকটের সরাসরি প্রতিফলন। ইমিগ্র্যান্ট অধিকারকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, অনেক প্রতিষ্ঠান সরকার অনুমোদিত ই-ভেরিফাই ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ নিশ্চিত করার পরও অভিযানের শিকার হয়েছে। হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান ‘অতিরিক্ত আত্মতুষ্ট’ হয়ে পড়েছে এবং ই-ভেরিফাই ব্যবহারে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

অভিবাসী অধিকার কর্মীরা সতর্ক করছেন, অভিবাসন অভিযান ও বহিষ্কার প্রক্রিয়া চলমান থাকলে তা যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজার এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা বলছেন, এ ধারা আগামী তিন বছর অব্যাহত থাকলে অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)