১৬ জুন ২০২৫, সোমবার, ১০:৪১:১২ পূর্বাহ্ন


বিএনপির নয়া কর্মসূচি কার স্বার্থে?
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৭-২০২৪
বিএনপির নয়া কর্মসূচি কার স্বার্থে?


দীর্ঘ বিরতির পর দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি বাদ দিয়ে অন্য কয়েকটি ইস্যুতে বিএনপি’র রাজনীতির মাঠে রোডমার্চ, লংমার্চ ও সমাবেশের মত কর্মসূটি নিয়ে মাঠে নামা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এসব ইস্যু কারো কারো মতে, দায়সারা গোছের। তাদের মতে, ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে একদফা আন্দোলন করতে গিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থার পাশাপাশি দলের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। আপাতত সে দৃশ্যপাট থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাতে দলটির এমসন কর্মসূচি নিয়েছে। কারো কারো মতে, ছাই দিয়ে ঢেকে রাখতে এমন কর্মসূচিতে দলের নেতাকর্মীদের একধরনের চাঙ্গা ব্যবস্থা রাখার চেষ্টা। এসব তথ্য পাওয়া গেছে দলের বেশ কয়েকজন নেতা কর্মীরা সাথে কথা বলে। 

বিএনপি নতুন ইস্যু

সাত জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ম্যারাথন বিরতিতে ছিল বিএনপি। কিন্তু বিএনপি’তে আন্দোলন কর্মসূচি না থাকলেও নানান ধরনের সংস্কারের ব্যবস্থা নেয়া হয়। কারো কারো মতে, এসব কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে দলের ভেতরে ঘাপটি মারা সরকারের এজেন্টদের বের করে দেয়া বা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। কিন্তু এসব কর্মকান্ড চালাতে গিয়ে দলের হাইকমান্ডই এখন পড়েছে তোপের মুখে। অভিযোগ উঠেছে কানকথার পাশাপাশি আশে পাশে থাকা অযোগ্য অশিক্ষিত কিছু মুখচেনা ব্যক্তিবর্গের কারণে মাঠের ত্যাগি নেতা কর্মীদের মূল্যায়িত করা হয়নি এবং এখনোও হচ্ছে না। অথচ অভিযোগ রয়েছে দলের হাইকমান্ড অতিমাত্রায় পশ্চিমাদের আশ্বাসে ভরসা রেখে একদফা আন্দোলনের ছক একেছিল। 

বিএনপি’র হাইকমান্ডের অতিমাত্রায় পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরশীলতার পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক কৌশলের কাছে হেরে গেছে,যা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ বা বক্তব্য না দিয়ে দলের ভেতরে ঢালাও ভাবে সংস্কারের নামে বুলডোজার চালানো হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আর এসব বিষয় মাঠে ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ার কারণে তড়িগড়ি নতুন কয়েকটি ইস্যু নিয়ে সমমনাদের এক ছাতার নিচে আনতে বিএনপি’র হাই কমান্ড উঠে পড়ে লেগেছে। বলা হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভয়াবহ দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তিসহ জনসম্পক্ত ইস্যুতে দলটিকে রোডমার্চ, লংমার্চ ও সমাবেশ করবে। এসব নিয়েই গত কয়েকদির সমমনা দল ও জোটগুলোর সাথে আলাপ চালানো হচ্ছে। 

এসব কর্মসূচিতে আসলে লাভ কার?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও এর সাথে সম্পৃক্ত মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি কয়েকটি বড়ো মাপের ইসলামী দলও সম্পৃক্ত হয়েছিল। প্রায় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দলের এমন ঐক্যে ক্ষমতাসীন সরকারের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি ও এক পর্যায়ে ভীতির সঞ্চারও করে। এমন জোটকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এর আগে নেয়া সেসব ইস্যুতে আন্দোলন না করে অন্য কথা সফলতা না এনে নতুন কর্মসূচি আসলেই রহসজন্যক। কারো কারো মতে, দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিকে প্রাধান্য না দেয়ায় ক্ষমতাসীনরা কিছুটা প্লাস পয়েন্টে রয়েছে। আর বিএনপি সামনের দিকে যে সব ইস্যুতে মাঠ গরম করতে চায় সেটিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলার পথে লাভ। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি নিয়ে বিএনপি মাঠে ভারত বিরোধী ভূমিকায় নামলে আওয়ামী লীগেরই লাভ। সম্প্রতি অনেকের ধারণা আওয়ামী লীগ সরকারের চীন সফর নিয়ে ভারত নাখোশ। আর একারণে ভারতে পত্রপত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর নিয়ে সেদেশের পত্রপত্রিকায় বেশ নেতিবাচক মন্তব্য উঠে আসে। এনিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু বিএনপি যদি ক্রমাগত ভারত বিরোধী ইস্যুগুলিকে মাঠে প্রাধান্য দিয়ে মাঠ গরম করতে থাকে সেক্ষেত্রে এর পুরো বেনিফিট আওয়ামী লীগ নিতে বাধ্য। প্রতিবেশী দেশটিকে দেখাবে বিএনপি মৌলবাদি ও সাম্প্রদাযিক দল নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে দেশটির সঙ্গে অসম চুক্তি করা হয়েছে বলে নেতিবাচক প্রচারণায় নেমেছে। এতে লাভ পুরো আওয়ামী তুলে নেবে। অন্যদিকে বিএনপি যদি এখন ২০২৩ সালে নেয়া সে-ই একদফার আন্দোলন চালিয়ে যায়। কিংবা এর পাশাপাশি ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল দাবি করে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামে তাহলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়ে যাবে। কেননা এধরনের দাবি নিয়ে বিএনপি ও তার সাথে সমমনারা মাঠে নামলে তাকে রুখে দিতে বা মোকাবেলায় দিতে আওয়ামী লীগতে পাল্টা কর্মসূচি দিতে হচ্ছে। যা নিয়ে দেশে বিদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বার্তা চলে যায়। অন্যদিকে এসব ইস্যুতে যদি বিএনপি ও সমমনারা মাঠে একের পর এক কর্মসূচি দিতে থাকে তাহলে সেটিকে বাধা দিতে গেলে পশ্চিমাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে হবে ক্ষমতাসীনদের। কারণ গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে বাধা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বাড়তি ঝামেলায় পড়তে পারে সরকার। আর এজন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভয়াবহ দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তিসহ এসব ইস্যুতে দলটিসহ সমমনারা রোডমার্চ, লংমার্চ ও সমাবেশ করলে ক্ষমাসীন আওয়ামী লীগের একদিক লাভই হয়। 

শেষ কথা..

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভয়াবহ দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তিসহ-এসব ইস্যুতে বিএনপি মাঠে নামলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থাকবে ফুরফুরে মেজাজে। কারণ মাঠের প্রধান বিরোধী দল এসব ইস্যুতে মাঠ গরম করলে এ বছরে অনুষ্ঠিত ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বচনটি নিয়ে দেশে বিদেশে উঠা নানান ধরনের অভাব অভিযোগ নিয়ে আর কোনো আওয়াজই থাকবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো মনে করে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লাভ হয় এমন সব ইস্যুতে বিএনপি মাঠে নামছে। আর এজন্য অনেকে মনে করেন, বর্তমানে রাজনৈতিক মাঠে বিএনপি’র এসব ইস্যু দায়সারা গোছের। বিএনপি’র এমন ইস্যু নিয়ে মাঠে নামলে সরকারের বিরুদ্ধে অতীতের দেশে বিদেশে উঠা আসল অভিযোগ চাপা পড়ে যাবে। সরকার রাজনৈতিক ও কুটনৈতিকভাবে লাভবান হবে। অন্যদিকে অনেকে মনে করেন দেশের সরকারের ভেতরে ভয়াবহ দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইস্যুতে মাঠে নামলেও সরকারের লাভ। কারণ এসব ইস্যুতে কঠোর হবে সরকার নিজের ভেতর থেকে খুব একটা সাহসী হতে পারছে না। এপর্যন্ত কোনো ধরনের বাণিজ্য সিন্ডিকেট ভাঙ্গার নজিরও স্থাপন করতে পারছে না। এর কারণ সর্বত্র সরকারের মাই ম্যানের দাপট। সেক্ষেত্রে বিএনপিসহ সমমনারা এই ইস্যুত কথা বললে সরকার কিছুটা পদক্ষেপ নিতে সাহস পাবে। তাই এসব ইস্যুতে আন্দোলনেও সরবকারে সায় রয়েছে বলে কারো কারো অভিমত। কারণ বিএনপি যতো চাপ সৃষ্টি করুক না কেনো ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তির কিছুই হবে না। অন্যদিকে ভয়াবহ দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললেও রাজনৈতিক ময়দানে বিএনপি কোনো ফায়দা পাবে না। কারণ অনেক মনে করেন ভয়াবহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি সরকার প্রকৃতই হার্ড লাইনে থাকতো তাহলে হাইকোর্টের প্রশ্ন থাকতো না যে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ কীভাবে দেশের বাইরে গেলেন? সম্প্রতি শুনানিতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের প্রসঙ্গ আসে। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘বেনজীর আহমেদ দেশের বাইরে চলে গেছেন। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো চ্যানেলে তিনি বাইরে গেছেন। আমরা শুনেছি বিমানবন্দর দিয়ে তিনি দেশের বাইরে গেছেন। বেনজীর আহমেদকে চেনেন না এমন পুলিশ কর্মকর্তা নেই, তাহলে তিনি কীভাবে দেশের বাইরে চলে গেলেন?’ আবার যখন খবর রেরিয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম কীভাবে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হলেন? আবার তা নিয়ে যখন খবর বেরিয়ে এসেছে আর ঠিক তখনই আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলছে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই গত ১৪ জুলাই রোববার জাহাঙ্গীর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। আর সেজন্য অনেকের প্রশ্ন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভয়াবহ দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তিসহ এসব ইস্যুতে দলটিকে রোডমার্চ, লংমার্চ ও সমাবেশের কর্মসূচির ফল তার ঝুড়িতে যাবে? কে আসলে লাভবান হবে।

শেয়ার করুন