ঐতিহ্যবাহী দলকে নিয়ে নয়, নেতাকর্মীরা চিন্তিত খোদ আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভবিষ্যত অবস্থান নিয়ে। তাকে ভারতের মাটি থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এনে কারাগারে স্থান দেয়া হবে? না অন্য কোনো বিদেশেই কোনো রাষ্ট্রের আশ্রয়ে রাখা হবে? এনিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তাদের বেশ কয়েকজনেবর সাথে কথা বলেই এসব তথ্য ও তাদের আতঙ্কের কথা জানা গেছে।
যে কারণে সন্দেহ
জানা গেছে, নেতাকর্মীদের মধ্যে নানান ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে শেখ হাসিনার ভবিষ্যত বা শেষ অবস্থান নিয়ে। কেননা এবছরের জুলাই মাসে সংগঠিত হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বলা চলে বেশ দ্রুতই ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরও অনেকের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। একারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ছাত্র আন্দোলন ঘিরে গত ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত সংঘাত-সহিংসতায় ২১৭ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। অন্যদিকে ৪ আগস্ট থেকে সরকার পতনের পরও কয়েক দিনে ৩৬৫ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে ১৬ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৫৮২ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তদন্তের চেষ্টা
অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গণমাধ্যমে জানিয়েছেন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তদন্তকরার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিগগিরই জাতিসংঘের একটি তদন্ত দল গঠন করে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব বলে তিনি জানান।
তবে গণমাধ্যমে কারো কারো অভিমত প্রকাশিত হয়েছে। এতে তারা বিভিন্ন অভিমত প্রকাশও করেছেন। যুক্তি দেখিয়ে বলা হয় যে ছাত্র আন্দোলনকালে হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হওয়ার কথা প্রকাশিত হয়েছে। এই বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩-এর অধীনে। এই আইন অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যেহেতু জাতিসংঘ মৃত্যুদন্ডের বিষয়টি অনুমোদন করে না, তাই এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের যুক্ততার সুযোগ নেই বলে অভিমত জানানো হয়। তবে এর পাশাপাশি বলা হয় বাংলাদেশ চাইলে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্তে জাতিসংঘ আলাদা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সহায়তা করতে তৈরি রয়েছে।
এদিকে খবরে বেরিয়েছে যে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করেছিলেন। তাদের মধ্যে ফোনালাপের বিষয়টি দুজনই তাদের এক্স হ্যান্ডেলে প্রকাশ করেছেন। এতে জানা গেছে যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ব্যাপারে ফলকার টুর্কের সহায়তা চেয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার তাকে জানান, ছাত্র অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের তদন্তে খুব শিগগির জাতিসংঘের একটি তদন্ত দল গঠন করে বাংলাদেশে পাঠানো হবে।
ভারতে কি থাকতে পারবেন?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে শেখ হাসিনা কি এত্তোসব মামলা মাথায় নিয়ে ভারতে থাকতে পারবেন? কেন না ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলি মধ্যে শেখ হাসিনার ভারত অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য ছাপা হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, হাসিনা ভারত থেকে ষড়যন্ত্র করছে। অন্যদিকে ভারতে অবস্থানরত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিবৃতি দেওয়া পছন্দ করছে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকলীন সরকার। বলেছেন এটি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে না। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে বিষয়টি তাকে জানানো হয়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এ তথ্য জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের অবস্থান এটাই। তবে এ ব্যাপারে হাইকমিশনার কী বলেছেন তা পরিস্কারভাবে জানা না গেলেও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কূটনৈতিক পরিসীমাটি ব্যাখা করেন গণমাধ্যমে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তিনি (ভারতীয় হাইকমিশনার) কীভাবে এর জবাব দেবেন? তিনি তো ডিসাইড করতে পারবেন না। তিনি এ নিয়ে কিছু বলতে পারেন না বলে আমি মনে করি। রাষ্ট্রদূতের পক্ষে এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এটা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তিনি যেটা পারেন, তার সদরদপ্তরে জানাবেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি নিশ্চিত তিনি এটা সদরদপ্তরে জানাবেন।’
নাকি শেখ হাসিনার অবস্থান বাংলাদেশের কারাগারে?
প্রশ্ন হচ্ছে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন কড়া জবাবে ভারত হয়তোবা দো-টানায় পড়বে বা পড়তে যাচ্ছে। কেননা এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় কৌশলী না হলে শুধু এই দেশ না তার দেশ ভারত ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে মার খেয়ে যাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ছাত্র-গণআন্দোলনে সৃষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধেও তেমন কিছু করা যাবে না। কেননা এই সরকারের পেছনে শক্ত অবস্থান আছে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের। সেক্ষেত্রে ভারতে অবস্থানরত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিবৃতি বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ড চালালে কূটনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। ভারত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সরাসরি থাকতে গিয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের বিরাগভাজন হয় সে-ব্যাপারটি আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা এখন যে স্মরণকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সর্বমহলে আলোচিত হচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের মূল্য দেয়নি ভারত। তার চেয়ে সমসাময়িক ভারতের সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার বিরোধী দল ও মত নিষ্ঠুরভাবে দমনের মাধ্যমে দীর্ঘ সময়, বিশেষ করে দেড় যুগ ধরে টিকে ছিল। তাই শেখ হাসিনাকে ভারতের মাটিতে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে সম্মতি দিবে- তা মনে করেন না অনেকে। এর পাশাপাশি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এত্তোসব মামলা অভিযোগ থাকার পরও তাকে দিনের পর দিন আশ্রয় দেবে কি-না সে বিষয়টিও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় না নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন ব্রিটিশ এমপি রুপা হক। তিনি অভিমতে বলেছেন ‘আমার সরকার স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় দেবে না’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে তিনি আরও লেখেন, তার (শেখ হাসিনা) ব্যাপক অজনপ্রিয় শাসনামল ও অভিবাসন সংক্রান্ত রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার নিরিখে যুক্তরাজ্য সরকারের এমন একজনকে আশ্রয় দেওয়া সমীচীন হবে না, যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবি রয়েছে। একারণেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরার উদ্বিগ্ন তাদের দলের সভাপতি শেখ হাসিনার ভবিষ্যত অবস্থান আসলে কোথায় হবে? বিদেশে না বাংলাদেশের কারাগারে।
কি হবে তাহলে?
বর্তমানে থাকা দেশটিতে বসে যেনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা কোনো ধরণের বক্তব্য বিবৃতি দিতে না পারেন সে ব্যাপারেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কঠোর হুশিয়ারি দেয়া হয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে তার ঘাড়ে পড়ছে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত তাকার মতো গুরুতম অভিযোগ। রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন সব নাটকীয় ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন আওয়ামী লীগ বা তাদের নেতাকর্মীদের নিয়ে চিন্তিত না। শেখ হাসিনার জীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও একিই সাথে তার সঠিক অবস্থান ভারতে না অন্যদেশে? না বাংলাদেশে এনেই বিচারেরর মুখোমুখি করা হবে- এসব নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই দলের নেতাকর্মীদের।