এক-এগারোর সময়কার মতো বিএনপির বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। নির্বাচনে জেতার জন্য বিএনপির যত বেশি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তত বেশি বিএনপিকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
কথাগুলো অনেকটাই ভারাক্রান্ত মনেই বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন একটি অনুষ্ঠিানে। অনুষ্ঠানটি ছিল বিএনপির ‘অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট’দের সম্মানে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের কথা উল্লেখ করে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের সতর্ক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমি কেন্দ্রীয় অফিসে খোঁজ নিয়েছি, বিষয়টি এক রকম অথচ পত্রিকায় এসেছে আরেক রকম। সে জন্য আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে। ‘জিয়া সাইবার ফোর্স’ (অনলাইনভিত্তিক সংগঠন) এর উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
মির্জা আব্বাসেরও ক্ষোভ....
‘এই যে এডিটিং করতেছেন, নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন...কেন এই কাজগুলো করেন। এটা তো পরশ্রী কাতরতা, এটা অন্যকে ক্ষতি করা। এই কাজগুলো করলে মাফ পাবেন না, এটা কি জানেন?’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গত ২৩ মার্চ রোববার বিকেলে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক আলোচনা ও ইফতার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এসব কথাগুলো অকপটে বলে ফেলেন। ওইদিন সে অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক মাঠে বিএনপি’র পরীক্ষিত ত্যাগি এই নেতা জামায়াত নেতার উদ্দেশে এসব বলেছেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা তাঁর দেওয়া একটি বক্তব্যকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছেন বলে অভিযোগ করেছেন মির্জা আব্বাস। এসময় মঞ্চে উপস্থিত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য মো. দেলোয়ার হোসাইনের উদ্দেশে মির্জা আব্বাস এসব কথা বলেন।
মির্জা আব্বাস বলতে থাকেন ‘এই যে আমার পাশে বসে আছেন জামায়াতে ইসলামীর ভাই। আমি একটা মিটিংয়ে বলেছিলাম, নবী উল্লাহ নবীকে জেলে দে তারপর আমি কথা বলব। এই কথাকে বিকৃত করে কীভাবে লিখতেছে। আপনি আপনার দলের দিকে প্লিজ খেয়াল রাইখেন ভাই।’ গণমাধ্যমের খবরে জানা গেলো এর আগে ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীতে বিএনপির এক সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীরা স্লোগান না থামানোয় মির্জা আব্বাস মেজাজ হারিয়ে বলেছিলেন, ‘ওই ব্যাটা, কার কথা কইতাছস তুই? ফাজিল কোথাকার! নবীরে ধইরা জেলে দিয়া আয়। ফাজিলগুলা কোথাকার।’ উল্লেখ্য, বিএনপির ওই এলাকার প্রভাবশালী এক নেতার নাম নবী উল্লাহ নবী। সম্প্রতি মির্জা আব্বাসের সেই বক্তব্য সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাতে মির্জা আব্বাস মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে ওই কথা বলেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে। আর এমন প্রসঙ্গটি টেনে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইনের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস আরও বলেন, ‘এই যে এডিটিং করতেছেন, নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন...কেন এই কাজগুলো করেন। এটা তো পরশ্রীকাতরতা, এটা অন্যকে ক্ষতি করা। এই কাজগুলো করলে মাফ পাবেন না, এটা কি জানেন?’ অবশ্য সেই অনুষ্ঠানে মির্জা আব্বাস বক্তব্য দিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করে চলে যান। পরে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন বক্তব্য দেন। তবে তিনি মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের বিষয়ে কিছু বলেননি।
অতীত ফিরে দেখা....
অতীত ঘেটে দেখা যায় বিএনপি এমনই মিডিয়া ট্রায়ালে পড়ে দলটির খোদ শীর্ষ নেতা ইমেজ ভয়াবহ সঙ্কটে পড়ে। ২০০৭ সালের দিকেই তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। গণমাধ্যমের খবরে দেখা দেয় সেই সময়ে মিডিয়া ট্রায়ালের ন্যাক্কারজনক শিকার হয়ে বিএনপি নেতারা ভয়াবহ ইমেজ সংকটে পড়েছিল। মিডিয়া ট্রায়ালের কারণেই ২০০৭ সালের ৭ মার্চ কোনো ধরনের মামলা ছাড়াই তৎকালীন সেনা সমর্থিত মইন উদ্দিন ও ফখরুদ্দীনের ওয়ান-ইলেভেনের সরকার জরুরি বিধিমালায় তারেক রমহানকে গ্রেপ্তার করেছিল। এরপর থেকেই তারেক রহমানের চরিত্র হননে লাগাতার প্রচারণা চালানো হয়। তবে সেই আমলে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরে টাস্কফোর্স, এনবিআর, দুদকসহ সরকারের সব সংস্থা অনুসন্ধান করেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অথবা অবৈধ সম্পদ অর্জনের কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তবে তারেক রহমানকে এরপর থেকে ‘টেন পার্সেন্ট’ বা ‘খাম্বা তারেক’ বলে নেতিবাচক বিশেষণে হাজির করতো ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার অর্থানুকল্যে বেড়ে উঠা বুদ্ধিজীবী ও একশ্রেণীর গণমাধ্যমকর্মীদের দ্বারা।
কিন্তু বিএনপি’র বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল রুখবে কে?
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস উভয়েই বর্তমানে ডিজিটাল যুগের নেতা। বয়সের কারণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের পক্ষে হয়তবা ডিজিটাল যুগের ফাঁক-ফোকড় জানা বা বুঝতে পারা কঠিন। কিন্তু দল চালাতে গিয়ে অন্তত গত ১৫ বছরে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই মিডিয়া ট্রায়াল সম্পর্কে বুঝতে পারা তার জন্য সহজই। কারণ তিনি ডিজিটাল প্লাটফরমকে অত্যন্ত কৌশলে বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পেরেছেন। তিনি যে ইফতার অনুষ্ঠানে ওই বক্তব্য রাখছিলেন সেটিও ছিল ‘জিয়া সাইবার ফোর্স’ (অনলাইনভিত্তিক সংগঠন)-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠান। বিএনপি’র শুভানুদ্যায়ীদের প্রশ্ন হচ্ছে ‘জিয়া সাইবার ফোর্স’কি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি’র বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল ঠেকাতে কোনো কার্যকর কার্যক্রম নেবে? তাদের সদস্যরা কি সাইবার ফোর্স কি সত্যিকারভাবে একটি কৌশলী ফোর্স হিসাবে কাজ করবে বা করছে? প্রশ্ন হচ্ছে তারা কি আদৌ সাইবার যুদ্ধ বা লড়াই সম্পর্কে অবগত?
‘জিয়া সাইবার ফোর্স’ এর সদস্যরা কি প্রকৃত সাচ্চা জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী? তাদের সদস্যরা কি সাইবার যুদ্ধ বা মিডিয়া ট্রায়াল মোকাবেলায় প্রস্তুত, নাকি পদপদবির লড়াইয়ে ব্যস্ত? কেননা বিএনপি’র জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী বলে কথিত বহু পেশাজীবি সংগঠন রয়েছে যাদের সদস্যরা অন্য একটি রাজনৈতিক দলের গোপন সদস্য। অভিযোগ আছে গোপনে তারা জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ভাব ধরে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী একটি দলের পক্ষে কাজ করে। অতীতেও দেখা গেছে এভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিটি বিএনপি’র ওইসব পেশাজীবী সংগঠনের ছায়াতলে অবস্থান করে, সুযোগ সুবিধা নিয়ে সময়মত সটকে পড়ে। অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন অনেক মিডিয়া হাউজ তৈরিতে দলটি অকৃত্রিম সহযোগিতা করে। কিন্তু দুভার্গ্যজনক হলে সত্য ওই মিডিয়া হাউজগুলোই অতীতে কখনো বিএনপি বা জাতীয়তাবাদী আর্দশের পক্ষে কলম ধরেনি? তাই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে এমন পরিস্থিতিতে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি’র বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ঠেকাবে কে বা কারা? তেমন সাইবার শিক্ষিত রুচিশীল সাচ্চা জাতীয়তবাদী সাইবার যোদ্ধা কি বিএনপি তৈরি করতে পেরেছে? না পারবে? তা না হলে সামনের দিনগুলিতে তারেক রহমান কিংবা মির্জা আব্বাসেরও বিরুদ্ধে এমন মিডিয়া ট্রায়াল বা প্রতিপক্ষের সাইবার যুদ্ধ মোকাবেলা দায়-দায়িত্ব কে নেবে? কে তারেক রহমান কিংবা মির্জা আব্বাসের এমন ক্ষোভ হতাশা সামাল দেবে? যেখানে শোনা যায়, একটি শক্তিশালি ডিজিটাল প্লাটফরম তৈরি করে পতিত ফ্যাসিবাদ দেশে বিদেশে সহানুভুতি লাভে একটি গ্রাউন্ড তৈরি করতে সচেষ্ট। আর অন্যদিক একইভাবে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী শক্তিটিও শক্তিশালি ডিজিটাল প্লাটফরম করে বিএনপি’র বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের ঘাড়েই বন্দুক রেখে।