মাত্র কয়েকদিন আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যৌক্তিক সময় দেয়ার আশ্বাস দেয়ার পরপরই এনিয়ে বিএনপি’র পক্ষ থেকে আবার ভিন্ন ধরনের বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানান ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মাত্র কয়েকদিনের মাথায় গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর কি কোনো কারণে অবিশ্বাস বা আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে দলটির? তা-না হলে এতো দ্রুত বিএনপি’র পক্ষ থেকে মত পাল্টিয়ে বক্তব্য দেয়ার হেতু কি? কৌতুহল সৃষ্টি করেছে দলটির ওপর পতিত আওয়ামী লীগের কূটকৈৗশল আছর করেছে? নাকি অন্য কোনো ভীতি কাজ করছে? এসব প্রশ্ন যে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন দেখা দিয়েছে তেমনি এর বিপরীতেও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে।
শুরুতেই বিতর্ক
ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র বিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। এরপর নানান ধরনের চড়াই উৎড়াইয়ের শঙ্কার মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ ও তড়িগড়ি করে একটি নির্বাচন দেয়ার দাবির পর থেকে বিভিন্ন আলোচনা দেখা দেয়, শুরু হয় নানান ধরনের প্রশ্ন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই আলোচনা চলে আসে যে, এই সরকারের মেয়াদ কতদিন? কতদিন তারা থাকবে? আর এমন আলোচনার মাঝে প্রথম মুখ খুলেন নতুন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করার জন্য যতদিন থাকার দরকার হবে, অন্তর্বর্তী সরকার ততদিন থাকবে”। নতুন সরকারের আরো দু’জন উপদেষ্টা এনিয়ে কথা বললেও তাদের মেয়াদ নিয়ে কারো মুখে স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি।
বিএনপি’র যৌক্তিক সময় দিতে রাজি হলো
এমন আলোচনার মাঝে বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচন না দিলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করে বিবৃতির পর বিএনপি নড়েচড়ে বসে। কারণ জয়ের মন্তব্য ছিলো অত্যন্ত প্রশ্নবোধক। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনকে’ সুযোগ দিচ্ছে। অবশ্য তার এমন বক্তব্য অর্থ্যাৎ তড়িঘড়ি নির্বাচনের দাবিকে বিএনপি বেশ আগ্রহ ভরে লক্ষ্য করে সর্তক পদক্ষেপ নেয়। দ্রুত দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে পরামর্শ করেই বিএনপি’র পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়। সাফ বলে দেয়া হয় হয় যে নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ তৈরির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দেয়া হবে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে দলের এই ধরনের বাস্তব অবস্থানের কথা জানান বিএনপির নেতারা। এমন-কি রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার পক্ষে বিএনপি সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্তও হয়।
মত পাল্টালো বিএনপি
কিন্ত এক সপ্তাহ না যেতেই মত পাল্টিয়ে ফেলে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলে বসেন দেশ গোছাতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দিতে চায় বিএনপি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়া হবে। তবে অনির্দিষ্টকালের সময় কাউকে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি এবং চলমান সংকট নিরসনে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানালেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি এবং চলমান সংকট নিরসনে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
বিএনপি’তে কিসের আতঙ্ক?
বিএনপি’র পক্ষ থেকে দ্রুত একটি জাতীয় নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিভিন্ন মহলে দেখা দিয়েছে নানান প্রশ্ন। কৌতুহল দেখা দিয়েছে যে সরকারকে তার দলসহ অনেকে মিলে ১৭ বছরে কিছুই করতো পারেনি বরং এর বিপরীতে দলটির লাখ লাখ কর্মী দিনের পর দিন মামলা-মোকাদ্দমায় জড়িয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছে। তবে বিএনপি’র পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের দাবিতে ত্যাগের কথা সবাই স্বীকার করলেও দল-মত নির্বিশেষ পুরো জনগণকে তারা কখনোই এককাতারে আনতে পারেনি। যা আনা সহজ হয়েছে ছোত্র-জনতার ব্যানারে গড়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে। আর সে-ই ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র বিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। আর এর পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার কিছুদিন না যেতেই বিএনপি এক সপ্তাহের ব্যবহারে মত পরিবর্তন করলো কিসের আতঙ্কে?
আওয়ামী আছর?
কৌতূহল সৃষ্টি করেছে এমন আন্দোলনের পর ১৭ বছরের জঞ্জাল সরিয়ে প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক সংস্কার বাদ দিয়েই কি বিএনপি খুব দ্রুত একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাইলো? চাইলো রোডম্যাপ? আসলে এর পেছনে কি কাজ করছে বিএনিপি’র ভেতরে ভেতরে? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্রুত নির্বাচন চাওয়া বা যৌক্তিক সময় দেয়া কথা বলে তা-থেকে পিছু হটে আসার পেছনে অনেক কিছু কাজ করছে। কারো কারো মতে, বিএনপি’তে একটি অংশ এখন আওয়ামী লীগের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। সে-ই আওয়ামী লীর্গে পেছনে আছে একটি প্রতিবেশী দেশ, যারা ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র বিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালানে শেখ হাসিনা ও সার্বিক পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূড়। এখনো সেই শক্তিধর প্রতিবেশী দেশটি কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। তারা ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র বিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পরে আওয়ামী লীগের কাউকেই খুঁজে পাচ্ছে না। সে কারণে বাংলাদেশে বিএনপি’র ওপর পতিত আওয়ামী লীগতে ভর করিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায় বলে কারো কারো মত। বিএনপি’র শীর্ষদের একটি অংশকে কানভারী করা হচ্ছে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশিদিন স্থায়ী থাকলে আগামীতে বিএনপি’র ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে পারবে না। সেক্ষেত্রে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানে ভবিষৎও অন্ধকার।
জামায়াতের পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
আরেকটি সূত্র জানায় বিএনপি’র কানে তোলা হচ্ছে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র বিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানে মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামী নামের দলটিই লাভবান হয়েছে। যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষিদ্ধের তালিকায় ছিল সে-দলটি এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেরাচ্ছে। বৈঠক করেছে,অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে খোলামেলাভাবেই। এমনকি ছাত্র বিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসনিার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরে বঙ্গভবনে প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী দলটির উপস্থিতি বিএনপিসহ সব মহলে দৃষ্টি কেড়েছে।
সুত্র জানায়, এমন ধারণা বিএনপি’কে দেয়া হয়েছে আগামীতে বিএনপি নয় জামায়াতকেই ক্ষমতার মসনদে বসানো হচ্ছে, মাঠ সেভাবেই গোছানো হচ্ছে। প্রশাসনিক বিভিন্ন দফতরে জামায়াত সমর্থিতদেরই পুর্নবাসন করা হচ্ছে। তবে বিএনপি’র একটি নির্ভরযোগ্র সুত্র জানায় ভিন্ন তথ্য। তাদের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যৌক্তিক সময় দেয়ার আশ্বাস দিয়ে- এনিয়ে বিএনপি’র পক্ষ থেকে আবার ভিন্ন ধরনের বক্তব্যের পেছনে আরো অন্য কারণ আছে। দলটির একজন প্রবীন নেতা দেশ প্রতিনিধিকে বলেন, নেতাকর্মীরা অধীর আগ্রহে আছে বিএনপি’কে ক্ষমতায় দেখা জন্য। তারা চায় খুব দ্রুত ক্ষমতা। নেতাকর্মীরা মামলা মোকাদ্দমায় নি:স্ব। একারণে দলে একধরনের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে যে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে বিএনপি’কে ক্ষমতায় বসানো হোক।
সে-কারণেই বিএনপি’র হাই কমান্ড মনে করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটু চাপে রাখা দরকার। তার মতে, এমন বক্তব্য দিয়ে বিএনপি’ নেতারা আসলে দলকে চাঙ্গা রাখতে চায়। তবে আরেকজন নেতা এই প্রতিনিধিকে বলেন, বিএনপি নেতাদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে একটি সেমিনারে কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার বক্তব্য দিয়েছেন। পাশাপাশি তিন বলেছেন, রাজনৈতিক দল কীভাবে নির্বাচনে আসবে, সেই গঠনতন্ত্র তৈরি হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের দাবি তোলা যাবে না। তিনি আরো বলেছেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেওয়ার জন্য গঠনতন্ত্র তৈরি হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া বিএনপির প্রধান দায়িত্ব। ফরহাদ মজহারের এমন মন্তব্য আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই এর মেয়াদ নিয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের মন্তব্য বিএনপি’তে বেশি বিচলিত করেছে। আর ফরহাদ মজহার ও অধ্যাপক আসিফ নজরুলের মন্তব্যকে পুঁজি করেই পতিত আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড গোপনে বিএনপি’র কানভারী করার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে-এমনটাই মনে করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এর পাশাপাশি মাঠে জামায়াতের প্রকাশ্যে বিচরণসহ রাজনৈতিক প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নেয়ার বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা কৌশলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে দলের হাইকমান্ড-এমনটাই বিশ্লেষণ বিএনপি’র সমর্থকদের।